গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে শরৎ এসে পড়লেও তাপদাহ এখনও অতটা কমেনি, যার মানে এখনও আইসক্রিমের মৌসুম চলছে। তবে এখন কিন্তু মানুষেরা শুধু গরমকালেই আইসক্রিম খাই না বরং সারা বছরই এই মজাদার খাবারটি খেয়ে থাকে। শীতে তুলনামূলক কম খেলেও খাওয়া কিন্তু বাদ যায় না।
কেননা ছোট-বড় সবারই প্রিয় খাবার আইসক্রিম। অতিরিক্ত গরমে যখন ঠাণ্ডা কিছু খেতে মন চায় তখন আইসক্রিমের নাম সবার আগে চলে আসবে মাথায়। কারণ এই খাবারটি যেমন স্বাদ দেয় তেমনই শীতল করে ভেতরটাও। পানি যেমন ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয় আইসক্রিমও এই নিয়মেই তৈরি হয়। আর তাপ পেলে আইসক্রিম গলতে শুরু করে। নিজে দ্রুত গললেও অতুলনীয় স্বাদের মাধ্যমে আইসক্রিম গলিয়ে দেয় ভোক্তার মন।
আইসক্রিম শুধু দেশেই নয়, বরং সারাবিশ্বেই তুমুল জনপ্রিয়। শুধু তাই নয় আইসক্রিমকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বৃহৎ অর্থনীতি। কিন্তু এই আইসক্রিম আসল কোথা থেকে বা বানালো কে? এর সঠিক দিনক্ষণ বা আবিষ্কারকের নাম কারও জানা নেই। কারণ বরফ ও মিষ্টি দিয়ে তৈরি সাধারণ একটি খাবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের এই অতুলনীয় স্বাদে পৌঁছেছে।
আইসক্রিম কি?
আইসক্রিম মানে মালাই, কুলফি বরফ, হিমসর, মালাই বরফ ইত্যাদি। এটা ডেজার্ট বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার। চিনি, দুধ, পানি, ভূট্টার সিরাপ ছাড়াও স্বাদ বাড়াতে বাদাম, ফল বা ফলের রসদ, চকলেট ইত্যাদি নানা উপাদান ব্যবহৃত হয় এই আইসক্রিমে। পুরো মিশ্রণটি তৈরির পর আইসক্রিমকে অবশ্যই ঠাণ্ডায় জমতে দিতে হবে। আর এটিই আইসক্রিমের মূল বৈশিষ্ট্য।
খাওয়ার সুবিধার জন্য আইসক্রিমের মিশ্রণকে ছোট ছোট ছাঁচে ঢেলে নানা আকার দেওয়া হয়। কখনও কাঠিও ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যাতে কাঠিটির বাড়তি অংশ ধরে আইসক্রিম খাওয়া যায়। এছাড়াও ওয়াফেল, প্লাস্টিকের কাপ, বক্স, গ্লাস ইত্যাদিতেও আইসক্রিম বসানো হয়। বর্তমান বাজারে নানা ধরনের আইসক্রিম পাওয়া যায়। নানা স্বাদের এসব আইসক্রিমের নামও অনেক। যেমন কোন আইসক্রিম, চকবার, কাপ, কাঠি বা ললি আইসক্রিম ইত্যাদি।
যেহেতু আইসক্রিম একটি হিমায়িত খাবার তাই এটি ফ্রিজের বাইরে বের করলে বা বাইরের স্বাভাবিক তাপে থাকলে আস্তে আস্তে গলে যায়। যাতে না গলে এমন আইসক্রিম আবিষ্কারেরও চেষ্টা চলছে।
আইসক্রিমের উৎপত্তি কখন?
আইসক্রিম খাবারটা এত মজার যে এই খাবারটির আবিষ্কারকের নামটা জানার ইচ্ছা জাগে মনে। এটির উৎপত্তি আধুনিক মানব সভ্যতার উত্থানের পরে। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি এটা আবিষ্কার করেনি। বরং মজার এই খাবারটি এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সেসব দেশের নিজস্ব রেসিপি যোগ করে আজকের এই আধুনিক আইসক্রিম হয়েছে। এই ভিন্ন স্বাদের জন্যই আইসক্রিম গলিয়ে দেয় ভোক্তার মন।
চীনে প্রথম বরফ এবং তুষার খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে। প্রায় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের লোকেরা বরফের মধ্যে হিমায়িত দুধ এবং ভাতের সংমিশ্রণে একটি খাবার বানাতো যা এই আইসক্রিমকেই নির্দেশ করে।
তবে প্রায় ২৫০০ বছর আগে প্রাচীন পারস্যে প্রথম আইসক্রিমের সঠিক উপাদানের সন্নিবেশ ঘটেছিল। সেই সময়ে আইসক্রিম মানে ছিল বরফযুক্ত মিষ্টি পাণীয়কে ছোট ছোট টুকরো করে বিভিন্ন স্বাদের টপিংস এবং ফল দিয়ে সাজানো। তারা ইয়াখচাল নামক পিরামিড কাঠামোতে আইসক্রিমের মিশ্রণকে ঢেলে হিমায়িত করার বা জমানোর জন্য বাষ্পীভবন ও নিরোধক ব্যবহার করতো। আর আইসক্রিমে চিনির ব্যবহার তারাই প্রথম শুরু করে।
পারস্যের আইসক্রিম বানানোর এই ঐতিহ্য বা নিয়ম ধীরে ধীরে গ্রিক এবং রোমান সাম্রাজ্যে পৌঁছে যায়। আইসক্রিম কিছুটা ব্যয়বহুল হওয়ায় তা রোমান অভিজাত এবং রাজপরিবারের জন্যই বানানো হতো। কিন্ত দুঃখজনকভাবে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে, পাহাড় থেকে নীচের শহরগুলিতে সংগঠিত বরফ পরিবহন বন্ধ হয়ে যায় এবং আইসক্রিম আরও বেশি ব্যয়বহুল পণ্য হতে থাকে।
রোমের পতনের পরে ১০০০ বছরে আইসক্রিমের রেসিপির সামান্যই পরিবর্তন হয় এবং ইউরোপ অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে আসার পরই রেনেসাঁ ইতালিতে আইসক্রিম নতুন করে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।
ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের সূত্রে ইতালি আইসক্রিমের নতুন এবং উদ্ভাবনী রেসিপিগুলির সাথে তাদের যোগাযোগ ঘটায়। আর এই যোগাযোগটা ঘটান বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো। তার হাত ধরেই এই ঠাণ্ডা খাবারটি চীন থেকে ইতালি পৌঁছে এবং ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে সারা বিশ্বে আইসক্রিমের এই সম্প্রসারণ সহজ ছিল না। জানা যায়, ইতালীয় এক সম্ভ্রান্ত মহিলা ক্যাথরিন ডি’মেডিসি ১৫৩৩ সালে ডিউক ডি অরলিন্সকে (ফ্রান্সের ভবিষ্যত রাজা) বিয়ে করতে ফ্রান্সে যাওয়ার সময় তার বাবুর্চিকে সাথে নিয়ে আসেন যিনি আইসক্রিম বানানোর কৌশলটি ভালোভাবে জানতেন। আর এই বাবুর্চি থেকেই সারা ফ্রান্সে আইসক্রিমের রেসিপি ছড়িয়ে যায়।
এরপর এটির উৎপাদনে উদ্ভাবক, প্রযুক্তিবিদ এবং বাবুর্চিসহ সকলেই বিশ্বজুড়ে আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা এবং প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য তাদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালায়। ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে এই রেসিপি জনপ্রিয়তা পাবার কয়েক দশক পরে উত্তর আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় আইসক্রিম বিক্রি শুরু হয়। এরপর যখন শিল্প বিপ্লব ঘটে তখন থেকে ধীরে ধীরে আইসক্রিম তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিমায়নের সমস্যাগুলিকে ক্রমাগত উন্নত করার জন্য কাজ শুরু করা হয়।
অবশেষে এই সমস্যার সমাধান ১৯২৬ সালে পাওয়া যায় যখন রেফ্রিজারেশন পদ্ধতি বা বৈদ্যুতিক ফ্রিজ আবিষ্কার হয়েছিল। এর ফলে শিল্পপতিরা এই হিমায়িত খাবারটি বৃহৎ পরিমাণে উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম হয় যা আইসক্রিমের দামকে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নামিয়ে আনে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আইসক্রিম শিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে। আজ আইসক্রিম শিল্প প্রতি বছর কয়েক ডজন বিলিয়ন ডলার আয় করে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অসাধারণ খাবারটির সবচেয়ে বড় ভোক্তা।
আইসক্রিমের প্রধান উপকরণ
আইসক্রিম একটি মিষ্টি খাবার। তাই এটি বানানোর মূল উপাদানের মধ্যে চিনি থাকবেই। এছাড়াও, পানি, দুধ বা দুধের ফ্যাট, ক্রিম, কর্ণ সিরাপ এর মূল উপাদান। মূল উপাদান ছাড়াও স্বাদ বাড়াতে যোগ করা হয় শুকনো বা তাজা ফল, ফলের রস, বাদাম, নারকেল, চকলেট ইত্যাদি।
তবে আজকাল বিভিন্ন উপাদান মেশানোর কারণে সেই অনুযায়ী আইসক্রিমের নাম দেওয়া হয়। যেমন আইসক্রিমে আম দিলে সেটার নাম হবে ম্যাঙ্গো আইসক্রিম, ভ্যানিলা ফ্লেভার দিলে হবে ভ্যানিলা আইসক্রিম, চকলেট দিলে হবে চকলেট আইসক্রিম, বাদাম ও নানান ফলের রস ব্যবহারে তৈরি আইসক্রিমকে ফ্রুটস আইসক্রিম, লেবু বা কমলার রসের স্বাদের আইসক্রিমের নাম লেমন বা অরেঞ্জ ফ্লেভার আইসক্রিম।
দই, ক্ষীর, ফালুদার স্বাদেও এখন আইসক্রিম বানানো হচ্ছে যা শাহী বা নবাবী নামে পরিচিত হচ্ছে। এছাড়াও এখন আইসক্রিম নিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে। যেমন সম্প্রতি ভারতে ইসবগুলের সমন্বয়ে আইসক্রিম বানানো হয়েছে। আবার মিষ্টি খাওয়া বারণ এমন ব্যক্তিদের জন্য মিষ্টিবিহীন বা লো ফ্যাট আইসক্রিম বানানো হচ্ছে।
আইসক্রিম কি সবসময় খাওয়া যায়?
এ প্রশ্নটা সবার মনে জাগে এজন্য যে এটা ঠাণ্ডা খাবার এবং যাদের ঠাণ্ডায় রোগ বৃদ্ধির আশংকা আছে তারা সন্দিহান থাকেন এটা খাওয়া নিয়ে। এজন্য শীতে অনেকেই আইসক্রিম খান না। এমনকি বাচ্চাদের মজার খাবার হলেও নিয়মিত তাদের এটা খেতে দেওয়া হয় না ঠাণ্ডা লাগার ও দাঁতের ক্ষতির ভয়ে। কেউ আবার ওজন বাড়ার ভয়েও খান না আইসক্রিম।
অনেকেই ভাবে যে আইসক্রিম মানে শরীর ঠাণ্ডা রাখার খাবার। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় গরমকালের চেয়ে শীতে আইসক্রিম খাওয়া বেশি উপকারি। কারণ যখন অতিরিক্ত গরম অনুভূত হয় তখন আইসক্রিম খেলে উল্টো আইসক্রিমে থাকা ফ্যাটের জন্য শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে পানি খেতে ইচ্ছে করে বেশি। এছাড়া বেশি খেলে ওজন বেড়ে যাওয়া বা রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ার আশংকা থাকে।
আসলে আইসক্রিম সারাবছরই খেতে পারবেন তবে আবহাওয়া হালকা গরম বা হালকা ঠাণ্ডা থাকলে সেটা হবে উপযুক্ত সময়। নিয়মিত না খেয়ে সপ্তাহে একটি/ দুটি খাওয়া যেতে পারে।যারা ফ্যাটের ভয়ে মন গলানো এই খাবারটি এড়াতে চান তারা কিন্তু দুধ ছাড়া ললি আইসক্রিম খেতে পারেন। বাচ্চারা আইসক্রিম খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করে নিলে দাঁতের ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকবেনা।
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভোগা ব্যক্তি, কিডনিতে পাথর হওয়া রোধে, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে, ওজন কম হলে ক্যালোরি বাড়াতে, টনসিলের অপারেশন হলে আইসক্রিম খেতে পারেন।
আইসক্রিম খেলে কি মন ভালো হয়?
সিনেমায় বা বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে মন খারাপ বা রাগ উঠলে আইসক্রিম খেয়ে মন ভালো ও শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবেই কি তা হয়? হ্যাঁ, অনেক সময়ই এটা হয়।
কারণ ভিন্ন স্বাদের মাধ্যমে আইসক্রিম গলিয়ে দেয় ভোক্তার মন। যে স্বাদটা বাচ্চা থেকে বুড়ো সবারই পছন্দের। আইসক্রিম শরীরে সেরোটোনিন হরমোন তৈরি করে, যা গুড হরমোন নামে পরিচিত। আর এটা মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। রেগে গেলে ঠাণ্ডা এই মুখরোচক খাবারটিতে মনের পরিবর্তন ঘটে, ফলে রাগটাও তখন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বিশ্বের প্রথম আইসক্রিম বিজ্ঞাপন
আইসক্রিম এর জনপ্রিয়তার জন্য এটি একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। এজন্য আইসক্রিমের বিজ্ঞাপনও অনেকটা সাহায্য করেছে। নিউইয়র্কে সর্বপ্রথম আইসক্রিম নিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ১৭৭৭ সাল এর ১২ মে। তখনকার কনফেকশনার ফিলিপ লানজি প্রতিদিনই শহরে আইসক্রিম পাওয়ার ঘোষণা দেয়।
আর আইসক্রিমের রেসিপি সর্বপ্রথম বের হয় ১৭৬৮/৬৯ সালে যার নাম ছিল The Art of Making Frozen Desserts. ১৮৫০ সালে কার্লো গাতি পেনি আইস বিক্রি শুরু করেন। গাতিই গাড়িতে করে আইসক্রিম বিক্রিকে মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলেন।
বিশ্ব আইসক্রিম দিবস
আইসক্রিমের অতুলনীয় স্বাদে মুগ্ধ হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ১৯৮৪ সালে জুলাই মাসকে জাতীয় আইসক্রিম মাস এবং ১৫ জুলাইকে জাতীয় আইসক্রিম দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।
আইসক্রিম এমন একটি আন্তর্জাতিক খাবার যা সারাবিশ্বের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের কাছে প্রিয়। কারন আইসক্রিম নিজে গলে গলিয়ে দেয় ভোক্তার মন। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের আইসক্রিম পাওয়ার পাশাপাশি ঘরোয়াভাবে বা ছোট উদ্যোগে তৈরি দেশীয় কম দামী বিভিন্ন আইসক্রিম স্কুল কলেজের গেটেও বিক্রি হয়।
এছাড়াও, রাস্তায় বা গ্রামের পথে পথে আইসক্রিমওয়ালা ভ্যানে করে বা পায়ে হেঁটে বিক্রি করেন সস্তা উপকরণের আইসক্রিম যা কুলফি, মালাই নামে পরিচিত। তবে স্বাদ যেমনই হোক আইসক্রিম নাম শুনলেই মানুষের মনে এটা খাওয়ার লোভ জেগে ওঠে।
Feature Image: freepik.com References: