খ্রিস্টপূর্ব ৫০ হাজার বছর পূর্বে মানুষ খাবারে স্বাদ যোগ করতে বিভিন্ন সুগন্ধি উদ্ভিদ ব্যবহার করতো। মিষ্টি গন্ধের এই গাছসমূহ ব্যবহার করে খাবারের স্বাদ বাড়ানোর চেষ্টা করা হতো। দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত খাবারেও এসব ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল এতে দেবতারা খুশি হোন।
শুধু তাই নয়। অসুস্থ হলে এমন মসলা দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে চিকিৎসা বেশ জনপ্রিয় ছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রাচীনকাল থেকেই মসলার বেশ গুরুত্ব রয়েছে। এবং ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে পৃথিবীর সমস্ত ধরনের মসলার মূল একবিন্দুতে মিলেছে।
প্রাচীনকালে মসলা জাদু, ঐতিহ্য, ধর্ম, ঔষধ, সংরক্ষণ প্রভৃতি বহুমুখী কাজে ব্যবহার করা হতো। তবে মসলা ব্যবসা বিস্তৃতি লাভ করে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর পূর্বে। শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে দারুচিনি এবং গোলমরিচ দিয়ে। তখন মিশরের বিভিন্ন বিরুৎ উদ্ভিদের চাহিদা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে চীন এবং ভারতে বিরুৎ-এর উপর নিভর্র করে এক রকম চিকিৎসা ব্যবস্থাই গড়ে ওঠে।
রামায়ণে লবঙ্গের কথা উল্লেখ আছে। প্রথম শতাব্দীতে রোমানদের কাছে লবঙ্গ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ান বণিকরা ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে গমন করেন। আরব এবং ভারতের মধ্যে মসলা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া হয় মূল ব্যবসাকেন্দ্র।
বন্দর থাকার সুবিধার জন্য একে নির্বাচন করা হয়। ধীরে ধীরে প্রাচ্যের মসলা পাশ্চাত্যেও আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। ইউরোপিয়ানরা তাদের নিজস্ব ঘরনার মসলার স্বাদ থেকে বেরিয়ে প্রাচ্যের মসলার অনুরাগী হয়ে পড়ে।
মধ্যযুগে মসলা বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত হয়। ৮-১৫ শতকে ইউরোপের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মসলা বাণিজ্য বিস্তৃতি লাভ করে। ইউরোপের বাজারে প্রাচ্যের মসলার জনপ্রিয়তা বাড়ে। বিশেষ করে কালো গোলমরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, আদা, জিরা এগুলো সব যেত এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে।
ইউরোপে বছরে প্রায় ১০০০ টন গোলমরিচ ও ১০০০ টন অন্যান্য মসলা আমদানি করা হতো যা ছিল ১৫ লক্ষ লোকের এক বছরের খাদ্যযোগানের সমতুল্য। রেঁনেসাযুগে মসলার বহুমুখী ব্যবহার শুরু হয়। রেঁনেসা অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তিই হয় মসলা। কলম্বাসের সময়ে মানুষের মসলা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিল।
ভারতবর্ষের মসলার ইতিহাস ৭০০০ বছরের পুরোনো। ভারতবর্ষ থেকে মেসোপটেমিয়া, আরব এবং মিশরে মসলা, সুগন্ধি এবং রেশমবস্ত্র যেত। খ্রিস্টযুগের আগে গ্রিক বণিকরা দক্ষিণ ভারত থেকে অন্যান্য দামী জিনিসের পাশাপাশি মসলাও ক্রয় করত। রোমানরা মসলা, সিল্ক, মসলিন এবং স্বর্ণের প্রতি অনুরক্ত ছিল।
মূলত ভারতবর্ষের মসলা এবং অন্যান্য বিলাসবহুল পণ্যের জন্যই ক্রুসেড সংঘটিত হয়। বারের স্বাদবর্ধক মসলার রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস! ক্ষমতার পালাবদল, ধর্মবিদ্বেষ আর মুনাফালোভী বিদেশী ঔপনিবেশকদের সীমাহীন অত্যাচারে রচিত এক করুণ অধ্যায়!
তৎকালীন ভারতবর্ষের মালাবার উপকূলের কালকিট বন্দরের খ্যাতি প্রায় পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল মসলার সুবাদে। সেখানে তখন একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল আরবদের। তারা মসলা বাণিজ্য বিস্তারে পৌরাণিক কাহিনী ব্যবহার করতো। এভাবে তারা সমৃদ্ধ হয়ে উঠছিল।
আর ওদিকে পর্তুগীজরা চাইছিল এই চাবিকাঠি নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরতে। তাই উঠেপড়ে লেগেছে ভারতবর্ষে আসার পথ আবিষ্কারে। গুপ্তচরবৃত্তি করে ধূলো দিয়েছে সেখানকার শাসক আর সাধারণ মানুষের চোখে। ধর্মকে পুঁজি করে ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ছলে, বলে, কৌশলে বারবার হানা দিয়েছে।
আরব বণিকদের হটিয়ে শীর্ষস্থান দখল করার জন্য এমন কোনো হঠকারী পথ নেই, যা তারা অবলম্বন করেনি। অবশেষে ১৫১১ সালে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। ১৬ শতকের শেষ দিকে তাদের এই ব্যবসা বহুগুণে ফুলেফেঁপে ওঠে। গোলমরিচ হয়ে ওঠে স্বর্ণের চেয়েও দামী।
প্রাচ্যের মসলা কতটা দামী ছিল তার একটা ছোট্ট উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়। ১টি ভেড়ার পরিবর্তে ১ পাউন্ড আদা, ৩টি ভেড়া অথবা অর্ধেক গরুর পরিবর্তে ১ পাউন্ড জয়ত্রী পাওয়া যেত। আর গোলমরিচ এতটাই মূল্যবান ছিল যে প্রতি দানা হিসেবে গণনা করা হতো। ধারণা করা হতো গোলমরিচে সঞ্জীবনী ক্ষমতা রয়েছে।
পর্তুগীজদের এই সাফল্য আর বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা কেউ ভালো চোখে দেখেনি। তাদের হটিয়ে এলো ডাচরা। এবার তারা একেবারে মসলার স্বর্গভূমি ইন্দোনেশিয়ায় শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসলো। ব্যবসায়ী থেকে হয়ে গেল প্রভু। এরপর জল গড়িয়ে বহুদূর।
এলো ইংরেজরা। ১৬ থেকে ১৮ শতকে ধীরে ধীরে দখল নিতে শুরু করলো সবকিছুর। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা! মসলাকান্ড হার মানাল লঙ্কাকান্ডকেও। বদলে গেল মানচিত্র, ক্ষমতার দাবিদার আর ইতিহাস!
একদিকে ধর্মকে আশ্রয় করে ব্যবসা বিস্তারের চক্রান্ত অন্যদিকে নিজভূমিতে দাসে পরিণত হওয়া মানুষদের করুণ ইতিহাস। উপলক্ষ্য সামান্য মসলা! অবশ্য সামান্যই বা বলা যায় কি? কারণ মসলা তখন ছিল স্বর্ণের চেয়ে দামী।
মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া ব্যবসা করেও লালসা মেটাতে পারেনি। ফলে বারবার হয়েছে সংঘাত, কখনো কামানের বিপরীতে স্রেফ ঢাল-তলোয়ার দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে, আবার কখনও বিশ্বাসঘাতকের বিষাক্ত ছোবলে প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে।
আবার সকলেই জানে ভারতবর্ষের আবিষ্কারক হিসেবে ভাস্কো-ডা-গামার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ইতিহাসের পাতায় তার দেখা মেলে একজন মহান ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু আসলে কি তাই? বাঁধা ছক থেকে বেরিয়ে মসলার ইতিহাস একটু ঘেঁটে দেখলেই তার আসল স্বরূপ উন্মোচন হয়। আবিষ্কারকের চেয়ে দস্যু, ধর্মবিদ্বেষী আর ক্ষমতালোভীই মনে হয় বেশি।
প্রকৃতপক্ষে মসলার ইতিহাসটা অতটা সহজ নয়। এর জন্য রীতিমত যুদ্ধ হয়েছে। বিচিত্র পৃথিবীতে কত বিচিত্র ঘটনা ঘটে! মসলার যুদ্ধও তেমনি এক অভিনব যুদ্ধ। যার সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষমতা, লালসা আর রক্তের গন্ধ!
মসলা বাণিজ্য একটি চলমান প্রক্রিয়া। একে বন্ধ করার সাধ্য কারো নেই। পৃথিবী জুড়ে এত এত শাসকের উত্থান-পতন হয়েছে, সাম্রাজ্য বদল হয়েছে, মানচিত্র বদলে গেছে কিন্তু মসলা বাণিজ্যের ছন্দপতন কেউ ঘটাতে পারেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে এর ধারাবাহিকতা।
আজও বিশ্ব বাজারে মসলার চাহিদা কমেনি। বরং বৈচিত্র্যপ্রিয় মানুষ রসনাকে তৃপ্ত করতে নানা ধরনের মসলা ব্যবহার করে। সেই সাথে ঔষধশিল্পেও এর ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে সমৃদ্ধ হচ্ছে এর ইতিহাস। যে বস্তু মানচিত্র বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তাকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। মসলা মূল্যমানের দিক থেকে যতটা মূল্যবান ইতিহাস রচনায়ও ঠিক ততটাই মূল্যবান। মসলাকে তাই সর্বকালের সেরা রত্ন বললেও অত্যুক্তি হয় না।
Featured Image: LinkedIn.com Reference: 01. spice-trade. 02. history-of-spices. 03. the-history-of-spices-the-beginning.
তথ্যবহুল লেখা। ভালো লেগছে পড়ে। মনে হচ্ছিলো সত্যেন সেনের ‘মসলার যুদ্ধ’ বইটা আরেকবার পড়লাম অন্যরকম ভাষাশৈলীতে। ধন্যবাদ লেখককে।