রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের দৈনন্দিন ১০টি অভ্যাস

916
0
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

প্রায় এক শতাব্দী বেঁচে থাকা কম কৃতিত্বের কথা নয়। যদিও কার আয়ু কতটা আমরা কেউই সঠিকভাবে বলতে পারি না। ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ; যার পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। তার কৃতিত্বের দীর্ঘ তালিকায় এই মাইলফলক যোগ করে ফেলেছেন। রানি এলিজাবেথ ২১ এপ্রিল, ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ সালে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর ৪ মাস । বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ১৯২৬ সালে জন্ম নেওয়া একজন মহিলার বয়স শতবর্ষে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে মাত্র ৩.২% ৷  

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের রহস্য কি? প্রথমেই আসে মহান স্রষ্টার ইচ্ছা। তারপরে এর পেছনে থাকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দৈনন্দিন অভ্যাসগুলো যা তার সুস্থ  ও দীর্ঘ জীবনের রহস্য। রানির এই স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলি অনুসরণ করলে হয়তো রাজা-রানি হওয়া যাবে না, তবে তা দীর্ঘ ও সুখী জীবনযাপনে সাহায্য করতে পারে। 

রানি এলিজাবেথ শুধু দীর্ঘজীবীই ছিলেন না, সেই সাথে ছিলেন ব্রিটিশ ইতিহাসের দীর্ঘতম রাজশাসক। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এই বিশাল রাজদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ছিলেন সুস্থ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপ, ২০২১ সালে ৯৯ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পরে রানি নিজেও কোভিড -১৯ এর ঝাঁকুনিসহ একাধিক অসুখে ভুগেছিলেন। রানি গত মঙ্গলবার লিজ ট্রাসকে ইংল্যান্ডের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগও দিয়েছিলেন। 

রানি ২য় এলিজাবেথ ও নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস, Image source: npr.com

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দৈনন্দিন ১০টি  অভ্যাস 

রানি এলিজাবেথ এতদিন সুস্থভাবে বাঁচলেন কীভাবে? এক্ষেত্রে তার ভালো জীনগত বৈশিষ্ট্য এবং উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ সম্ভবত কাজ করেছে, তবে অনেকটা কৃতিত্ব তার স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের রহস্য জানতে তাই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দৈনন্দিন ১০টি অভ্যাস নিয়ে আজকের আলোচনা। 

সকালের নাশতা 

রানি এলিজাবেথের প্রাতঃরাশ গ্রহণ একটি নিয়মিত অভ্যাস ছিল। তার সকালের নাশতা সকাল ৮:৩০টায় দেওয়া হতো। সকালে পুষ্টিকর নাশতা গ্রহণের সাথে মানুষের দীর্ঘ জীবনের সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণা থেকে জানা গেছে, সকালের নাশতা খাওয়ার কারণে হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যায়। 

রানি এলিজাবেথ সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে তার প্রাতঃরাশে পালাক্রমে বিভিন্ন খাবার খেতেন। এর মধ্যে ছিল চা, বিস্কুট, সিরিয়াল, ফল, স্পেশাল কেক, ওটস, টোস্ট, মারমালেড ইত্যাদি। এই অভ্যাসটি সম্ভবত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের  সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের রহস্যের একটি। 

Queen Elizabeth II becomes second-longest serving monarch - BBC News
ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ,Image source:bbc.com

পোষাপ্রাণী পালন 

রানি এলিজাবেথ তার পোষা কুকুর করগিসকে খুব ভালোবাসতেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, পোষা প্রাণীর সান্নিধ্য বা মালিকানা রক্তচাপ কমায়, স্ট্রেস কমায়, কম অসুস্থ হওয়ার দরুন চিকিৎসা খরচ কমায়, হতাশা কমায় এবং স্থূলতার ঝুঁকি কমিয়ে স্বাস্থ্যকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। 

যেমন কুকুর, বিড়াল, পাখি, মাছ বা অন্যান্য কোন প্রাণী যারা বাড়িতে পোষেন তারা তাদের প্রিয় পোষা প্রাণীটির দেখভাল করতে গিয়ে যথেষ্ট সময়, শ্রম ও মনোযোগ দেন; যার ফলে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা ও রোগ-শোক থেকে মুক্ত থাকেন।  

windsor, england   february 04 queen elizabeth ii is joined by one of her dogs, a dorgi called candy, as she views a display of memorabilia from her golden and platinum jubilees in the oak room at windsor castle on february 4, 2022 in windsor, england the queen has since travelled to her sandringham estate where she traditionally spends the anniversary of her accession to the throne   february 6   a poignant day as it is the date her father king george vi died in 1952 photo by steve parsons wpa poolgetty images
রানি এলিজাবেথের প্রিয় পোষা প্রাণী করগিস, Image source :countryliving.com

অশ্বারোহণ 

খুব অল্প বয়স থেকেই রানি এলিজাবেথের জীবনে ঘোড়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তিনি ছিলেন দক্ষ অশ্বারোহী।  আসলে তিনি ঘোড়া এতটাই পছন্দ করতেন যে তার ছেলে প্রিন্স চার্লসকে বিয়ের উপহার হিসাবে একটি ব্রুডমেয়ার প্রজাতির ঘোড়া দিয়েছিলেন।

ঘোড়ায় চড়া মজাদার একটি কাজ পাশাপাশি এটি একটি দুর্দান্ত ব্যায়ামও, যা মানুষের মন ভালো ও মস্তিষ্ক তীক্ষ্ণ রাখতে পারে।  একটি আলঝেইমার গবেষণা অনুসারে, নিয়মিত ব্যায়াম হলো বার্ধক্য ঠেকানোর একটি মধুর উপায়। এক্ষেত্রে ব্যায়ামের ধরণটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, ব্যায়াম করাটাই মুখ্য। তেমনি রানির সুস্বাস্থ্যে অশ্বারোহণের মতো ব্যায়ামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।  

queen elizabeth horse balmoral scotland
অশ্বারোহী রানি এলিজাবেথ, Image source :townandcountrymag.com

চা পান 

রানি এলিজাবেথ তার দিন শুরু করতেন এক কাপ আর্ল গ্রে চা দিয়ে। অনেক ব্রিটিশের মতো, তিনি চিনি ছাড়া চা খেতেন তবে সেখানে দুধ চা হলেও আপত্তি করেননি। দৈনিক এক কাপ চা পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এটা দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ করে এবং শরীরের কোষ মেরামত করতে সাহায্য করে। 

গ্রীন টি বর্তমানে সুস্বাস্থ্যের জন্য অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে; কিন্তু আর্ল গ্রে-এর মতো কালো চায়েরও নানান উপকারী দিক  রয়েছে। মানুষের দীর্ঘায়ুর সাথে যুক্ত দুটি বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্য হলো ইমিউন সিস্টেম বাড়ানো এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো। আর এই দুটি সুবিধাই রয়েছে আর্ল গ্রে চায়ে। নতুন গবেষণা বলে লো ব্লাড সুগার এবং সুস্বাস্থ্যস্হ অন্ত্রের জন্য প্রতিদিন এটি পান করা উত্তম। 

চা পার্টিতে রানি এলিজাবেথ, Image source:timesofindia.indiatimes.com

বিকেলের নাশতা 

রানি এলিজাবেথ বিকেলের নাশতার জন্য পয়সার আকারের রাস্পবেরি জ্যাম স্যান্ডউইচ খেতেন। জানা গেছে এটা ছিল রানির পছন্দের খাবার। পুষ্টিবিদরা বলছেন যে, স্বাস্থ্যকর জীবনধারার মূল চাবিকাঠি হলো উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন না করে বরং সেগুলিকে সঠিকভাবে গ্রহণ করা।   

রানিও খাবার গ্রহণের ব্যাপারে এই নীতি মেনে চলতেন। যেমন তার প্রিয় স্যান্ডউইচগুলিকে “পেনি’স” বলা হতো। কারণ প্রতিটি স্যান্ডউইচ ছিল পুরানো ইংরেজি পেনির আকারের, প্রায় এক ইঞ্চি জুড়ে! 

Jam Penny
জ্যাম পেনি’ স স্যান্ডউইচ, Image source :lettoquotidiano.it

হাসিখুশি থাকা 

রানি এলিজাবেথ তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং শুষ্ক রসবোধের জন্য পরিচিত ছিলেন। প্রায়শই তার মুখে হাসি লেগে থাকতো। যেটা রানির বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়। রানির ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতরা শেয়ার করেছেন যে রানি ছিলেন কৌতুকপ্রিয়। মজার কোনো বিষয় রানি বেশ উপভোগ করতেন। 

হাস্যরস আমাদের মস্তিষ্ক এবং শরীরের জন্য একটি শক্তিশালী ওষুধ। এর ফলে মেজাজ ঠাণ্ডা থাকে, মানসিক চাপ কমে, সামাজিক বন্ধন উন্নত হয় এবং সেই সাথে দীর্ঘায়ু পাওয়া যেতে পারে। তাহলে সুস্বাস্থ্যের জন্য গোমড়ামুখো না থেকে একটু বেশি করে হাসির অভ্যাস শুরু করে জীবনটাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা যেতে পারে!  

সহাস্য রানি এলিজাবেথ, Image source: britannica.com

প্রেমময় দাম্পত্য  

প্রিন্স ফিলিপ এবং রানি এলিজাবেথের বিবাহিত জীবনও যেকোনো দম্পতির মতো উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে, তবে তারা কখনও চুড়ান্তভাবে কেউ কাউকে ছেড়ে যাননি। বরং তাদের সম্পর্ক অনেক গভীর ছিল বলে মনে হয়েছিল। তাদের মধ্যকার গভীর প্রেমময় দাম্পত্য সম্পর্কের ফলস্বরূপ তারা ৭৪ বছর সময় ধরে বিবাহিত ছিলেন! যা ছিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের আরেকটি রহস্য। 

গবেষণায় দেখা যায় সুখী দম্পতিদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কারণ দাম্পত্য জীবন সুখের হলে ঐসব দম্পতিদের ক্ষেত্রে তাদের শরীরের সঠিক ওজন বজায় রাখা, ব্যায়াম করা, ছুটি কাটানো, ভালো খাবার গ্রহণসহ মানসিকভাবে সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 

Elizabeth II | Biography, Family, Reign, & Facts | Britannica
প্রিন্স ফিলিপের সাথে বিয়ের দিনে রানি এলিজাবেথ, Image source:britannica.com

পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখা

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ধনীদের মাঝে পারিবারিক বন্ধন তথা আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্কের বন্ধনটা অনেকটা কম থাকে। কারো ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অনেক সময় জটিল হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ অহংকারবশত বা অন্যান্য কারণে সুসম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না। যদিও সব ধনীরা এক নয়। 

তেমনই নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এটা স্পষ্ট যে রানি এলিজাবেথের পারিবারিক সম্পর্ক তথা আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। রানির আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে যারা বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল তারা তার প্রয়োজনের সময় পাশেই ছিল। তার ছেলে এবং পরবর্তী প্রজন্মরা কিন্তু তার কাছাকাছিই থাকতো। যেটা পশ্চিমা বিশ্বে এখন কমই দেখা যায়।  

পরিবারের সাথে রানি এলিজাবেথ,Image source:britannica.com

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা মাদকাসক্তি ও ধূমপান করার মতো আপনার আয়ু কমিয়ে দিতে পারে। কিন্ত পারিবারিক বন্ধন এই একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতা দূর করে। আর এই বন্ধন আপনার জীবনে যেন আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। আর আনন্দে থাকলে নিশ্চয়ই আয়ু নিয়ে ভাববেন না! যদিও মৃত্যু যেকোনো সময়ই আসতে পারে।  

প্রকৃতিপ্রেম

বাগান করা এবং বাইরে ঘোরা রানি এলিজাবেথের দুটি প্রিয় শখ ছিল। বাগানে এবং বাইরে ঘোরার সময় রানীর অসংখ্য ছবি তোলা আছে যেগুলো এখন স্মৃতি হয়ে আছে। মোটকথা রানি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী।  

আর প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য সুসংবাদ যে গবেষণায় দেখা যায় বাগান করার শখ যাদের এবং যারা গাছপালা, পাহাড়, নদী, সাগরের কাছাকাছি থাকে ও ঐসব স্থানে প্রায়শই বেড়াতে যায় তাদের দীর্ঘায়ু পাবার সুযোগ বেড়ে যায়। একটি সমীক্ষা অনুসারে নির্মল প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে মানুষের স্ট্রেস হরমোন কমে যায়, হৃদস্পন্দন কমে, রক্তচাপ হ্রাস পায় এবং সুরক্ষা ও সুস্থতার অনুভূতি বাড়ে।    

নৌভ্রমণে রানি এলিজাবেথ,Image source:britannica.com

এছাড়াও, ইনডোর প্লান্ট বা গাছপালা ঘরে রাখা, ব্যালকনি বা রুফ গার্ডেনিং এবং বাড়িতে ফল-ফুলের বাগান করা আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করে-যেমনটা রানি এলিজাবেথ করেছিলেন ।

জনকল্যানমুলক কাজ 

রানি এলিজাবেথ যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর জনগণের সেবা করার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।  তিনি যে তার কাজ পছন্দ করেন সেটা তিনি দেখিয়েছেন! তিনি “ওয়াকঅ্যাবাউটস”-এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন যার মাধ্যমে  তিনি সারা বিশ্বের মানুষের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। রানি যেন সাধারণ মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন তার একটি উপায় হলো এই “ওয়াকঅ্যাবাউটস”। 

কাজের প্রতি এই আবেগ সম্ভবত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের আরেকটি রহস্য। আর আবেগী ব্যক্তিদের সাধারণভাবে আরও আশাবাদী এবং সুখী হতে দেখা গেছে। 

ওয়াকঅ্যাবাউটসে রানি এলিজাবেথ, Image source :britannica.com

 

Feature Image: britannica.com 
References:

01. https://www.eatthis.com/healthy-foods-queen-elizabeth-eats-every-day/
02. https://www.foodandwine.com/news/how-queen-elizabeth-impacted-what-we-eat-and-drink.
03. https://www.insider.com/queen-elizabeth-ii-dead-diet-exercise-health-longevity-2022-9?amp