পাইতিতি: হারিয়ে যাওয়া সোনার শহর

588
0

পাইতিতি, সোনায় ভরা শহর৷ ইনকা সভ্যতার অন্যতম মুখরোচক সব গল্পের খোরাক এই পাইতিতি৷ লোকমুখে শোনা যায় এই শহরের সবকিছুই ছিল সোনায় মোড়ানো, দারিদ্র্য বলতে কিছুই তাদের মধ্যে ছিল না৷ কুস্কোর পূর্বদিকে পেরুভিয়ান জঙ্গলে লুকিয়ে আছে এই রহস্যময় শহর৷

পাইকিকিন, ভিলকাপাম্পা, এল গ্র্যান পাইতিতি, তবে সবচেয়ে বেশ পরিচিত এল ডোরাডো নামে৷ যাকে হারানো সোনার শহর বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে৷ পাইতিতি হলো সেই জায়গা যেখানে ইনকারা তাদের অবশিষ্ট সোনা ও অন্যান্য সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে৷ কুস্কো ছিল ইনকা সভ্যতার মূল কেন্দ্র৷

পাইতিতির ইতিহাস

পাইতিতির ইতিহাস সবটাই লোকমুখে শোনা৷ গবেষকদের মতে ইনকা বীর ইনকারির হাতে প্রতিষ্ঠা পায় পাইতিতি৷ স্পেন-ইনকার মধ্যকার যুদ্ধ প্রায় ৪০ বছর ধরে চলেছিল এবং যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে ১৫৭২ সালে ইনকা সাম্রাজ্য স্পেনীয়দের দখলে চলে যায়৷

স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতার রাজধানী কুস্কোতে প্রবেশ করে লুটপাট চালালে স্পেনীয়দের হাতে ধরা পড়ার আগেই ইনকারা তাদের ধনসম্পদ ও সোনাদানা কোনো এক অজানা জায়গায় লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যায়৷ ধারণা করা হয়, স্প্যানিশদের আক্রমণের সময় আন্দিজের পূর্ব অঞ্চলে ইনকারা আশ্রয় নেয় এবং এটাই হয়তো তাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল৷

ইনকা সভ্যতার মানচিত্র৷ Image Source: worldhistory.org

পাইতিতি অভিযান 

পাইতিতির সন্ধানে অভিযান শুরু হয়েছে অনেককাল আগে থেকেই৷ অনেকেই এই পাইতিতি খুঁজতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, কেউ নিখোঁজ রয়েছেন আজও, কেউ ব্যর্থ হয়েছেন, কেউ কেউ আবার শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন আমাজনের অনাবিষ্ককৃত অঞ্চলে লুকিয়ে আছে পাইতিতি৷ এই পাইতিতি আবিষ্কারের অজানা কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল লিখেছিলেন ‘The Lost World’. বইটির জনপ্রিয়তা আজো আছে পাঠকসমাজে।

১৯৭৯ সালে দুজন ফ্রেঞ্চ-পেরুভিয়ান অভিযাত্রী নিকোলা এবং হার্বার্ট কার্টেজেনা ম্যামেরিয়ার এগ্রেরিয়ান সেটেলমেন্ট খুঁজে পান৷ তাদের এই আবিষ্কার পেরুভিয়ান আমাজন জঙ্গলে ইনকার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম লিখিত প্রমান৷ ম্যামেরিয়া আনুমানিক ১৫ বর্গমিটারের ঘরবাড়ি নিয়ে গঠিত ইনকা সভ্যতার পিরকা স্টাইলে৷ যদিও এটিকে আপাতদৃষ্টিতে পাইতিতি অভিযানের অনেক মূল্যবান আবিষ্কার বলে মনে হয়েছে তবে গবেষকরা এখানেই থেমে যাননি৷

বহু প্রত্নতত্ত্ববিদ ও অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করেন ম্যামেরিয়া হারানো ইনকা শহর পাইতিতির একটি নিদর্শন৷ পাইতিতির খোঁজ থেকে মানুষ বুঝতে পারলো কতটা রহস্যময় ও অজানা প্রত্যন্ত অঞ্চল লুকিয়ে আছে আমাজনের গহীনে৷ পাইতিতির সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে সেই কলোনিয়াল যুগে৷

স্যার আর্থার কোনানের লেখা বই৷ Image Source:amazon.com

২০০১ সালে, ইতালিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ মারিও পোলিও, আন্দ্রেজ লোপেজ নামক একজন মিশনারীর একটি রিপোর্ট আবিষ্কার করেন ভ্যাটিকান আর্কাইভ থেকে৷ ১৬০০ সালের ঘটনা সম্বলিত এই রিপোর্টটিতে লোপেজ বিস্তারিত অনেক কিছুই লিখেছেন৷ একটি বিশাল শহর যা সোনা, রূপা ও অন্যান্য রত্নসমৃদ্ধ, যা স্থানীয়দের কাছে পাইতিতি নামে পরিচিত৷ এটির অবস্থান ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গলের মাঝখানে৷

লোপেজ ভ্যাটিকান পোপ ত্রয়োদশ কোমেটকে এই রিপোর্ট সম্পর্কে জানান এবং ভ্যাটিকান অনেক বছর এর অবস্থান গোপন করে রাখে৷ কেউ কেউ ধারণা করে থাকেন ভ্যাটিকান সিটির উচ্চপদস্থ লোকেরা জানেন পাইতিতির অবস্থান এবং তারা এখনো সেগুলোকে পৃথিবীর কাছ থেকে গোপন করে রেখেছেন৷

একদমই প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থান এবং ঘন পর্বতের মাঝে হওয়ায় পাইতিতিকে খুঁজে পাওয়া বেশ দু:সাধ্য৷ বর্তমানে মাদক চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং তেল উত্তোলন ঘটছে পেরুর এই অংশে এবং অনেক পেশাদার অভিযাত্রীরা এখানে প্রবেশ করতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন কিংবা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন৷

২০০১ সালে লোপেজের কাজটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেও অনেক অভিযাত্রী এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ অনেক সময় এবং রিসোর্স ব্যয় করে আমাজনের অপ্রকাশিত এলাকা উন্মোচনের জন্য৷ ১৫ শতকের দিকে ইনকার প্রাণকেন্দ্র কুস্কো সম্পর্কে সম্পর্কে সবকিছু জেনে পিযারো ও তার দলও যাত্রা শুরু করেছিল৷

দ্য গ্রেট ইনকা রোড। Image Source: pinterest.com

আন্দ্রেজ লোপেজের উল্লেখ করা সোনার শহর কুস্কো, যার মন্দিরের দেয়ালগুলো প্রায় ৭০০ এরও বেশি সোনার শীট দিয়ে মোড়ানো যেগুলোর প্রত্যেকটি ২ কিলোগ্রাম ওজনের বেশি ছিল৷ পিযারো ও তার দলবলের আরো অবাক হওয়া বাকি ছিল৷ ইনকাদের সৃষ্টিকর্তা সূর্যকে উৎসর্গ করে কুস্কোতে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়৷ এই মন্দিরে প্রচুর পরিমাণে কঠিন সোনার ডিস্কসহ মূল্যবান পাথর পাওয়া যায় যেগুলো ইনকা প্রভুর নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়৷

কিন্তু রহস্যময়ভাবে এগুলো এখন উধাও হয়ে গেছে৷ পিযারোর দল আরো কিছু উল্লেখযোগ্য মূল্যবান প্রত্নতত্ত্বের খোঁজ পান যার মধ্যে ১৪টি গোল্ড ক্ল্যাড মমির উল্লেখ আছে৷ এই মমিগুলো ইনকা রাজ্যের বিভিন্ন শাসকদের ছিল, কিন্তু এর সবগুলোই পিযারোর কুস্কোতে পৌঁছার পূর্বেই হারিয়ে যায়৷

ইনকার খোঁজে বের হওয়া অভিযাত্রীদের আরো একজন পার্সি হ্যারিসন ফ’চেট৷ ১৯২৫ সালে ফ’চেট ব্রাজিলের দিককার আমাজন বনে যাত্রা শুরু করেন একটি হারানো শহরের উদ্দেশ্যে যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘The Lost City of Z.’ যদিও এটা সরাসরি ইনকা সভ্যতা খোঁজার ঘটনা নয় তবে এটি অন্য অভিযাত্রীদের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় পাইতিতির মতো শহর খুঁজে পাওয়ার৷

অন্যান্য গবেষক-এর মধ্যে ছিলেন কার্টেজেনাস যিনি ম্যামেরিয়া আবিষ্কার করেছিলেন৷ তিনিও বিংশ শতাব্দীতে ইনকা সভ্যতা খুঁজে বেড়িয়েছেন৷ হিটলারের চিত্রগ্রাহক হ্যান্স এর্তল থেকে শুরু করে পুরো বিশ্বজুড়ে অসংখ্য অভিযাত্রী এই ইনকা সভ্যতার খোঁজে বেড়িয়েছিলেন৷ তাদের অনেকেই হারিয়ে গেছেন রহস্যময় আমাজনের গহীনে, কারোর বা মৃত্যুও হয়েছে৷

পাইতিতির সন্ধানে আমাজনের গহিনে অভিযাত্রী। Image Source: Photo by Fernando S. Gallegos

বর্তমান সময়ের অভিযাত্রীদের মধ্যে গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান ও থিয়েরি জেমিন বিশ্বব্যাপী পরিচিত৷ জেমিন পাইতিতির সন্ধান করে গেছেন দশক ধরে৷ পারাতাওরি নামের কিছু পিরামিডের সন্ধান পান তিনি৷ ২০১১ এর শুরুতে জেমিন পাচাকুচিয়াক-এর সম্ভাব্য কিছু কবর খুঁজে পান পেরুর মাচু পিচুতে৷ ২০১২ সালে তিনি তার দলবল নিয়ে পাইতিতির খোঁজে বেরিয়ে পড়েন৷ যদিও তার এই যাত্রায় উল্লেখযোগ্য কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি৷

কিংবদন্তী অভিযাত্রী গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান পাইতিতির খোঁজে তার অভিযান শুরু করেন ১৯৮১ সালে৷ গ্রেগ ডেয়ারমেঞ্জিয়ান প্রায় ২০ বছর ধরে এর খোঁজ করতে থাকেন৷ ১৯৮৪ সালে তিনি পাইতিতির খোঁজে যাত্রা শুরু করেন এবং কুস্কো শহর থেকে উত্তর ও উত্তর পূর্ব দিকে কুস্কিনো শিকারীদের সাক্ষাৎ পান যারা তাকে ইনকাদের প্রাচীন সভ্যতার খোঁজ পেতে সাহায্য করেছিল৷

ইনকা সভ্যতার খোঁজকারী আরেকজন হলেন স্যার কার্লোস নিউএনশওয়ান্ডার৷ তিনি ১৯৫০ সাল থেকে পাইতিতি এবং পান্তিওকোলা নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ ১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে গ্রেগ ও কার্লোস একত্রে কাজ শুরু করেন৷ অবশেষে ২০০৪ সালে গ্রেগ ও তার দল ইনকা সভ্যতার কিছু নিদর্শন খুঁজে পান৷

পাইতিতির কল্পিত রূপ। Image Source: pinterest.com

তবে এখনো নিশ্চিতভাবে পাইতিতির অস্তিত্ব ও হারানো সোনার সন্ধানের জোরালো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ গ্রেগ বিশ্বাস করেন খুব শীঘ্রই তিনি খুঁজে পাবেন পাইতিতি, হারিয়ে যাওয়া সেই সোনাসমৃদ্ধ শহরটিকে৷ পাইতিতি আবিষ্কারের এই অভিযান এখনো অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে৷

পাইতিতির আবিষ্কার আমাদেরকে ইনকা সভ্যতা ও তার সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে ও বুঝতে সাহায্য করবে৷ এই জায়গাটি এবং এখানে থাকা প্রত্নতত্ত্বগুলো খুঁজে পাওয়া গেলে ইনকাদের সভ্যতার অনেক অজানা রহস্য উন্মোচিত হবে, টিকিয়ে রাখা যাবে হারিয়ে যাওয়া ইনকাদের স্মৃতি৷ জানা যাবে পাইতিতি কি শুধুই মিথ নাকি সত্যি!

 

ফিচার ইমেজ: phys.org

তথ্যসূত্রসমূহ:

1.http://www.kalerkantho.com

2.http://sacredearthjourneys.ca

3.http://ancient.origins.net

4.http://karikuy.com