টেরাকোটা আর্মি: বিশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময়

706
0
টেরাকোটা আর্মি,Image source:smithsonianmag.com

টেরাকোটা আর্মি, ১৯৭৪ সালের আগে এরকম নাম হয়ত কেউ শোনেনি। কারণ ১৯৭৪ সালে চীনে প্রথম এরকম জিনিসের খোঁজ পাওয়া যায়। অথচ যা নির্মিত হয়েছিল দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। টেরাকোটা আর্মি মানে হলো পোড়ামাটির তৈরি সৈন্য। এই টেরাকোটা আর্মি পরকালে মৃত সম্রাটকে সেবা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। 

চীনের প্রথম সম্রাটের সমাধির সাথে এদের রাখা হয়েছিল। এই স্থানটি আবিষ্কারের পর দেখা যায় সেখানে হাজার হাজার পোড়ামাটির সৈনিক মডেল রয়েছে যা প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াংদির সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে। কারণ শি হুয়াং অমরত্বের জন্য মরিয়া ছিলেন। 

বিশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময় এই টেরাকোটা আর্মি। চীনের মধ্যাঞ্চলের শানসি প্রদেশের জিয়ান অঞ্চলের লিনটাং-এর কাছে  খোঁজ মেলার পর এই স্থানটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক মিউজিয়াম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সমাধিটি এখনও খনন করা না হলেও সমাধির স্থানটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। 

View of the terracotta army (source of image: AMNA)
বিশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময় টেরাকোটা আর্মি, Image source:archaeology.wiki

টেরাকোটা আর্মিদের সম্রাট কিন শি হুয়াং 

সম্রাট হওয়ার আগে কিন শি হুয়াং-এর নাম ছিল ইং ঝেং বা ঝাও ঝেং। তার পিতা মারা যাওয়ার পরে মাত্র ১৩ বছর বয়সে যখন তিনি কিন রাজ্যের রাজা হোন, তখন তাকে কিন ওয়াং ঝেং বলা হতো। তার জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৫৯ সালে। কিন শি ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিচ্ছিন্ন চীনকে একীভূত করেছিলেন এবং কিন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

তিনি ২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যু পর্যন্ত চীনের প্রথম সম্রাট হিসেবে শাসন করেছিলেন। তিনি নিজেকে শি হুয়াংদি বলে অভিহিত করেছিলেন তাই জনগণের কাছে তিনি কিন শি হুয়াং বা ‘কিনের প্রথম সম্রাট’ বলে পরিচিত পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয় তার নামানুসারেই চীনের নামকরণ হয়। কারণ সম্রাট কিন শি হুয়াং এর নামের উচ্চারণ ‘সিন’ বা ‘চিন’ও হতো। 

তার ৩৬ বছরের শাসনামলে তিনি অসংখ্য মহৎ এবং বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প তৈরি করেন। কিন শি হুয়াং স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তার শাসনামল ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু ঘটনাবহুল, আর এসব ঘটনার বেশিরভাগই ছিল নেতিবাচক। 

তার শাসনামলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বেশ কিছু আবিষ্কার, সংস্কার ও পদ্ধতি চালু করেছিলেন যার জন্য কিন রাজবংশ ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছিল। তিনি মুদ্রা ব্যবস্থাকে একীভূত করেছিলেন, সারা দেশে ওজন, ক্ষমতা এবং দৈর্ঘ্যের একক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন, আইনের একটি কোড সংকলন করেছিলেন এবং একটি একক লিখন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমগ্র দেশের জন্য। 

তবে শি হুয়াং চরম মাত্রার ফেটিসিজম এবং আদিম কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রায়শই বিভিন্ন ধরণের মন্ত্র, জাদুবিদ্যার আশ্রয় নিতেন এবং এসবের অনুসন্ধানে প্রচুর সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতেন। তিনি মৃত্যুভয়ে সর্বদা শংকিত ছিলেন। এজন্য মৃত্যু থেকে বাঁচতে তথা অমরত্ব লাভের জন্য রাজত্বের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছিলেন। 

কিন্ত তিনি জীবদ্দশায় অমরত্ব লাভ করার অনেক পথ খুঁজলেও সফল হননি। তাই মৃত্যুর পর যেন নিজের সমাধিকে পাহারা দেওয়া যায় এবং এরকম রাজার মতো জীবনযাপন করা যায় সেই উদ্দেশ্যেই বিশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময় এই টেরাকোটা আর্মি নির্মাণ করেছিলেন।  

QinShiHuang19century.jpg
কিন শি হুয়াং , image source: wikimedia.org

কিন শি হুয়াংয়ের সমাধি 

সম্রাট কিন শি হুয়াং নিজের সমাধির জায়গা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। তিনি এমন জায়গা নির্বাচন করেন যার আশেপাশে ছিল স্বর্ণ ও মূল্যবান পাথরের খনি। ১৯৭৪ সালে যখন এই টেরাকোটা আর্মির সন্ধান মেলে তখন থেকে এই পর্যন্ত সম্রাটের আসল সমাধি এখনও অনাবিষ্কৃত রয়েছে।  

ধারণা করা হয় সমাধিতে প্রচুর মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। আরও জানা যায় শি হুয়াংয়ের উপপত্নীদের এবং অনেক কারিগর ও শ্রমিকদেরকেও জ্যান্ত অবস্থায় মৃত সম্রাটের সাথে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, যাতে তার সমাধিস্থ মূল্যবান সামগ্রী যেন চিরকালের জন্য গোপন থাকে।  

হান বংশীয় ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ান (১৪৫-৮৭ খ্রিস্টপূর্ব) শি হুয়াংদির সমাধির ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সমাধিটি প্রায় ৩৫-৬০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে। মূল সমাধিটি একটি অভ্যন্তরীণ প্রাচীরের মধ্যে চার-পার্শ্বযুক্ত পিরামিডের মতো ঢিবির নীচে অবস্থিত। সমাধিটি এমন একটি সুবিশাল ভূগর্ভস্থ প্রাসাদের সমান যা সম্পূর্ণ করতে ৩৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় ৭ লক্ষ শ্রমিককে নিয়োগ করা হয়েছিল।  

এখানে শ্রমিকরা কৃত্রিম নদী, সাগর ও স্রোত তৈরি করেছিল যাতে পারদের প্রবাহ ঢেলে দিয়েছিল। এছাড়া সমাধির ছাদের সিলিংয়ে চকচকে মুক্তো চাঁদ, তারা, সূর্যের ছবিসহ মহাকাশের দৃশ্যপট তৈরি করা হয়েছিল এবং মেঝেতে সোনা-রূপার পাখির মূর্তি ও জেড পাথরের খোদাই করা পাইন গাছের সাথে পৃথিবীর মানচিত্র আঁকা হয়েছিল। সম্রাট কারিগরদের যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্রসবো তৈরি করার নির্দেশ দেন। এতে করে যে কেউ তাদের সামনে দিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে। এমনকি তিমির তেল ব্যবহার করে বাতি জ্বালানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে বাতিগুলো দীর্ঘক্ষণ ধরে জ্বলতে পারে। 

তবে নিশ্চিতভাবে এখনও জানা যায়নি যে সমাধির নীচে কী কী রয়েছে। কারণ তা খনন করতে গিয়ে যদি কিছু কিছু নিদর্শন দ্রুত ভেঙে যায় বা চুরি হয়ে যায় সেজন্য আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই সমাধির সাইটটির খনন থেকে দূরে রয়েছেন।  

How much mercury was poured into the mausoleum of Qin Shihuang?Let us understand - iNEWS
কিন শি হুয়াংয়ের সমাধি, Image source:inf.news  

যেভাবে আবিষ্কার হয়েছিল?  

টেরাকোটা আর্মি ২০০০ বছরেরও বেশি সময় পরে আধুনিক সভ্যতার কাছে প্রকাশিত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম চীনের শানসি প্রদেশের লিনটাং এর কাছে ১৯৭৪ সালের মার্চে একদল কৃষক শক্ত মাটিতে সেচের জন্য কূপ খনন করতে গিয়ে এই টেরাকোটা আর্মির কিছু অংশের সন্ধান পান। পরবর্তীতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই জায়গাটি খনন করেন এবং আশেপাশে আরও জায়গা খনন করে প্রায় ৮,০০০ টেরাকোটা সৈন্যবাহিনী আবিষ্কার করেন। 

আবিষ্কৃত টেরাকোটা আর্মি সাইটের প্রথম অংশটির নাম ভল্ট বা পিট ওয়ান। ১৯৭৬ সালে আরও দুটি ভল্ট প্রায় ২০ মিটার দূরে উন্মোচিত হয়েছিল এবং তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল ভল্ট/পিট টু এবং ভল্ট/পিট থ্রি। প্রত্নতাত্ত্বিকরা খনন করে টেরাকোটা সৈন্যদের সাথে শি হুয়াং এর সমাধিও খুঁজে পান। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এসব সৈন্য মূর্তিগুলো অনেক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তৈরি করা হয়েছে।  

তাছাড়া একটি মূর্তির মুখাবয়বের সাথে আরেকটি মূর্তির মুখাবয়বের কোন মিল নেই। প্রত্যেকের চেহারাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এছাড়াও এখানে অনেক ধাতব অস্ত্র ও প্রাণীর মূর্তি পাওয়া গেছে। তবে পুরো সমাধি ও টেরাকোটার আবিষ্কার এখনও বাকি আছে। প্রাচীন এসব নিদর্শন আবিষ্কার করতে গিয়ে যেন ভেঙে না যায় তাই সতর্কতার জন্য এখনও আবিষ্কারের কাজ বাকি আছে। এজন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। 

চীনের এই পুরো সাইটটিকে জাদুঘর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাদুঘরটি প্রধানত তিনটি ভল্ট এবং একটি প্রদর্শনী হল নিয়ে গঠিত: ভল্ট ওয়ান, ভল্ট টু, ভল্ট থ্রি এবং ব্রোঞ্জ রথের প্রদর্শনী হল। বিস্ময়কর এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দেয়।  

টেরাকোটা আর্মিদের পাওয়া যায় এখানেই, Image source:smithsonianmag.com

টেরাকোটা আর্মিরা দেখতে কেমন?   

টেরাকোটা সৈন্য, তীরন্দাজ, ঘোড়া এবং রথের সেনাবাহিনীকে সম্রাট কিন শি হুয়াং-এর সমাধির কাছে সামরিক গঠনে স্থাপন করা হয়েছিল যাতে পরবর্তী জীবনে সম্রাটকে রক্ষা করা যায়। পোড়ামাটির এসব মূর্তি ও অস্ত্রশস্ত্র বিশেষ ছাঁচ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। যদিও তাদের বেশিরভাগেরই হাত ও শরীরের অন্য দৃশ্যমান অঙ্গ অভিন্ন, তবে শুধুমাত্র মুখাবয়ব ছিল ভিন্ন। আর মুখের এই আকৃতির জন্য আটটি বিশেষ ছাঁচ ব্যবহার করা হয়েছিল। 

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকসের তথ্যমতে একজন একক কারিগর প্রতিটি যোদ্ধা তৈরি করেছে। এজন্য একজন সৈনিকের চেহারার সাথে আরেকজন সৈনিকের চেহারার কোনও মিল নেই। একটি সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায় যে তারা গ্রিক ভাস্কর্য কৌশল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল যা তারা সিল্ক রোডে ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে শিখেছিল। 

এছাড়াও টেরাকোটা আর্মিদের মধ্যে দেখা যায় কিছু কিছু পোড়ামাটির সৈন্যমূর্তি মাথাবিহীন অবস্থায় আছে, কিন্তু তাদের দেহ সম্পূর্ণ। এগুলো নিয়ে গবেষণা করে জানা গেছে যে মূর্তিগুলির মাথা, বাহু এবং ধড় আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং তারপরে একত্রিত করা হয়েছিল। মাথা ও অন্যান্য অঙ্গ আলাদা করে তৈরির ফলে শিল্পীরা পৃথক ও নিখু্ঁতভাবে মুখ এবং চুলের নকশা করতে পেরেছিল।  

এরপরে কাদামাটি শক্ত এবং মজবুত করার জন্য পোড়ানো হয়েছিল। সেইসাথে উজ্জ্বল রঙে রাঙানো হয়েছিল। ফলস্বরূপ প্রতিটি মূর্তি ভিন্ন এবং অনন্য দেখায়, ঠিক জীবন্ত মানুষের মতো। তবে ২০০০ বছরের ক্ষয় এবং আর্দ্রতার পরে বেশিরভাগ মূর্তি তাদের আসল উজ্জ্বল রঙ হারিয়েছে। তবে মূর্তি নির্মাণে এমন দক্ষতা তাদের উচ্চস্তরের কারুকার্য এবং শৈল্পিকতা প্রকাশ করে। 

Terra Cotta Warrior
পোড়ামাটির সৈন্যদের চেহারায় কোন মিল নেই, Image source:education.nationalgeographic.org

টেরাকোটা আর্মিদের শ্রেণীবিভাগ 

টেরাকোটা আর্মিদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা: পদাতিক, অশ্বারোহী এবং সারথি। পদাতিক বাহিনীকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় যার মধ্যে উচ্চ, মধ্যম এবং নিম্ন পদের অফিসার, হালকা-সশস্ত্র এবং ভারী-সশস্ত্র পদাতিক সৈন্য রয়েছে। সেইসাথে আছে দাঁড়িয়ে থাকা এবং হাঁটু গেড়ে থাকা তীরন্দাজ। আর সারথিদের মধ্যে রয়েছে দুটি শ্রেণি। রথচালক এবং রথ যোদ্ধা। 

টেরাকোটা আর্মিদের মুখের আকৃতি 

টেরাকোটা আর্মিদের মুখের আকারগুলিকে মোটামুটিভাবে আট প্রকারে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। প্রতিটি আকৃতি এক একটি চীনা অক্ষরের অনুরূপ: 目, 国, 用, 甲, 田, 由, 申 এবং 风।  উদাহরণস্বরূপ, ‘目’-আকৃতির মুখগুলি তুলনামূলকভাবে সরু এবং লম্বা দেখায়৷ 

Terracotta Army General and Mid rank officer Xi'an
টেরাকোটা আর্মিদের মুখের আকৃতি, Image source:.buggedspace.com

টেরাকোটা আর্মিদের চুলের সাজসজ্জা  

প্রাচীনকালে চুলের সাজসজ্জা ও বাঁধার কৌশল শুধুমাত্র মানুষের জীবনধারার অংশই ছিল না বরং এর মাধ্যমে তাদের সামাজিক অবস্থানের প্রতিফলন ঘটতো। তেমনই পোড়ামাটির যোদ্ধাদের চুল বাঁধার রীতিও তাদের পদমর্যাদা এবং পরিষেবাকে নির্দেশ করতো। 

চুল বাঁধার রীতিগুলিকে মোটামুটিভাবে দুই প্রকারে ভাগ করা যায়। প্রথম প্রকারের মধ্যে রয়েছে মাথার উপরে ডান পাশে একটি খোঁপা করা। অন্য নিয়মটি ছিল তাদের চুলকে দড়ির মতো পেঁচিয়ে তারপর খোঁপা করে মাথার ঠিক উপরের দিকে বাঁধত যা পরে একটি কাপড়ের টুপি দিয়ে আবৃত করে রাখত। তারা তাদের চুল বাঁধার জন্য ব্যান্ড, ফিতা বা পিন ব্যবহার করত। 

Head of an archer showing hair details and accessories
টেরাকোটা আর্মিদের চুলের সাজসজ্জা, Image source:buggedspace.com

টেরাকোটা আর্মিদের পোশাক  

একজন টেরাকোটা আর্মির পোশাক থেকে তার সামরিক পরিষেবার পদ বুঝা যায়। যিনি সেনাপ্রধান তার পোশাক ছিল তিন স্তরের। একটি সাঁজোয়া টিউনিকের নীচে দুটি স্তরের পোশাক রয়েছে যা তার বুক, পিঠ এবং কাঁধকে রক্ষা করে। তার পায়ে বর্গাকার জুতো দেখা যায় যা হালকা ওজনের এবং সামনের দিকে বাঁকানো। প্রথম ভল্টে শুধুমাত্র একজন জেনারেল এবং দ্বিতীয় ভল্টে দুজন জেনারেল পাওয়া গেছে। 

অন্যদিকে সাধারণ সাঁজোয়া যোদ্ধারা তাদের বুক, পিঠ এবং কাঁধকে রক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা ভারী সাঁজোয়া টুপি দ্বারা আচ্ছাদিত পোশাক পরিধান করেছে। অশ্বারোহীরা পিলবক্স টুপি, গলার স্কার্ফ এবং দেহের সামনে ও পিছনে হালকা বর্ম পরিধান করেছে। তাদের পায়ে পড়ে আছে নরম জুতা।  

রথ চালকদের প্রসারিত বাহু এবং হাতগুলির জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষা ছিল যা দিয়ে ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাদের ঘাড়ের পিছনে আত্মরক্ষামুলক হেলমেট পরিধান করেছে। 

Dressing of the Qin Terracotta Warriors
টেরাকোটা আর্মিদের পোশাক ,Image source:chinadaily.com

আরও যা কিছু পাওয়া গেছে 

টেরাকোটা আর্মি সম্বলিত গর্তগুলি খননের সময়, প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রায় ৪০,০০০ ব্রোঞ্জের অস্ত্র খুঁজে পেয়েছেন, যার মধ্যে যুদ্ধের অক্ষ, ক্রসবো, তীরের ফলা এবং বর্শা রয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো ২০০০ বছরেরও বেশি সময় পরেও এই অস্ত্রগুলি অত্যন্ত ভালভাবে সংরক্ষিত ছিল। এর কারণ এসব ধাতব অস্ত্র তৈরিতে প্রতিরক্ষামূলক ক্রোম প্লেটিং ব্যবহৃত হয়েছিল। এটা আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক কৌশল যা প্রাচীন চীনা ধাতুবিদ্যার পরিশীলিততা প্রকাশ করে। 

আর সেনাবাহিনীতে ৬০০টি ঘোড়া এবং প্রায় ১০০টি রথ পাওয়া গেছে যা অফিসার এবং আরোহীদের বহন করে। প্রতিটি মূর্তিই কোন না কোন অস্ত্র ধারণ করেছিল। যেমন তলোয়ার, বর্শা, ধনুক, ক্রসবো, কিন্তু মূল্যবান ব্রোঞ্জের জন্য এগুলোর বেশিরভাগই চুরি হয়ে গেছে অনেক আগেই। 

গত প্রায় ৪৮ বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ২২ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে প্রায় ৬০০টি ভূগর্ভস্থ গর্ত খুঁজে পেয়েছেন। এর মধ্যে একটি ভূগর্ভস্থ ভল্টের একটি কমপ্লেক্স এখনও অনেকাংশে খনন করা হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকরা কেন্দ্রীয় সমাধিক্ষেত্রের কাছাকাছি যাওয়ার সময় সাইটে আবিষ্কৃত অন্যান্য প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে চারটি ব্রোঞ্জের ঘোড়া দিয়ে টানা কাঠের রথ, ব্রোঞ্জের পাখির ভাস্কর্য, ৩টি খুব সূক্ষ্ম সারসের মূর্তি, ২০টি রাজহাঁসের মূর্তি যেগুলোর সবগুলোই একটি নদীর দৃশ্য তৈরি করার জন্য একটি ৬০ মিটার দীর্ঘ পুকুরে স্থাপন করা হয়েছে। 

এছাড়াও একটি আস্তাবলের প্রতিরূপ, মন্দিরের কাঠামো এবং একটি শস্যদানা রাখার মৃৎপাত্র রয়েছে। এখানে ১০০ x ১৩০ মিটার পরিমাপের একটি অস্ত্রাগার পাওয়া গেছে যেখানে শত শত বর্ম এবং হেলমেটের প্রতিলিপি রয়েছে যার প্রতিটি টুকরো শত শত ছোট পাথরের টুকরো থেকে সতর্কতার সাথে তৈরি করা হয়েছে। এখানে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও সমাধি রয়েছে ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী মূর্তিও রয়েছে। 

Terracotta Warriors: Pi Blade for a Slashing Weapon | Flickr
সমাধিতে পাওয়া অস্ত্র, Image source:Flickr.com

অন্যান্য গর্তে বেসামরিক পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেনাবাহিনীর মতো পোড়ামাটির বেসামরিক কর্মচারীদের মূর্তিও সমাধিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনকার সময়ের লেখার উপকরণ ও বিনোদনের জন্য পোড়ামাটির অ্যাক্রোব্যাটের একটি দলও পাওয়া গেছে। 

চীন তথা পুরো বিশ্বের কাছে বিশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময় এই টেরাকোটা আর্মির আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর মাধ্যমে চীনা কিন রাজবংশ তথা প্রাচীন চীনের মানুষদের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।  

 

Feature Image: chinadaily.com 
References:  
01. Terracotta Warriors: An Army for the Afterlife.  
02. "Terracotta Army – Essential Information for Your Visit".