বর্তমান সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবন হয়ে উঠেছে আরামপ্রিয়। তাই সাধ্যের মধ্যে পথচলার ক্ষেত্রে গাড়িই একমাত্র ভরসা। ব্যস্ততম এই জীবনযাত্রায় আমরা ঘর থেকে বের হলেই দেখতে পাই নানান ব্র্যান্ডের নামীদামী সব গাড়ি। কিন্তু রাস্তায় বের হলে হলে যে ব্র্যান্ডের গাড়িটি বেশি চোখে পড়বে তা হলো টয়োটা ব্র্যান্ড।
কারণ গাড়ির ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড হলো টয়োটা। জনপ্রিয় কার কোম্পানি টয়োটার নাম শুনলেও এর জনপ্রিয়তা পেছনের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা ঠিক কয়জনই বা জানি। তাই আজকের আলোচনায় থাকছে টয়োটার আজকের অবস্থানে উঠে আসার গল্প।
জনপ্রিয় কার মেকিং কোম্পানি টয়োটার প্রতিষ্ঠা ইতিহাস বেশ পুরনো। কারণ টয়োটার যাত্রাই শুরু হয় ১৯৩৩ সালে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তারা এনেছে মানুষের চলাচলের জন্য অজস্র সব গাড়ি, গড়েছে একের পর এর এক ইতিহাস।
টয়োটার যাত্রা শুরু হয় সাকিচি টয়োডার হাত ধরে। সামান্য কৃষকের এর পরিবারে জন্ম হলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাপানের একজন বিখ্যাত উদ্ভাবকরূপে। জাপানের শিল্পক্ষেত্রে ছিল এই উদ্যোক্তার অবাধ বিচরণ। আর তারই হাত ধরে টয়োটার পথচলা শুরু হয়।
টয়োটার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়ে মধ্যে অন্যতম ছিল Toyoda Automatic Loom Works. যার যাত্রা শুরু হয় ১৯২৬ সালে। এটি মূলত একটি তাঁতশিল্প কোম্পানি ছিল যা পরিচালনার জন্য তিনি নানান ধরণের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলেন।
তার সহকর্মীরা তার এই গুণের জন্য তাকে ডাকতেন জাপানের ‘থমাস আলভা এডিসন’ বলে। উদ্ভাবনের প্রতিভাটা তার মাঝে ছিল বাবার মতোই। তা না হলে তো গাড়ির ব্যবসায় আসার মতো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তে তিনি আসতেন না, যেই সিদ্ধান্তটি পাল্টে দিয়েছিল বিংশ শতকের ইতিহাস!
সাকিচির টয়োটাকে তখন টেক্সটাইল ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর কর্ম থেকে অবসান নেন। পরবর্তীতে তার ছেলে কিচিরো টয়োটা টেক্সটাইল শিল্প থেকে তা গাড়ি শিল্পে স্থানান্তরিত করেন। তার ভাইয়ের সাথে মিলে তাঁত শিল্প থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এসে তারা মনোনিবেশ করে গাড়ি শিল্পের দিকে।
গাড়ি শিল্পের বিস্তৃতি এবং আশেপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কিচিরো টয়োডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাজার পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে ১৯৩০ সালের দিকে গ্যাসোলিন চালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করে গাড়ি তৈরির উদ্দেশ্যে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু চীন-জাপান যুদ্ধ চলাকালীন সময়কে কেন্দ্র করে জাপান সরকারও তখন নিজেদের গাড়ি উৎপাদন শুরু করতে চেয়েছিল।
৪ বছর গবেষণার পর ঠিক ১৯৩৪ সালে টয়োডা তাদের তৈরি গাড়িতে ব্যবহারের জন্য টাইপ এ ইঞ্জিনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে টয়োডার প্রথম গাড়ি এ ওয়ান (A1) এ এই ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। পরের বছর গাড়িগুলো অসাধারণ পারফরমেন্স এএ (AA) আবিষ্কার করে তারা গাড়ি বাজারে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল।
টয়োডার এই সাফল্য দেখে তা আলাদা কোম্পানি হিসেবে ‘টয়োটা’ নামে সামনে নিয়ে আসা হয়। টয়োটা নামটি আসলে টয়োডা নামের একটি প্রকরণ। টয়োডা মানে ‘উর্বর ভাতের প্যাটি’ বিশেষ; আবার টয়োডা ছিল কিচিরোদের বংশীয় নাম। কিন্তু অটোমোবাইল গাড়ি কোম্পানির নাম যেন কৃষি জাতীয় না হয় সেজন্য টয়োটা নামটা রাখা হয়।
এছাড়াও, জাপানি বর্ণমালায় টয়োডা লিখতে দশটি স্ট্রোক লাগে। যেখানে টয়োটার প্রয়োজন মাত্র আটটি স্ট্রোক। শুধু যে লেখায় সহজ তা কিন্তু নয়। আট জাপানের একটি ভাগ্যবান সংখ্যা। আর তাই নামের এই পরিবর্তনটি শুভ বলে মনে করা হয়েছিল। সেই থেকেই টয়োটা বিশ্বব্যাপী রাজত্ব করে চলেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী বাহিনীদের জন্য ট্রাক বানাতো টয়োটা। কিন্তু অর্থনীতির দুরবস্থা থাকার জন্য সাদামাটাভাবে ট্রাক তৈরি করতে হতো। পরবর্তীতে যুদ্ধের অবসান হলে অর্থনীতির অবস্থা আরও নাজেহাল হয়। তারা সাধারণ মানুষদের জন্য ১৯৪৭ সালে এসএ গাড়ি তৈরি করার পরও তেমন আশার আলো দেখতে পায়নি বিধায় ১৯৪৯ সালে দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা জাগে। যা পরবর্তীতে ব্যাংক ঋণের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে তাদের সাহায্য করে।
পরের বছর ৩০০টি ট্রাক বানিয়ে নিজেদের ব্যবসায়ের লালবাতি জ্বালায় প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কর্মী ছাটাই-এর কারণে ১৯৫০ সালে শ্রমিক আন্দোলন হলেও উক্ত আন্দোলন বেশ ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় কোম্পানিটি।
একই বছর টয়োটার সিইও কিচিরো অবসর নেন তার দায়িত্ব থেকে। আর তার স্থলে টয়োটার লুম কোম্পানির সিইও ইশিদা টয়োটার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি দায়িত্বে আসার পর কোরিয়ান যুদ্ধে মার্কিন মিলিটারি কর্তৃক ৫ হাজার ট্রাকের অর্ডার পাওয়ার মধ্য দিয়ে মরতে বসতে থাকা কোম্পানিটির চাকা সচল হয়।
তার অধীনেই ১৯৫৭ সালে প্রথম মার্কিন ও ব্রাজিলে জাপানী গাড়ি রপ্তানি করা হয়। তার মধ্য দিয়ে এই দেশগুলোতে টয়োটার শাখা স্থাপন হয়। যথাক্রমে মার্কিন মুলুকের শাখাটির নাম ছিল Toyota Motor Sales Incorporation এবং ব্রাজিলীয় শাখার নাম ছিল Toyota Do Brasil SA.
এছাড়াও, ইশিদার সময়ে ১৯৫৯ সালে টয়োটার অটোমোবাইল প্লান্ট নির্মাণ করেন মোতামাচিতে যা ষাটের দশকে নিশানের চেয়ে টয়োটাকে গাড়ি বিক্রির গতি বৃদ্ধি করতে সক্ষম করে। জাপান, আমেরিকা, ব্রাজিলের পর থাইল্যান্ডে গাড়ি রপ্তানি করে টয়োটা। তারপর জাপানের ডেমিং পুরষ্কার জেতার পর নিজেদের ব্যপ্তি ও বিস্তৃতির লক্ষ্যে Hino ও Dihastra এর সাথে চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৬২ সালে ফিনল্যান্ডে বিস্তৃতি গড়ে টয়োটা। ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল অবধি জাপানকে বাইরের মার্কিন মুলুক ছাড়িয়ে টয়োটার বেশ বড় একটি বাজার হয় অস্ট্রেলিয়াতে। এরপর ইউরোপে ফিরে টয়োটা। ১৯৬৮ সালে পর্তুগালে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়।
ষাটের দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়িটি নির্মাণ করে টয়োটা। আর সেটার নাম ছিল ‘টয়োটা করোলা’। যা পারিবারিক উপযোগিতাকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হলেও ২০১৩ সাল অবধি প্রায় ৪০ মিলিয়ন টয়োটা করোলা বিক্রি করা হয়েছে। টয়োটার আরেকটি জনপ্রিয় গাড়ি হলো ‘ল্যান্ড ক্রুজার’। যা এখন পর্যন্ত বেশ আলোড়ন সৃষ্টিকারী গাড়ি হিসেবে পরিচিত।
ষাটের দশকের মধ্যে টয়োটার সাফল্যের গল্পটি চার থেকে পাঁচ দশক পর্যন্ত অক্ষত থাকে। যার ফলশ্রুতিতে তারা অর্জন করে খ্যাতনামা সকল পুরস্কার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাপানিজ কোয়ালিটি কন্ট্রোল অ্যাওয়ার্ড; যার মধ্যে দিয়ে তাদের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
আশির দশকের তুমুল সফলতা অর্জনের পর নব্বই দশকে টয়োটা বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণ-এর পরিকল্পনা করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো পিক-আপ, এসইউভি, টি-ওয়ান হান্ড্রেড এর মতো গাড়ির সাফল্যের ধারা স্পোর্টস-কার নির্মাণেও অব্যাহত ছিল।
ঠিক ২০০২ সালের দিকে তারা নিজেদের নাম লেখান ফর্মুলা ওয়ান কার নির্মাণে। যার পরিক্রমায় তারা ফ্রান্সের দুটি কোম্পানির সাথেও চুক্তি করে। এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ফোর্বস-এর ২০০৫ সালের জনপ্রিয়তার কাতারে ৮ নম্বর স্থান দখল করে টয়োটা। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে গাড়ি বিক্রির দিক দিয়ে শীর্ষস্থানে অবস্থান ছিল টয়োটা।
কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দা টয়োটার বিক্রির গতিকে বেশ হ্রাস করে দেয়। আবার ২০১১ সালের দিকের জাপানে বিদ্যমান সুনামি বেশ বড় আঘাত হানে গাড়ি শিল্পে। আবার থাইল্যান্ড জুড়ে প্রবল বন্যা স্থবির করে দেয় টয়োটার গতি।
কিন্তু পুনরায় টয়োটা আবার নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। ২০১৪ সাল থেকে টয়োটার যাত্রা অব্যাহত থাকে। এই অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পথিকৃৎ ছিল প্রিয়াস। ১৯৯৭ সালে তৈরি করা এই গাড়িটি যুক্তরাষ্ট্রসহ ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিক্রির ক্ষেত্রে ৬১ লক্ষ্য গাড়িটির সংখ্যা ছাড়িয়েছে।
ঠিক ২০১৪ সালের দিকে পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোজেন ফুয়েল গ্যাসচালিত গাড়ি নির্মাণ করে টয়োটা। যা চারিদিকে ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দেয়। ২০১৫ সালে টয়োটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিকস গবেষণায় বিনিয়োগ করেছে এবং সেই সাথে উবার-এর সঙ্গে বিনিয়োগ করে নিজেদের বিদ্যমান ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করেছে। ২০১৮ সালের দিকে টয়োটা অটোমোবাইল শিল্পে বিনিয়োগ করে। যা সকল স্তরের মানুষের জন্য টার্ন্সপোর্ট সুবিধা পাওয়া নিয়ে চুক্তিটি সম্প্রসারণ করা হয়।
Feature Image: wallpaperaccess.com References: 01. History of Toyota. 02. History of Toyota. 03. Toyota Motor Corporation.