এসডিজি ২০৩০: লক্ষ্য এবং কার্যক্রমের ব্যাপকতা

482
0
https://www.pngitem.com/pimgs/m/119-1190923_sustainable-development-goal-sdg-logo-hd-png-download.png

এসডিজি-এর এই লক্ষ্যমাত্রাকে এক কথায় বিবৃত করা যায় এভাবে, ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য উন্নত এবং টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করা। নিউইয়র্কে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলনে একটি চূড়ান্ত নথি হিসেবে গৃহীত হয়। যার প্রণেতা জাতিসংঘ। 

বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বলা চলে এই ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’কে। মূলত ২০১৫ সালে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন হবার শেষ সময় ছিল। এরপর জাতিসংঘ ২০১৫ থেকে শুরু করে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে এমন কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে নতুন একটি কর্মসূচি হাতে নেয়। যেটার নাম ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল।’  

এসডিজির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উন্নয়ন মনে করে না বরং সেই সাথে পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানব সম্পদ উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এই কর্মসূচিতে ১৭টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এবং ১৬৯টি ধারা রয়েছে। এছাড়া, প্রতিটি লক্ষ্যেই ৮-১২টি ধারা বর্তমান।  

সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের ১৭টি ধারা। Image Source: un.org

১. দারিদ্র্য বিলোপ 

‘সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্রতার অবসান’ হলো প্রথম লক্ষ্যের মূলমন্ত্র। আর এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমেই ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অভাব এবং দারিদ্রতার অবসান ঘটবে। এই লক্ষ্যকে সফল করতে ৭টি ধারা এবং ১৩টি সূচক রয়েছে।

পাঁচটি ফলাফল লক্ষ্য হলো: চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ; সমস্ত দারিদ্র্য অর্ধেক হ্রাস; সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন;  মালিকানা, মৌলিক সেবা, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক সম্পদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা; এবং পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা। 

উন্নয়নের এই অগ্রগতির ফলেও বিশ্বের জন্যসংখ্যার ১০ শতাংশ দারিদ্রের মধ্যে বাস করে। এমনকি চিকিৎসা, শিক্ষা এবং স্যানিটেশন-এর নূন্যতম চাহিদা পূরনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এবং ধারণা করা যাচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার কমাতে না পারলে দারিদ্রের সংখ্যা অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাবে! 

Image Source: miro.medium.com

২. ক্ষুধা মুক্তি

‘ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার’ স্লোগানকে সামনে রেখে এই লক্ষ্যের পথ চলা। ৮টি ধারা এবং ১৪টি সূচক রয়েছে এখানে। পাঁচটি ফলাফল লক্ষ্য হলো: ক্ষুধা নিবারণ এবং খাদ্যের প্রাপ্তি ব্যবস্থা উন্নত করা; সব ধরনের অপুষ্টির অবসান ঘটানো; কৃষি উৎপাদনশীলতা; টেকসই খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এবং স্থিতিস্থাপক কৃষি পদ্ধতি; বীজের জিনগত বৈচিত্র্য, গাছপালা চাষ করা এবং গৃহপালিত প্রাণী পালন; বিনিয়োগ, গবেষণা এবং প্রযুক্তি। 

 ৩. সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ

এসডিজি ৩ হলো ‘সকল বয়সী সকল মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ।’ এখানে রয়েছে ১৩টি ধারা এবং ২৮টি সূচক। ফলাফল লক্ষ্য রয়েছে ৯টি। সেগুলি হলো: মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস করা; পাঁচ বছরের কম বয়সী সকল প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু শেষ করা; সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা; অসংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যুহার হ্রাস নিশ্চিত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচার করা; মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করা; রাস্তার আঘাত এবং মৃত্যু হ্রাস করুন; যৌন এবং প্রজনন যত্ন, পরিবার পরিকল্পনা এবং শিক্ষার সার্বজনীন অ্যাক্সেস মঞ্জুর করুন; সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জন; এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক এবং দূষণ থেকে অসুস্থতা এবং মৃত্যু হ্রাস করে। 

৪. মানসম্মত শিক্ষা

মূল প্রতিপাদ্য ‘সকলের জন্য অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুনগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি।’ ৪টি ধারা এবং ১১টি সূচক রয়েছে। এবং ৭টি ফলাফল ভিত্তিক লক্ষ্য হলো-বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা; মানসম্পন্ন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় সমান প্রবেশাধিকার; সাশ্রয়ী মূল্যের কারিগরি, বৃত্তিমূলক এবং উচ্চ শিক্ষা; আর্থিক সাফল্যের জন্য প্রাসঙ্গিক দক্ষতা সহ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি; শিক্ষায় সকল বৈষম্য দূর করা; সর্বজনীন সাক্ষরতা এবং সংখ্যাতা; এবং টেকসই উন্নয়ন এবং বিশ্ব নাগরিকত্বের জন্য শিক্ষা। 

৫. লিঙ্গ সমতা

এসডিজি ৫ হলো ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন।’ 

৬. নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন

‘সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা’-এর মাধ্যমে অতিব গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ পানি প্রদানের নিশ্চয়তা নিয়ে কাজ করছে। 

ছয়টি ফলাফল ভিত্তিক লক্ষ্য এর মধ্যে রয়েছে: নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী পানীয় জল; উন্মুক্ত মলত্যাগ বন্ধ এবং স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রদান, জলের গুণমান উন্নত করা, বর্জ্য পানি পুনশ্চক্রীকরণ এবং নিরাপদ পুনঃব্যবহার, জল-ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি  এবং মিঠা পানির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, আইডব্লিউআরএম প্রয়োগ করা, জল-সম্পর্কিত বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধার। 

৭. সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি 

এসডিজি ৭ এর মাধ্যমে অর্জন করতে চায় ‘সকলের জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি সহজলভ্য করা।’ 

Image Source: islamicreporting.org

৮. শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

এসডিজি ৮ হলো ‘সকলের জন্য পূর্নাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি এবং স্থিতিশীল, অন্তর্বর্তীমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন।’ 

 ৯. শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো

এসডিজি ৯ এ রয়েছে, ‘অভিঘাতসহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়নের প্রবর্ধন এবং উদ্ভাবনার প্রসারণ।’ 

১০. অসমতার হ্রাস

অন্তঃ ও আন্তঃ-দেশীয় অসমতা কমিয়ে আনতে হবে। 

১১. টেকসই নগর ও জনপদ

এসডিজি ১১তে বলা হয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাতসহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তুলতে হবে। 

১২. পরিমিত ভোগ ও উৎপাদন

এসডিজি ১২ হলো, ‘পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদনধরন নিশ্চিত করা।’ 

১৩. জলবায়ু কার্যক্রম  

‘জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণ।’ জলবায়ু সংক্রান্ত কার্যক্রম এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে।

১৪. জলজ জীবন

এসডিজি ১৪ হলো ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার।’ 

 ১৫. স্থলজ জীবন 

স্থলজ বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে সচেতনা এবং লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা প্রদান এবং টেকসই ব্যবহারে পৃষ্ঠপোষণা, টেকসই বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ প্রক্রিয়ার মোকাবেলা, ভূমির অবক্ষয় রোধ ও ভূমি সৃষ্টি প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন এবং জীববৈচিত্র হ্রাস প্রতিরোধ।’  

১৬. শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান

‘টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার প্রচলন, সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিতাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ’ই হলো এসডিজি ১৬।  

১৭. অভিষ্ট অর্জনে অংশীদারিত্ব

এসডিজি ১৭ হলো ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব উজ্জীবনকরণ ও বাস্তবায়নের উপায়সমূহ শক্তিশালী করা।’ 

তালিকা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এসডিজি এর লক্ষ্যমাত্রা এবং কার্যকলাপ বেশ বিস্তৃত। আর একারনেই ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি কিছু সেক্টরের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় বেধে দেওয়া হয়নি।  

Image Source: sdgresources.relx.com

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন মাধ্যম। যার ফলে সকল তথ্য সংগ্রহে রাখা এবং সহজেই বোঝা সম্ভব। যেমন, ২০১৮ সালে জুনে চালু হয় এসডিজি ট্রাকার। যা সকল সূচক সহজেই উপস্থাপন করার সক্ষমতা রাখে। যদিও ২০২০ সালের করোনা মহামারি এসডিজি’র এই ১৭টি লক্ষ্যের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। 

এখন আসা যাক ইউএন এর এই কার্যক্রম বাংলাদেশের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেই হিসাবে। বাংলাদেশের জন্য এই গোল পূরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতোপূর্বে, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল যে কয়টি হাতে গোনা রাষ্ট্র অর্জন করতে পেরেছিল তার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল অন্যতম। এই কারণে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে। 

Image Source: sdg.gov.bd

এতে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতি নির্ধারকরা পরিবর্তিতে প্রণীত সাসটেইনেবল বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে দেশের সিভিল সার্ভিসের অন্যতম প্রধাণ উদ্দেশ্যে পরিণত করেছে। সরকারের প্রায় প্রতিটি মন্ত্রনালয়, অধিদপ্তর, অধিশাখা থেকে স্থানীয় পর্যায়ে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ এই উদ্দেশ্যগুলো অর্জনে মরিয়া হয়ে কাজ করছে। যদিও এ কাজের জন্য সরকারকে প্রচুর পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। 

আপাতত দৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও বাংলাদেশ সরকারের নিরলস চেষ্টার মাধ্যমে, ২০৩০ নাগাদ এমডিজির মত এসডিজিতেও বাংলাদেশ অন্যতম সফল উদাহরণ হিসেবে পরিগনিত হবে আশা করা যায়। 

 

Feature Image: un.org 
References: 

01. Sustainable Development Goals. 
02. SDG Goals. 
03. UN Goals.