ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য আর রহস্যে ঘেরা ভারতবর্ষ। নানা সময়ে নানা শাসকের হাত ঘুরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে আজকের এই উপমহাদেশ। এই শাসনকালের পুরোটা জুড়েই রয়েছে যুদ্ধ, রাজ্যবিস্তার, নৃশংসতা আর জয়-পরাজয়ের কাহিনী।

এর ভিড়ে অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে শাসকদের শাসনামলের কীর্তি। তারা যে যুদ্ধের বাইরেও শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সেটা তাদের সময়ে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনার দিকে লক্ষ্য করলে খুব সহজেই আঁচ করা যায়।

পুরাতন দিল্লি। শত বছরের শত ঘটনার সাক্ষী হয়ে কালের বিবর্তনে আজো দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। নানা রকম বাহারি মুঘল স্থাপনা দিল্লিকে করে তুলেছে অতুলনীয় এক ঐতিহাসিক নগর। এর ভেতর একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হলো দিল্লী জামে মসজিদ। আকার, গঠন আর সজ্জায় এটি ছাপিয়ে গেছে অন্য সব স্থাপনাকে।

দিল্লি জামে মসজিদ। Image Source: britannica.com

দিল্লী জামে মসজিদের অপর নাম মসজিদ-ই-জাহান-নুমা। এটি নির্মিত হয় ১৬৫০-১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের আমলে। তার সময়ে নির্মিত আরেকটি স্থাপনা ‘লাল কেল্লা’-এর নিকট এটি অবস্থিত।

আরবিতে জামে মসজিদ মানে ‘শুক্রবারের মসজিদ’। আর মসজিদ-ই-জাহান-নুমা অর্থ ‘পৃথিবীর প্রতিবিম্ব মসজিদ।’ এই স্থাপনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে আওরঙ্গজেব পাকিস্তানের লাহোরে বাদশাহী মসজিদ নির্মাণ করেন।

স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে এটি ইসলামিক ঘরানার স্থাপত্যের নিদর্শন। তবে এখানে হিন্দু এবং জৈন স্থাপত্যশৈলীরও ছোঁয়া রয়েছে। এর রূপকার ছিলেন উস্তাদ খলিল। মসজিদের নির্মাণকার্য তত্ত্বাবধায়ন করেন সাদুল্লাহ খান৷ তিনি সম্রাট শাহজাহানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

মুঘল সম্রাট শাহজাহান। Image Source: tajmahal.gov.in

এর নির্মাণব্যয় তৎকালীন সময়ে ছিল ১০ লক্ষ রুপি। বুখারা থেকে সৈয়দ আবদুল গফুর শাহ বুখারী স্বয়ং শাহজাহানের আমন্ত্রণে এসে মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব নেন। তাকে খেতাব দেওয়া হয় ‘ইমাম-ই-উজমা।’ তার বংশধররাই পরবর্তীতে মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে মসজিদের দায়িত্বে আছেন উক্ত বংশের উত্তরসূরী আহমেদ বুখারী।

এটি রাস্তা থেকে প্রায় ত্রিশ ধাপ উপরে অবস্থিত। প্রায় ৫০০০ শ্রমিক এর নির্মাণ কাজে জড়িত ছিল। মূলত মসজিদটি লাল বেলেপাথর এবং সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত। এটি পশ্চিমদিকে অবস্থিত যা সৌদি আরবের মক্কা নগরীর দিক নির্দেশ করে।

মসজিদ প্রাঙ্গনের পূর্বদিকে বড় গেট রয়েছে। এখানে ৩৫টি ধাপ রয়েছে। এটি মূলত রাজ সভাসদদের ব্যবহারের জন্য ছিল। আর জনসাধারণ উত্তর এবং দক্ষিণের ছোট গেটগুলো ব্যবহার করতো। এখানে ধাপের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৩ ও ৩৯।

মসজিদের প্রবেশদ্বারের সিঁড়ি। Image Source: commons.wikimedia

মসজিদটির দৈর্ঘ্য ২৬১ ফুট এবং প্রস্থ ৯০ ফুট। বিরাট খিলানসহ ৩টি গেট রয়েছে। এর ৩টি গম্বুজ ও ৪টি মিনার আছে। উত্তর এবং দক্ষিণে রয়েছে ১৩০ ফুট উঁচু দুটি মিনার। মিনারে মোট ৫টি ব্যালকনি দৃশ্যমান। এখানে ১৩০ ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করে উঠতে হয়। মসজিদের ধারণক্ষমতা ২৫ হাজার। নারীদেরও নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা রয়েছে।

মসজিদের মেঝে সাদা-কালো মার্বেল পাথরে নকশা করা। ফুলেল মোটিফে অন্দরসজ্জা করা হয়েছে। প্রার্থণা কক্ষের ভেতরের আয়তন (৯×২০০) ফুট। প্রার্থণা কক্ষের প্রবেশমুখে পারস্য ক্যালিগ্রাফি রয়েছে।

হরিণের চামড়ায় লিখা কুরআন, মহানবী (স)-এর পদচিহ্ন, স্যান্ডেল এবং চুলসহ নানা ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পন্ন বিষয়াদি মার্বেল ব্লকে অঙ্কিত এবং নান্দনিক বস্তু দ্বারা মসজিদের ভেতর সজ্জিত। কক্ষের ছাদে মার্বেল পাথরের তৈরি গম্বুজ রয়েছে।

মসজিদের গম্বুজ। Image Source: pixabay.com

লাল কেল্লার পাশাপাশি এটি সেই সময়ে দিল্লীর সুউচ্চ স্থাপনা ছিল। মুঘল যুগ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি ছিল ‘রাজকীয় মসজিদ।’ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের আগে এর সাথে মাদ্রাসা সংযুক্ত ছিল। বিদ্রোহের পর এটি ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক ক্রোক করা হয় এবং মাদরাসাটি ধ্বংস করা হয়।

সিদ্ধান্ত হয় মসজিদটিও ধ্বংস করা হবে। তবে জনগণের প্রবল তোপের মুখে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সরকার বাধ্য হয়। বর্তমানে মসজিদটি ‘দিল্লি ওয়াকফ বোর্ড’-এর অধীনে রয়েছে।

এই মসজিদের কিছু মর্মান্তিক অধ্যায়ও রয়েছে। ২০০৬ সালে মসজিদ প্রাঙ্গনে বোমা হামলা হয়। ২০১০ সালে গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে দুজন বিদেশি নাগরিক আহত হন। তবে এতকিছুর পরও এই জায়গা নিয়ে মানুষের আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমেনি।

মসজিদের অন্দরসজ্জা। Image Source: istockphoto.com

বর্তমানে এটি টুরিস্ট স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। দর্শনার্থীদের জন্য সপ্তাহে ৭ দিনই উন্মুক্ত। ভেতরে প্রবেশের জন্য কোনো প্রকার এন্ট্রি ফি দিতে হয় না। তবে ছবি তোলার জন্য ২০০-৩০০ রুপি দিতে হয়। মিনারে উঠার জন্য ১০০ রুপি।

দর্শনের সময় সকাল ৭:০০ টা থেকে বেলা ১২:০০টা এবং দুপুর ১:৩০টা থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০টা। সন্ধ্যা বেলায় মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয়।

এর আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো হলো-

চাঁদনী চক মার্কেট (২২০মি.)
শ্রী দিগম্বর জৈন লালমন্দির (৭৫০ মি.)
লাল দুর্গ (১ কি.মি.)
ফতেহপুরি মসজিদ (১.৭ কি.মি.)
গুরুদুয়ার শিস গঞ্জ সাহেব (২.১ কি.মি.)
গৌরি শংকর মন্দির (২.৪ মি.)
স্টিফেন’স চার্চ (২.৬ মি.)
রাজ ঘাট (২.৭ কি.মি.)
খারি বাওলি মসলা মার্কেট (২.৮ কি.মি.)
ইন্ডিয়া গেট (৬.১ কি.মি.)
হুমায়ুনের সমাধি (৯.৯ কি.মি.)

রাতের দিল্লি জামে মসজিদ। Image Source: twitter.com

ভ্রমণপিপাসু হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যরসিক হলে তো সোনায় সোহাগা। নানা ধরনের মুঘল খাবারের স্বাদে রসনাকে তৃপ্ত করতে এই জায়গাটি একেবারে আদর্শ। পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভর করে এখানে গড়ে উঠেছে জমজমাট খাবারের ব্যবসা। স্বাদে গন্ধে যা অতুলনীয়।

দামও রয়েছে হাতের নাগালে। নানা ধরনের কাবাব এখানকার মূল আকর্ষণ। অন্যান্য মুঘল খাবারও কম লোভনীয় নয়। দেশি-বিদেশি সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই জায়গা।

এত শত বছর পূর্বে প্রযুক্তি এতটা উন্নত না থাকা সত্ত্বেও এত বিশাল আর অসাধারণ স্থাপত্য গড়ে তোলা দুঃসাহসই বটে। তবে কালের বিবর্তনে এগুলো ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যায়। সংস্কারের প্রয়োজন হয়। দিল্লি জামে মসজিদ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় গত শতকে। হায়দ্রাবাদের নিজামের কাছে মসজিদের এক চতু্র্থাংশ সংস্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে ৭৫ হাজার রুপি অনুদান চাওয়া হয়। পরে অবশ্য তিনি পুরো মসজিদ সংস্কারের জন্য ৩ লক্ষ রুপি অনুদান দেন।

রাতের মসজিদ। Image Source: britannica.com

ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দুই ঈদে ভারতের নানা জায়গা থেকে এখানে নামাজ পড়তে আসেন। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা ধর্মের মানুষ এর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়। দিল্লির আপামর জনতার কাছে এর গুরুত্ব অনেক। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যের মিশেলে দিল্লি জামে মসজিদ জায়গা করে নিয়েছে সকলের হৃদয়ে।

 

Feature Image: pinterest.com 
Reference:

01. Mughal Architecture. 
02. Delhi Jama Masjid. 
03. Jama Masjid Delhi.