চীনের মহাপ্রাচীর হলো বিশ্বের অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থান যা বিশ্বের দীর্ঘতম এবং মানব নির্মিত প্রাচীর। প্রাচীন প্রতিরক্ষামূলক স্থাপত্যের একটি বিস্ময়কর কীর্তি হচ্ছে এই মহাপ্রাচীর। পাহাড় ও সবুজ বনভূমির উপরে বিস্তৃত ২১ হাজার ১৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চীনের মহাপ্রাচীর। এই প্রাচীরের প্রস্থ এতটাই যে প্রায় ১২ জোড়া ঘোড়া একসঙ্গে দৌঁড়াতে পারবে এখান দিয়ে। বসন্তকালে দেওয়ালের সবুজ লতা-পাতা তাদের প্রাণ ফিরে যায়। ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে চীনের মহাপ্রাচীর হতে পারে আদর্শ এক পর্যটন স্থান।
চীনের মহাপ্রাচীর বলতে কোন একক প্রাচীরকে বোঝায় না। চীনের বিভিন্ন রাজবংশের আমলে তৈরি প্রাচীরগুলোকে একত্রে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’ বা চীনের মহাপ্রাচীর বলা হয়।
চীনের মহাপ্রাচীরটি বহু শতাব্দী ধরে চীনের সম্রাটরা তাদের ভূখণ্ড রক্ষার জন্য তৈরি করেছিলেন। আজ, এটি চীনের ঐতিহাসিক উত্তর সীমান্ত বরাবর হাজার হাজার মাইল পর্যন্ত প্রসারিত। মানব নির্মিত এই সপ্তাশ্চর্য খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে, এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরপর থেকে প্রাচীরটি সংস্কার, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণের কাজ চলেছে প্রায় উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত।
এই মহাপ্রাচীরের সবচেয়ে প্রাচীন অংশ ২৭০০ বছরের পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৭৭০ থেকে ২৭৬ এর মধ্যে প্রথম এসব প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এত বড় স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল এক গুজব-এর উপর ভিত্তি করে। সম্রাট কিন শি হুয়াং খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে সমগ্র মধ্য চীন একত্রিত করে কিন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। কিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই চীনের বেশ কিছু ছোট ছোট রাজ্য শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রাচীর নির্মাণ করেছিল।
সম্রাট কিন রাজ্য জয়ের পর এক জাদুকর তাকে বলেছিল উত্তরের যাযাবররা সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সম্রাট আশেপাশের রাজ্যগুলোর ছোট ছোট প্রাচীরগুলোর মাঝে সংযোগ তৈরি করার আদেশ দেন। খ্রিস্টপূর্ব ২২০ থেকে ২০০ সালের মধ্যে দেয়ালগুলোর মধ্যে সংযোগ সাধন করা হয়। আর তখনই চীনের ছোট ছোট প্রাচীর মহাপ্রাচীরের আকার ধারণ করে। আর সেই প্রাচীরের খুব সামান্যই এখন অবশিষ্ট আছে।
বর্তমানে প্রাচীরের যেসব অংশ দেখা যায় তার অধিকাংশই মিং রাজবংশের শাসন আমলে নির্মিত হয়। ১৩৮১ সালে মিং রাজবংশ প্রাচীর নির্মাণ কাজ শুরু করে। তারা প্রায় ৮৮৫১ কিলোমিটার প্রাচীর নির্মাণ করে। এসব প্রাচীর নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনের উত্তরসীমান্ত বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। কোন কোন স্থানে দুই বা তিন সারি পর্যন্ত দেয়াল তুলে প্রাচীরের সেই উদ্দেশ্য সফল করা হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রাচীর নির্মাণে অবদান রেখেছে সর্বমোট ২০টি রাজবংশ।
এসব রাজবংশের শাসনামলে বিভিন্ন ধাপে প্রাচীরের পরিবর্ধন, পরিবর্তন, সম্প্রসারণ ও পুনর্নিমাণ করা হয়। এর সামরিক অবকাঠামো তৈরিতে প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি মানুষকে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়। সৈনিক, সাধারন শ্রমিক, বেসামরিক জনতা এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো হয়। এই প্রাচীর তৈরি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ৪ লক্ষেরও অধিক লোক মারা যায়। তাদের অনেককেই এসব দেয়ালের মধ্যে সমাহিত করা হয়েছে। তাই বিশ্বের সবচেয়ে এই দীর্ঘ স্থাপনা সবচেয়ে দীর্ঘ মানব সমাধি নামেও পরিচিত।
কয়েক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে নির্মিত বিভিন্ন স্থানের প্রাচীরের দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬ কিলোমিটার। যা পৃথিবীর বিষুবরেখার দৈর্ঘ্যের অর্ধেকেরও চেয়েও বেশি। পৃথিবীর বিষুবরেখার দৈর্ঘ্য হলো ৪০ হাজার কিলোমিটার। এই প্রাচীরের গড় উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা প্রায় ৪৬ ফুট। ভৌগোলিকভাবে প্রাচীরের অবস্থানের উচ্চতার বেশ তারতম্য রয়েছে কারণ বিভিন্ন উঁচু নিচু অঞ্চল মিলে প্রাচীরগুলো তৈরি করা হয়েছে।
এই প্রাচীরগুলো সর্বনিম্ন অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ বরাবর এবং সর্বোচ্চ অবস্থান ৪৭২২ ফুট। চীনের মহাপ্রাচীরের গড় প্রস্থ প্রায় ২১.৫ ফুট। একদিকে তিব্বত অন্যদিকে চীন সাগরের মতো প্রাকৃতিক বাধা দীর্ঘদিন চীনকে বাইরের আক্রমণ থেকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু চীনের উত্তর দিকটা ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। তাই উত্তরের হান উপজাতিদের বিরুদ্ধে প্রথম স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে এই দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল।
শত্রুদের প্রতিহত করতে এটি অত্যন্ত কার্যকরী ব্যবস্থা হিসেবে দেখা দেয়। কিন্তু সবসময়ে এই প্রাচীর চীনের বহু শত্রুদের আক্রমণ আটকাতে পারেনি। এই দেয়াল বহু ছোটখাটো আক্রমণ আটকাতে পারলেও চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলীয় বাহিনী তের শতকে মহাপ্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিল। যাদেরকে আটকাতে এই প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল তারাই পরবর্তী ১০০ বছর এই প্রাচীরের নিয়ন্ত্রণ করে। দেয়ালটিতে নিয়মিত বিরতিতে পর্যবেক্ষণ চৌকি রয়েছে। এসব চৌকি অস্ত্র সংরক্ষণ, সেনাবাহিনীর আবাসন এবং ধোঁয়ার সংকেত প্রদানের কাজে ব্যবহৃত হতো।
অবাক করা অজানা তথ্য
- বলা হয়ে থাকে, খালি চোখে মহাকাশ থেকে মহাপ্রাচীর দেখা যায় না। যদিও নাসা রিপোর্ট করেছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তোলা ফটোগ্রাফগুলি আদর্শ পরিস্থিতিতে দেওয়ালের অংশগুলিকে চিত্রিত করেছে৷ রাডার ইমেজ ব্যবহার করে মহাকাশ থেকে প্রাচীর পরিষ্কারভাবে ছবি তোলা যায়।
- মহাপ্রাচীরটির প্রায় ১/৩ অংশ কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেছে।
- মহাপ্রাচীর ইট বাঁধতে আঠালো চালের আটা ব্যবহার করা হতো।
- আর্সেনিক ব্যবহার করা হয় বলে মহাপ্রাচীর বিষাক্ত।
- মহাপ্রাচীরে বড় মাপের যুদ্ধ খুব কমই হয়েছিল।
- মহাপ্রাচীরে লেখার অনুমতি ছিল না। কিন্তু মিং রাজবংশের প্রতিটি ইটে শ্রমিকের নাম এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বের তারিখ দিয়ে খোদাই করা হতো।
মহাপ্রাচীরের বর্তমান ৬টি তথ্য
- বর্তমানে মহাপ্রাচীরের অংশ ১৫টি প্রদেশ জুড়ে রয়েছে: জিনজিয়াং, ইনার মঙ্গোলিয়া, গানসু, কিংহাই, নিংজিয়া, শানসি, শানসি, হেবেই, বেইজিং, তিয়ানজিন, লিয়াওনিং, জিলিন, হেনান, হেইলংজিয়াং এবং শানডং।
- গ্রেট ওয়ালের সবচেয়ে বেশি পরিদর্শন করা অংশগুলি বেইজিংয়ের আশেপাশে। কিন্তু দৈর্ঘ্য এবং সাইটের দিক থেকে অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ায় সর্বাধিক অংশ রয়েছে।
- ১৯৫৭ সালে বাদালিং-এর মাধ্যমে মহান প্রাচীর পুনর্নির্মাণ ও সুরক্ষা শুরু হয়। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে, এই মহাপ্রাচীর ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়।
- ২০০৭ সালে চীনের মহাপ্রাচীরকে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি ঘোষণা করা হয়।
- সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কালে (১৯৬৬- ১৯৭৬) বাড়ি, খামার বা জলাধার নির্মাণে মহাপ্রাচীরের অনেক ইট ব্যবহার করা হয়েছিল।
- ৪৪৩১টিরও বেশি ট্রেডমার্কের নাম মহাপ্রাচীরের নামে রাখা হয়েছিল: গ্রেট ওয়াল হোটেল, গ্রেট ওয়াল মোটরস ইত্যাদি।
মহাপ্রাচীর পরিদর্শনের সেরা সময়
বেইজিংয়ের কাছাকাছি প্রাচীরের সমস্ত অংশে ভ্রমনের জন্য বসন্তের মাসগুলি (এপ্রিল থেকে জুন) দুর্দান্ত। এপ্রিলের শেষের দিকে থেকে মে মাসের প্রথম দিকে, অনেক গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে, যা প্রাচীরকে অনেক সুন্দর করে তোলে। শরৎকালও পরিদর্শনের জন্যও একটি চমৎকার সময়, কারণ তখন তাপমাত্রা সাধারণত আরামদায়ক হয়।
অক্টোবর থেকে নভেম্বরের শুরুর দিকে বিশেষভাবে মনোরম, কারণ পাহাড়ে গাছের পাতার রং পরিবর্তন হতে শুরু করে। শীতের মাসগুলি, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ঠান্ডা থাকে এবং বাতাস হতে পারে। তবে সাধারণত এই মাসগুলিতে প্রাচীরে পর্যটকদের সংখ্যা অনেক কম থাকে। জুলাই এবং আগস্ট গরম এবং আর্দ্র, এবং তখন দীর্ঘ পর্বতারোহণের জন্য নিরাপদ নয়।
প্রতি বছর, দশ মিলিয়নেরও বেশি লোক চীনের মহাপ্রাচীরে ভিড় করে। যা এটিকে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণে পরিণত করেছে। ২০১৩ সালে, ১০,৭২০,০০০ পর্যটক প্রাচীরের বাদালিং এবং মুতিয়ান্যু এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন।
Feature Image: wallpaperflare.com References: