মার্ভেল সিরিজের ওয়াকান্ডা যদি বাস্তবে রুপ নেয় তাহলে কি কেউ বিশ্বাস করবে? হয়তো অনেকেই এটাকে হাস্যরস বলে উড়িয়ে দিতে পারে। সায়েন্স ফিকশন বা ইউটোপিয়ান আইডিয়া নিয়ে সবাই মেতে থাকলেও আসলে এমন কিছু আজ পর্যন্ত সত্যিকারে দেখতে পাওয়া যায়নি। তবে,ভবিষ্যত পৃথিবী যে টেকনোলজি দ্বারা শাসিত হবে সেটা কারো সন্দেহের বাইরে নয়।
সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর অন্যতম এক পদক্ষেপ দ্য লাইন বা নিওম সিটি। কল্পনার রাজ্যকে হার মানানো এই শহরে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রস্তাবনা দেখা যায়; যা অনেকের নিকট বাস্তব জগতের সায়েন্স ফিকশনও মনে হতে পারে। কি থাকছে এই শহরে? কেনই বা এই ধরণের শহর বানানো হচ্ছে? আজকের আলোচনায় তা জানার প্রয়াস চলবে।
সৌদি রয়েল ফ্যামিলি প্রায়শই ব্রেকিং নিউজের বিষয় হয়। কখনো খাশোগি হত্যা, আবার কখনো ইজরায়েলের সাথে গোপন সম্পর্ক স্থাপন–এসব বিষয় আলোচনায় আসে। বলা হয়ে থাকে তাদের কাছে প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকানা রয়েছে। ঠিকই পড়েছেন! মিলিয়ন বা বিলিয়ন নয়, ট্রিলিয়ন ডলার।
তো এই অর্থের মালিক হওয়ার পেছনের কারণ কি? মূলত তেল ব্যবসাই এই অর্থের মূল উৎস। বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরবের তেল ব্যবসা সম্পর্কে অবহিত থাকাটা স্বাভাবিক। যদি সৌদি আরবের সম্পূর্ণ অবস্থার দিকে তাকানো হয় তাহলে দেখা যাবে যে, তারা আমেরিকার মতো অস্ত্র ব্যবসা বা প্রযুক্তিগত ব্যবসা, চীনের মতো উৎপাদন খাতে দক্ষ নয়। তাদের সিংহভাগ অর্থের উৎস এই তেল।
তবে সবকিছুরই শেষ রয়েছে। ঠিক একইভাবে এই একতরফা তেল ব্যবসাও শেষ হবে সেটা সৌদি আরব সরকার জানে। ভবিষ্যতে তেল উত্তোলন করে যে তেমন একটা লাভবান হওয়া যাবে না সেটা আঁচ করেই তারা নতুন পথে হাঁটছে। আবার কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার অঙ্গীকার তো রয়েছেই। এরই প্রেক্ষিতে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নিওম সিটি তৈরির ঘোষণা দেন।
দ্য লাইন
সাধারণত শহরগুলো কেন্দ্রভিত্তিক হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তবে দ্য লাইন তথা এই নিওম সিটির নকশা হবে সম্পূর্ণ সোজা। শুধুমাত্র সোজা নয় ১৭০ কিলোমিটার লম্বা! সৌদি আরবের অর্থনীতিকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রথম পদক্ষেপ এই শহর। এটি সৌদির তাবুক প্রদেশে তৈরি হচ্ছে যেটা সম্পূর্ণরুপে একটি মরুভূমি। মরুভূমির বুকে এই বাস্তব কল্পনারাজ্যে থাকবে না কোন ধরণের কার্বন ব্যবহার। সৌদি সরকার বলছে এটি ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিতে চলবে।
বলা হচ্ছে, এই ১৭০ কিলোমিটারের মধ্যে ৯ মিলিয়িন মানুষের আবাস হবে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শহরটি সম্পূর্ণভাবে উলম্ব আকৃতির হবে। পুরো শহরে দুটো বিল্ডিং অর্থাৎ স্কাইস্ক্রাপার থাকবে যার উচ্চতা ৪৮৮ মিটার। এর দুইটির মধ্যে সংযোগ থাকবে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে উচ্চতর গতিসম্পন্ন দুটি ট্রেন থাকবে।
এই ট্রেনের মাধ্যমে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। অর্থাৎ মানুষের নিকট মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে সব ধরণের সেবা উন্মুক্ত থাকবে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, মরুভূমির উষ্ণতায় কিভাবে এই অলৌকিক বিষয় সম্ভব? এর উত্তরও সৌদি কর্তৃপক্ষ সবার জন্য তৈরি করে রেখেছে। তারা বলছে শহরটি একটি কাচের দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত হবে যা হিরম্যাট্রিকালি সিলমোহর করা থাকবে। এজন্য একে ‘Mirrored City’ বা ‘আয়নার শহর’ও বলা হচ্ছে।
গাড়িবিহীন এই শহরটির নিচের স্তরটিকে ‘গ্রাউন্ড লেভেল’ বলা হচ্ছে। এখানে কোন ধরণের গাড়ি বা যানবাহন চলবে না। এই স্তরে গাছপালা এবং মানুষের চলাচলের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরটিতে অর্থাৎ সার্ভিস লেয়ারে থাকবে দোকানপাট এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এবং সর্বশেষ স্তরে উচ্চতর গতিসম্পন্ন ট্রেন চলাচল করবে।
আচ্ছা গাড়িবিহীন এই শহরে কি আসলেই সোদির ধনকুবেরা ট্রেনে চলাচল করতে রাজি হবে? এরজন্যই ভলোকপ্টার (Volocopter), ডেলিভারি ড্রোন, রোবট সার্ভেন্টের কথাও ভাবা হচ্ছে।
নিওম সিটি নিয়ে ২৭০০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট প্রকাশ হয়। এছাড়াও মনে করা হচ্ছে এর বাইরেও অনেক অজানা তথ্য রয়েছে। শহরটি গঠনে ৫০০ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে জানা গেছে। ভৌগলিক অবস্থান থেকে চিন্তা করলে দেখা যায় যে এই শহরটি এমন এক জায়গায় স্থাপন হচ্ছে যেখানে এখনো সৌদি আরবের নাগরিকরা তেমন একটা না গেলেও বিশ্বের ৪০ শতাংশ নাগরিক মাত্র চার ঘন্টায় শহরটিতে আসতে পারবে। মিশর এবং জর্ডানের বর্ডারে হওয়া শহরটি ভূ-রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
নিওম সিটি থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিশরের ট্যুরিস্ট স্পট শারাম আল শেখ অবস্থিত। উক্ত শহরটির সাথে যদি সৌদি আরব সেতু দিয়ে সংযোগ স্থাপন করে তাহলে ইজরায়েলকে বাইপাস করে মিশরের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ থাকছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এত বড় প্রকল্পের ফান্ডিং কে দিচ্ছে? তথ্যানুযায়ী এই অর্থ সৌদি সরকারই বহন করছে। যার প্রথম ধাপেই ৩১৯ বিলিয়ন ডলারের খরচ আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রিন হাইড্রোজেন প্লান্টের এই শহরটিতে আগামী দশকে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এছাড়াও এখানে ইতোমধ্যে বিমানবন্দর তৈরি হয়ে গেছে।
সৌদি সরকারের মূল লক্ষ্য শহরটিতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল করা। এরজন্য মোহাম্মদ বিন সালমান এর নিয়ম এবং নীতি তৈরিকরণে সেখানে থাকা বিনিয়োগকারীদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে বলে জানান। অর্থাৎ সৌদি আরব এখানে পৃথিবীর নতুন সিলিকন ভ্যালি স্থাপনের কথা ভাবছে।
সম্ভব কিনা?
নিওম সিটির প্রস্তাবনা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এখানে কিছু বিষয় অর্থনৈতিক আবার কিছু বিষয় টেকনিকাল। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণে এত বড় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। আবার টেকনিকাল বিষয়ে দেখা যায় যে এর স্থাপত্য শিল্প আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দিহান হতে দেখা যায়।
যেহেতু এত বড় একটি শহরের সম্পূর্ণটি নবায়নযোগ্য শক্তিতে চলবে সেহেতু এরজন্য বিশাল বড় সোলার প্যানেল লাগার কথা। আবার, সোদি আরবের বিশুদ্ধ পানির তেমন কোন উৎস না থাকায় কিভাবে সেই মরুভূমিতে বিশুদ্ধ পানির জোগান দেওয়া হবে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এর সমাধানও কর্তব্যরত দল দিয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, এখানে পরিবেশের কোন ক্ষতি হচ্ছে না তো? এতেও সৌদি সরকার ইতিবাচক উত্তর দিয়ে বলছে যে এখানে পরিবেশে কোন আঘাত হবে না। উলটো প্রাকৃতিক এবং ডিজিটাল সত্তার এ মিশ্রণ হবে এই শহর। ৩০ বছর পূর্বেও দুবাইয়ের অস্তিত্ব আজকের মতো ছিল না। স্থাপত্যবিদ মোরফোসিসের ফিউচারিস্টিক আর্কিটেকচারকে একসময় র্যাডিকাল বলেও আখ্যা দিতে দেখা গেছে। অথচ চীনের অনেক শহরই আজ সেই আদলে তৈরি।
নিওম সিটি একটি টেকনোলজিকাল ইউটোপিয়া যা মরুভূমির বুকে এক নতুন ব্যবিলনের সৃষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটা মেগাসিটির নান্দনিকতা কেমন হবে সেটাই এই শহর আঁচ করায়। ভবিষ্যত জলবায়ুর বিপক্ষে যে মানুষ কিভাবে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ। মানুষের ক্ষমতা কোন স্তরে পৌছেছে তা হয়তো এটি আমাদের জানান দেওয়াবে।
Feature Image: parametricalarchitecture.com References 01. Where's the Neom? 02. The Line NEOM. 03. 500 Billion Smart Desert Dream. 04. Revolutionise our current way of life. 05. 100-mile long emission-free smart city. 06. What is NEOM? 07. Saudi Arabia unveils design of car-free, futuristic megacity Neom. 08. Saudi’s Neom is dystopia portrayed as Utopia. 09. Netanyahu holds secret meeting with Saudi crown prince.