যুদ্ধ অনেকভাবেই হয়। কখনো সরাসরি সামরিকভাবে আবার এখন তো অর্থনৈতিকভাবেও দেখা যায়। কিন্তু আরেক ধরণের যুদ্ধ আছে যেটা আসলে সবসময়ই অব্যাহত থাকে। এই যুদ্ধ শত্রুরাষ্ট্রের সাথে অথবা বন্ধু রাষ্ট্রের কিংবা দুই পক্ষের সাথেই হয় বলা চলে।
প্রথমটি নিশ্চিত বিপদ বা ক্ষতি এড়াতে এবং পরবর্তীটি আকস্মিক ক্ষতি এড়াতে হয়ে থাকে। সব দেশেই এই যুদ্ধ বিদ্যমান। তবে সেটা সরাসরি দেখা যায় না। এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম গোয়েন্দাগিরি বা গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কে। যাকে আবার এসপিওনাজও বলে থাকি।
নেটফ্লিক্স বা হলিউডের মুভি, সব জায়াগায়তেই আমরা গোয়েন্দা সম্পর্কিত কাহিনী দেখে থাকি। ‘ব্রিজ অফ স্পাই’ বলুন আবার ‘দি লাইফ অফ আদার্স’ নামক চলচিত্রের কথা বলুন সব জায়গায় গুপ্তচরবৃত্তিকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদি বলি এই নেটফ্লিক্স বা হলিউডের ঘটনার বাস্তবতা অর্ধশত বছরেরও বেশি পূর্বে ঘটে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল! তাক লাগানো সেই ব্যক্তিটি হলেন ইসরায়েলি মিলিটারি এজেন্সি মোসাদের গুপ্তচর এলি কোহেন।
ইহুদিদের উপর আরব দেশগুলো পূর্বের থেকেই অত্যাচারের খবর বিরাজমান ছিল। এই অবস্থায় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্ম নেয় ইহুদি বংশোদ্ভূত এলি কোহেন। তার শৈশবের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তৎকালীন মুসলিম ব্রাদারহুডের অত্যাচারে জায়োনিজমের প্রতি তার আকর্ষণ বাড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যখন জার্মানি থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা ফিলিস্তিনে তাদের আবাস গড়ে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র তৈরি করে তার কয়েক বছরের মধ্যে এলি কোহেনের সম্পূর্ণ পরিবার মিশর ছেড়ে ইসরায়েলে পাড়ি দেয়। যদিও কোহেন নিজ পড়ালেখার তাগিদে মিশরেই থেকে যান।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, মুসলিম ব্রাদারহুডের এই আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে কোহেন মিশরীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি মিশরীয় ইহুদিদের ইসরায়েলে অভিবাসিত করার ক্ষেত্রে কাজ করেন। এক পর্যায়ে মিলিটারির তার উপর সন্দেহ হলেও কোন ধরণের প্রমাণ না দেখাতে পারায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এটির মাধ্যমে কোহেনের গুপ্তচরবৃত্তির দক্ষতার একটি আঁচ পাওয়া যায়।
সে যাই হোক, ইহুদি এজেন্সির সহায়তায় এলি কোহেন ইসরায়েলে চলে যান। অনেক আগের থেকেই তার মোসাদের হয়ে কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও দুইবার প্রত্যাখ্যান হয়েছিলেন ইতিমধ্যেই। ১৯৫৭ সালের দিকে তিনি মিলিটারি ইন্টিলিজেন্সে যোগ দেন এবং কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স এনালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। এত ভালো ক্যারিয়ার থাকা সত্ত্বেও তিনি গুপ্তচরবৃত্তির নেশা ছাড়তে পারেননি। অতিষ্ঠ হয়ে যোগ দেন একটি ইন্সুরেন্স অফিসে।
পৃথিবীর সেরা গুপ্তচরের উত্থান
ইসরায়েলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক দা-কুমড়া হওয়ায় ইসরায়েলের প্রয়োজন ছিল আরব রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে সিরিয়ার গোপন তথ্য সম্পর্কে অবগত হওয়া। কেননা তখনকার সময়ে গোলান মালভূমি সিরিয়ার দখলে ছিল এবং জর্ডান নদীর ত্রিশ শতাংশ পানি সেখান থেকেই ইসরায়েলে প্রবেশ করতো। এতে করে ইসরায়েলের নিজ স্বার্থের জন্য সিরিয়াকে নজরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
এমতাবস্থায় মোসাদের প্রধান হঠাৎ একসময় প্রত্যাখ্যান হওয়া সদস্যদের তালিকায় এলি কোহেনের দিকে মনোযোগ দেন। দেখা যায়, এলি কোহেন দেখতে আরবদের মতো এবং আরবি ভাষার বিভিন্ন ধরণ সম্পর্কেও বেশ দক্ষ। শুরু হয় মোসাদে এলি কোহেনের যাত্রা।
ছয় মাস ট্রেনিং দেওয়ার পর এলি কোহেনকে সিরিয়ার একজন ব্যবসায়ী হিসেবে মিথ্যা পরিচিতি দেওয়া হয়। তার নাম দেওয়া হয় আলিয়াস কামেল আমিন থাবেট। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোহেন তথা থাবেট আর্জেন্টিনা ফেরত একজন সিরিয়ান ব্যবসায়ী। তাই মিশনের শুরুতেই কোহেন আর্জেন্টিনায় পাড়ি জমান।
সেখানে গিয়ে তিনি পরিপূর্ণ ব্যবসায়ীর রুপ ধারণ করেন। আস্তে আস্তে তিনি আর্জেন্টিনাস্ত সিরিয়ান অ্যাম্বাসির সদস্যদের সাথেও খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাসার আল আসাদের পিতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট আমান আল হাফেজ।
কোহেন সবার সাথে এমন আচরণ করেন যাতে করে সবাই তার প্রতি মুগ্ধ হয়। তিনি সিরিয়ান কূটনীতি, নেতা সবাইকে অনেক উপহার দিতেন। এতে করে তিনি সবার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে যান রাতারাতি।
তৎকালীন সিরিয়ার ক্ষমতা নেওয়ার জন্য বা’থ পার্টির নেতা আমান আল হাফেজসহ সম্পূর্ণ পার্টিকে কোহেন ফান্ডিং প্রদান করেন।
বলাই বাহুল্য, বা’থ পার্টি ক্ষমতায় আসার পর কোহেন সবকিছুর প্রবেশাধিকার পেয়ে যান। ১৯৬৩ সালে তিনি সিরিয়ার দামেস্কে গিয়ে মোসাদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করতে থাকেন।
এক সময় কোহেন অর্থাৎ কামেল আমিন থাবেট সিরিয়ার ডিফেন্স মিনিস্টারেরে চিফ এডাভাইজারের পদও লাভ করেন তার চৌকশ বুদ্ধিমত্তার কারণে।
দামেস্কে তার বাড়িটি বাইরে থেকে সুসজ্জিত লাগলেও ভেতরে ছিল রেডিও ট্রান্সমিটারসহ আরো নানা যন্ত্রপাতি যার দ্বারা মোসাদকে তথ্য পাঠাতেন। কখনো গোপন চিঠি, কখনো রেডিও বার্তা-এসবের মাধ্যমে তার তথ্য ইসরায়েলে যেতো।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, গোলান মালভূমি নিয়ে সিরিয়া এবং ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব ছিল তুঙ্গে। তার সাথে সাথে ছোট খাটো অনেক যুদ্ধই তাদের সাথে হরহামেশা লেগেই থাকতো।
দেখা যেত প্রায় সব যুদ্ধই ইসরায়েলে অনুকূলে থাকতো। এর মূল কারণ সুপার স্পাই এলি কোহেন। সব যুদ্ধের পূর্বেই তিনি তথ্য পৌঁছে দিতেন। যার কারণে পূর্ব সতর্কতার সহিত ইসরায়েল নতুন পরিকল্পনা সাজাতো।
কোহেন খবর পান যে, ইসরায়েলের পানির অন্যতম উৎস জর্ডান নদীর পানির গতিপথ বদলে দেয়া হবে। এটি ইসরায়েলকে জানালে সিরিয়ার সেই চেষ্টাও বিফলে যায়। এক কথায় কোহেন সিরিয়া সরকারের মিলিটারি বেইস, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সবকিছুর অন্তরে প্রবেশ করে ফেলেন।
এমনকি গোলান মালভূমির কোথায় কোন অস্ত্র, ফাঁদ এবং সৈন্যরা আছে সবকিছুই তিনি জানতেন। আর পাশাপাশি ইসরায়েলকে জানাতেন। কেননা তার দেওয়া ফান্ডের দরুণ গোলান মালভূমিতে ইউক্যালিপ্টাস গাছ লাগানো হয়।
কোহেন সিরিয়ান সরকারকে এই গাছ লাগানোর পরিকল্পনা দেন যাতে করে সৈন্যরা কৌশল অবলম্বন করতে পারেন। তবে, এর পেছনে ছিল অন্য এক মাস্টার প্ল্যান। যেই যেই স্থানে গাছ লাগানো হয়েছিল সেগুলো সব ছিল সিরিয়ান আর্মির অস্ত্র এবং ফাঁদ পাতার স্থান।
গোলান মালভূমির এই গাছগুলো পরবর্তীতে জায়োনিস্টদের রাষ্ট্র ইসরায়েলকে বাঁচিয়েছে তা বলার অবকাশ রাখে না। তবে সিরিয়ার এমন অবস্থায় তাদের টনক নড়ে। তারা বুঝতে পারে যে সিরিয়ার কেউই ইসরায়েলকে বার্তা দিচ্ছে। তাই তারা দেশের বাইরে ট্রান্সমিট হওয়া রেডিও ট্র্যাক করে এবং দেখতে পায় যে কোহেনের সাথে ইসরায়েলের এক গভীর সম্পর্ক আছে।
কোহেনকে পূর্বের থেকেই বলা হয়েছিল যে রেডিও অতি মাত্রায় ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে। কিন্তু কোহেন অনেক বেশি আত্নবিশ্বাসী ছিল তার সফলতার কারণে। যদিও শেষবার সিরিয়ায় আসার পূর্বে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গুপ্তচরবৃত্তি ছেড়ে দিবেন। কিন্ত সেটি আর ছাড়া হয়নি।
সিরিয়ান কর্তৃপক্ষ কোহেনকে জিম্মায় নিলে ইসরায়েল, আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডাসহ অনেক দেশই মার্সি পিটিশন জানায়। তবে সিরিয়া তা আমলে না নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসের আঠারো তারিখে জনসম্মুখে ফাঁসি দেয়। এমনকি তারা কোহেনের মৃতদেহটিও তার পরিবারকে দেয়নি। ২০১৮ সালে কোহেনের ব্যবহৃত ঘড়ি পাওয়া গেলেও তার কবর কোথায় আছে তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।
ইসরায়েলের ত্রাণকর্তা!
আরব ইসরায়েলের ছয়দিনের যুদ্ধের কথা অন্যতম এক ঘটনা। বলা হয়ে থাকে এই যুদ্ধের সময় কোহেন এই দুনিয়ায় না থাকলেও তার কর্ম সেখানে ছিল। গোলান মালভূমিতে কোহেনের লাগানো সেই ইউক্যালিপ্টাস গাছ যা এক প্রকার মানচিত্র ছিল সেখানেই ইসরায়েলের বাহিনী বোম্বিং করে। এতে করে ধুলিসাৎ হয়ে যায় সিরিয়ার ডিফেন্স। মাত্র ছয়দিনে ইসরায়েলের নিকট হার মানতে বাধ্য হয় আরব বাহিনী।
কোহেনকে ইসরায়েলীয়রা জাতীয় বীর মনে করলেও সিরিয়ানরা তার ঠিক উলটো আখ্যা দেয়। কোহেনের নামে আজ বর্তমান ইসরায়েলে অনেক সমাধি, সড়ক হয়েছে। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সের ‘দ্য স্পাই’ সিরিজটিও কোহেনের জীবন অনুসারেই।
Feature Image: The Jewish Press References: 01. Biography Of Eli Cohen. 02. Eli Cohen: Israel’s Greatest Spy. 03. The Spy who saved Israel. 04. Eli Cohen Israeli spy. 05. The True Story Behind the Netflix Series The Spy. 06. Eli Cohen: The Mossad’s Master Spy.