ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপত্য, শিল্পকলা সবকিছুতে বিখ্যাত ফ্রান্স। এই কথা সবারই কমবেশি জানা। কিন্তু, আজকের আলোচনা বইপ্রেমীদের জন্য। আর যারা বই ভালোবাসেন, বইয়ের দোকানের পর তাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা লাইব্রেরি।
এখন একটু ভাবুন, চারদিকে দুনিয়ার বিচিত্র বিষয়ের বই। এর মধ্যে অনেকগুলো বিরল পাণ্ডুলিপি। সাথে আছে গথিক, রেনেসাঁ যুগ থেকে শুরু করে বিখ্যাত ফরাসি স্থপতিদের ডিজাইনের রিডিং রুম। আজ ঘুরে আসবো ফ্রান্সের এমন কিছু লাইব্রেরি, যেখানে আছে বই আর ঐতিহ্যের যুগলবন্দি।
বিবলিওটিকা ম্যাজারিন
বিবলিওটিকা ম্যাজারিন প্যারিসের প্রাচীনতম পাবলিক লাইব্রেরি। নিও-ক্লাসিক্যাল এবং বারোক স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিখ্যাত এই লাইব্রেরিটি। এটি ষষ্ঠ অ্যারান্ডিসমেন্ট বা প্রশাসনিক জেলার পন-ডেসা ব্রিজ এবং লুভ্যরের বিপরীতে শন নদীর বাম তীরে অবস্থিত।
লাইব্রেরিটি ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী প্রভাবশালী ফ্রাঙ্কো-ইতালীয় কার্ডিনাল এবং রাজনীতিবিদ জুলস রেমন্ড ম্যাজারিন, ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফ্রন্ড গৃহযুদ্ধের সময় ম্যাজারিন ফ্রান্স থেকে পালিয়ে গেলে তার প্রিয় লাইব্রেরিটি নিলামে তোলা হয়। ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষমতায় ফিরে, তিনি ধীরে ধীরে এটিকে পুনরুদ্ধার করেন।
তার ব্যক্তিগত প্রাসাদে অবস্থিত লাইব্রেরিই প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত বইয়ের বিশাল সংগ্রহের জন্য ব্যবহার হয়। ১৬৪৩ সালে শিক্ষাবিদ এবং প্রায় দুই দশক পরে সাধারণ মানুষের জন্য এটি উন্মুক্ত করা হয়। এখানে প্রায় ৬,০০,০০০ বইয়ের সংগ্রহ আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ম্যাজারিনের নিজের সংগ্রহের ২,০০,০০০ বই রয়েছে।
এই লাইব্রেরি ১৩ শতকের গুটেনবার্গ বাইবেল বা ম্যাজারিন বাইবেলের জন্য বিখ্যাত। এটি একটি ভল্টে সংরক্ষিত আছে। তবে প্রদর্শনের জন্য প্রধান পাঠকক্ষ বা রিডিং রুমে একটি রেপ্লিকা রয়েছে। বিবলিওটিকা ম্যাজারিন তার মধ্যযুগের অনেক বিরল পাণ্ডুলিপির জন্য সুপরিচিত।
যার একটি বড় অংশ ১২ থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত আধুনিক ফরাসি ইতিহাস সংগ্রহের জন্য, ফরাসি বিপ্লবের পরে ফরাসি অভিজাতদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও রয়েছে, ২০০টিরও বেশি শিল্পকর্ম এবং ঘর সাজানোর প্রাচীনতম বিভিন্ন সামগ্রী। যার মধ্যে আছে ম্যাডাম ডি পম্পাদোরের ঝাড়বাতি। এর রাজকীয় রিডিং রুমটি, যা ‘হ্যারি পটার’ মুভির অংশ ছিল।
রিসেলিউ লুভ্যও
ফ্রান্স-এর বিভিন্ন লাইব্রেরির মধ্যে রিসেলিউ লুভ্যও অন্যতম একটি। প্যারিসে শিক্ষার প্রাচীনতম কেন্দ্রগুলোর একটি হিসেবে, এটি ১৮৬৮ সালে সর্বপ্রথম জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। স্থপতি হেনরি ল্যাব্রোস্টের ডিজাইনে, লাইব্রেরিটি তার বিশাল ক্যালিডোস্কোপিক ডিম্বাকৃতির রিডিং রুমের জন্য বিখ্যাত।
এছাড়াও, অনেক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি এবং গ্রিক ও রোমান মৃৎপাত্রের সংগ্রহ রয়েছে। এটি স্কয়ার লুভ্যয়ের (ছোট ম্যানিকিউরড পার্ক) এর বিপরীতে অবস্থিত।
বিবলিওতিক দে আরসেনাল
ফ্রান্স-এর আরেকটি বিখ্যাত লাইব্রেরি হলো বিবলিওতিক দে আরসেনাল। ব্যাস্টিল জেলায় অবস্থিত এই লাইব্রেরিটি অর্ডন্যান্সের মাস্টার-জেনারেলদের প্রাক্তন বাসভবন।
ফরাসি ইতিহাস, বিশেষ করে ফরাসি বিপ্লবে আগ্রহীদের জন্য, ফরাসি সাহিত্য এবং ফরাসি সামরিক ইতিহাসের সংগ্রহসহ এই প্রাক্তন সামরিক ভবনটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যসের জন্য একদম উপযুক্ত জায়গা।
এটি আকারে ছোট এবং অন্যান্য লাইব্রেরির তুলনায় সাধারণ। তবে, এর সামনের অংশটুকু বেশ আকর্ষণীয় এবং ‘সেলুন ডি মিউজিক’ অংশটিও ব্যাপক জনপ্রিয়। সম্প্রতি পুনরুদ্ধার করা এই অংশে, সুসজ্জিত চিত্রিত দেয়াল এবং অনেক ঝাড়বাতিযুক্ত হয়েছে।
বিবলিওতিক ফর্নি
বিবলিওতিক ফর্নি চতুর্থ অ্যারান্ডিসমেন্টের পন ম্যারির পিছনে, হোটেল দে সেনে অবস্থিত। এই চমৎকার বিল্ডিংটির রয়েছে টার্ট বা চূড়া, সাথে স্টেইন্ড কাঁচের জানালা। গথিক ডিজাইনের এই লাইব্রেরিটি প্যারিসের সেরা লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে একটি।
১৮৮৬ সালে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ভল্টেড বা খিলানযুক্ত পথ এবং সিলিংয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে প্যারিসের ডিজাইন, গ্রাফিক আর্ট, ফ্যাশন, প্রিন্টিংয়ের সবচেয়ে বিস্তৃত সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়া, বিবলিওতিক ফর্নির রয়েছে এক মিলিয়নেরও বেশি পোস্টকার্ডের এক অনন্য সংগ্রহ।
বিবলিওতিক সেন্ট জেনিভি
প্যানতিওন থেকে রাস্তার ওপারে ল্যাটিন কোয়ার্টারে অবস্থিত, সেন্ট জেনেভি একইসাথে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে ২ মিলিয়নেরও বেশি সংগ্রহ রয়েছে। লাইব্রেরিটিতে রয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত, প্যারিসের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম মঠ সেন্ট জেনেভির সংগ্রহ।
৯ম এবং ১০ম শতাব্দীতে, নরম্যানদের বারবার লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত মঠটি প্রায় ধ্বংস হতে চলছিল। ১২ শতকে, সেন্ট-ডেনিসের মঠকর্তা এবং ফ্রান্সের রাজাদের উপদেষ্টা সুগার, একটি লাইব্রেরি এবং কপিস্ট বা অনুলিপিকারদের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির দায়িত্ব সেন্ট অগাস্টিনের উপর আরোপ করেন। ১৭ শতকের শুরুতে লাইব্রেরিটিকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠন করতে হয়।
১৬২৪ সালে কার্ডিনাল দে লা রোলফুকো লাইব্রেরিটি পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি ১৬৪০ সালে তার সমস্ত ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং সংরক্ষণাগার দান করেন। ১৬৮৭ সালের মধ্যে, লাইব্রেরিতে ২০,০০০টি বইয়ের সংগ্রহ ছিল, যার মধ্যে ৪০০টি পাণ্ডুলিপি এবং কয়েক হাজার প্রিন্ট ছিল।
১৮৩৮ সালে শুরু হওয়া সেন্ট জেনেভিভ লাইব্রেরির নকশা ও নির্মাণের জন্য নিযুক্ত ছিলেন স্থপতি হেনরি ল্যাব্রোস্ট। লাইব্রেরিটি তার কাচ এবং লোহার তৈরি রিডিং রুমের জন্য বিখ্যাত, যা ল্যাব্রোস্টের নামে রাখা হয়েছে। ভবনটির সামনের অংশে ৮১০ জন বিশিষ্ট পণ্ডিতদের নামের শিলালিপি রয়েছে।
আমেরিকান লাইব্রেরি
প্যারিসের আমেরিকান লাইব্রেরি ৭ম অ্যারোন্ডিসমেন্টে অবস্থিত। এটি প্যারিসে সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায়ের একটি কেন্দ্র হিসাবে কাজ করছে। বিল্ডিংটি আইফেল টাওয়ার থেকে হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত। ১৯২০ সালে আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে।
আংশিকভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত আমেরিকান সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে দান করা বই রাখার জন্য এটি প্রতিষ্ঠা হয়। অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রান্সে আমেরিকান সাহিত্য এবং আধুনিক লাইব্রেরি বিজ্ঞানের সেরা জিনিস আনতে চেয়েছিল। সেই থেকে, লাইব্রেরিটি ইউরোপ মহাদেশের বৃহত্তম ইংরেজি-ভাষার বইয়ের লাইব্রেরিতে পরিণত হয়েছে।
বিবলিওতিক দে লা শরবন
প্যারিসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত, বিবলিওতিক দে লা শরবন। শিশুদের জন্য নিবেদিত প্রথম লাইব্রেরি হিসাবে ১৯২৪ সালে এই লাইব্রেরি খোলা হয়েছিল। রাজধানীর সবচেয়ে সুন্দর লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে এটি একটি। ছাদে হাতির দাঁতের ছাঁচ এবং দেয়ালে রোমান্টিক পেইন্টিং, এই লাইব্রেরিকে করে তুলেছে অনন্য।
এখানে বই ধার করার জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র, একজন গবেষক বা একজন শিক্ষক হতে হবে। তবে যে কেউ বিনামূল্যে লাইব্রেরিতে যেতে পারেন।
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সংস্পর্শে থাকার জন্য ফ্রান্স চিরকাল সবাইকে আকর্ষণ করেছে। কিন্তু, এই স্থান বইপ্রেমীদের জন্যও স্বর্গরাজ্য। কোনো এক শান্ত বিকেলে, শব্দের পৃথিবীতে হারিয়ে যেতে যেতে, কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুলানো যাবে গথিক ডিজাইনের দেয়াল বা সিলিংয়ে। হারিয়ে যাওয়া সময়ে ফিরে যেতে বইয়ের বিকল্প নেই।
Featured Photo: Wikimedia by Marie-Lan Nguyen References: 01. the-6-best-libraries-of-paris. 02. bibliotheque-mazarine-frances-oldest-public-library-is-paris-best-oasis. 03. the-10-most-beautiful-libraries-in-paris. 04. libraries-Paris.