তুলির আঁচড়ে নানা রঙের পসরা বসে ক্যানভাসে। শিল্পীর কল্পনার সব রঙ একে একে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করে। সবশেষে নতুন এক টুকরো বিস্ময় মেলে ধরে দর্শকের চোখে। এই সৌন্দর্যে মজে যায় সে। আর শিল্পী পড়ে রয় অপাংক্তেয় হয়ে। বহু শিল্পী তার জীবদ্দশায় নিজের সাফল্য দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেননি। দারিদ্র্য, অনাহার আর অবহেলায় নিদারুণ অর্থ কষ্টে কাটিয়েছেন সারাটা জীবন। ভ্যান গগ ছিলেন সেই দুর্ভাগা চিত্রশিল্পীদের একজন।

পুরো নাম উইলিয়াম ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। তিনি ছিলেন ছয় সন্তানের মধ্যে প্রথম। তিনি ১৮৫৩ সালের ৩০ মার্চ নেদারল্যান্ডসের জুনদার্তে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন থিওডোরাস ভ্যান গগ এবং মা ছিলেন আনা কারবেনটাস ভ্যান গগ। তার পিতামহ, বড় ভাই এবং পরবর্তীতে ভাই থিওডোর ভ্যান গগের ছেলের নামও রাখা হয় ভ্যান গগ। সে হিসেবে তার পরিবারে মোট চারজন ভ্যান গগ ছিলেন।

জীবন ও জীবিকার খোঁজে বহু চড়াই উতরাই পেরিয়েছেন তিনি। বহু পেশায় জড়িয়েছেন। কিন্তু থিতু হতে পারেননি কোনোটাতেই। ১৬ বছর বয়সে তিনি তার চাচার অংশীদারীর ব্যবসা গুৌপিল অ্যাণ্ড কোং-এ শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ধর্মযাজক, স্কুল শিক্ষক, খনি শ্রমিক কি না করেছেন? তবে চিত্রশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাতাশ বছর বয়সে।

রেড ভাইনইয়ার্ড। Image Source: vincentvangogh.org

জীবনের প্রথমদিকের চিত্রকর্মগুলোতে রঙের ব্যবহার ততটা দেখা যায় না। দারিদ্র্য আর নিদারুণ পৃথিবীর কষ্টের চিত্রগুলো তিনি ফুটিয়ে তুলতেন পরম যত্নে। তার আঁকা ছবিগুলোতে অতটা ডিটেইলড কাজ দেখা যায় না। তিনি প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন তবে তার পর্যবেক্ষিত বস্তু হুবহু অনুকরণ করতেন না।

তার মানে এই নয় যে তার ছবিগুলো যত্ন নিয়ে আঁকা হয়নি। বরং ছবিগুলোতে ফুটে উঠেছে তার সচেতন অভিব্যক্তি আর গভীর পর্যবেক্ষণ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নানা জটিলতায় ভুগেছেন। কারো কারো মতে তিনি স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়া, তার এপিলেপ্সি ও বাইপোলার ডিসঅর্ডারও ছিল। তার চিত্রকর্ম সম্পর্কে তিনি বলতেন,

আমি স্বপ্নে আমার চিত্রকর্ম দেখি
তারপর ক্যানভাসে আমার স্বপ্ন আঁকি।

পল গাউগুইন ছিলেন গগের সময়কার একজন নামকরা চিত্রশিল্পী। ১৮৮৮ সালে তাদের পরিচয় হয়। গাউগুইন আর গগ একসাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ২ মাস। তারা দু’জনেই একে অপরের চিত্রকর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। থিওর কাছে লেখা গগের একটি চিঠিতে এই সম্পর্কে জানা যায়। দুজনের সম্পর্কে তিক্ততা আসে একটি ঘটনার পর।

এই কথা সত্য যে গগ তার চিত্রকর্মের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে। তবে সব থেকে বেশি অনুপ্রেরণা তাকে দিয়েছিল জীবন আর প্রকৃতি। নিজের দেহাবয়ব নিয়ে হীনমন্যতা আর প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন।

ড. গ্যাশের চিত্রকর্ম। Image Source: vincentvangogh.org

কখনোই সেই অর্থে কোথাও থিতু হতে পারেননি। কারো সাথেই তার সুসম্পর্ক টেকসই হয়নি। নিজের প্রতি বিদ্বেষটা এক সময় ছড়িয়ে পড়েছে আশে পাশের মানুষের উপর। পল গাউগুইনের সাথেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। কোনো একটা বিষয় নিয়ে তাদের তর্ক হচ্ছিল। তর্কের এক পর্যায় তিনি ক্ষুর নিয়ে গগকে তাড়া করেন।

কথিত আছে, পলই গগের কান কেটে ফেলেছিলেন। কাটা অংশ মুড়িয়ে তা পাঠিয়ে দেন এক পতিতার কাছে যার কাছে গগ এবং পল দু’জনেরই যাতায়াত ছিল। উক্ত পতিতা নাকি মজার ছলে একবার গগের কানের প্রশংসা করেছিল। তাই তার কাছে এই অদ্ভুত উপহার প্রেরণ করেন পল।

জীবদ্দশায় প্রায় ২১০০ ছবি এঁকেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ৮৬০টি হচ্ছে তৈলচিত্র। তবে বিক্রি করতে পেরেছিলেন কেবল একটি। ছবিটির শিরোনাম-রেড ভাইনইয়ার্ড। তার সবচেয়ে দামী ছবি হচ্ছে-আ পোট্রের্ট অব ডক্টর গ্যাশে। হুইটফিল্ড উইথ দ্য ক্রস তার আঁকা সর্বশেষ ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

Sunflower Series. Image Source: BBC

তিনি একই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। তার আঁকা সানফ্লাওয়ার সিরিজের ছবির সংখ্যা ১২টি। যদিও এগুলো প্রথাগত নিয়মনীতি মেনে আঁকা নয়। বরং তার ব্যক্তিগত পছন্দই ছবিগুলোতে ব্যক্ত হয়েছে। নিজের স্বাধীনচেতা মনোভাব তিনি নিভৃতে ফুটিয়ে তুলে গেছেন তার চিত্রকর্মগুলোতে।

আমন্ড ব্লোজমস নামের বিখ্যাত ছবিটি তিনি এঁকেছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্মদিন উপলক্ষ্যে। তার অসংখ্য কাজের মধ্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। গগ পরিবার এই ছবিটি পরম যত্নে নিজেদের কাছে আগলে রেখেছিলেন।

আমন্ড ব্লোজমস। Image Source: Van gogh museum

তার সব থেকে জনপ্রিয় ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয় স্টারি নাইটকে। তবে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই ছবিটি তিনি একেঁছিলেন জীবনের খুব কঠিন একটি সময়ে।

১৮৮৮ সালে শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটলে তিনি নিজের ইচ্ছেতেই ফ্রান্সের সেইন্ট রেমি-ডি স্টেটের আশ্রমে যান।

সেখানে তিনি এক বছরের মতো অবস্থান করেন। স্টারি নাইট ছবিটি তিনি এঁকেছিলেন শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা রাতের প্রকৃতি দেখে। এই বিখ্যাত ছবিটি মেট্রোপলিটন আর্টস মিউজিয়াম সংরক্ষণ করেছে।

স্টারি নাইট। Image Source: van gogh museum

চিত্রকর্মের পাশাপাশি তার চিঠিগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি প্রায় ৮০০ চিঠি লেখেন৷ এর মধ্যে ভাই থিওর কাছে লেখা চিঠির সংখ্যাই বেশি।

চিঠিগুলো মামুলি কোনো জিনিস নয়। বরং এগুলোর মাধ্যমে তার জীবনের অনেক অজানা অধ্যায়ের খোঁজ পাওয়া যায়। জীবনের নানা জটিল অধ্যায় পার করেও তিনি আমাদের অসাধারণ সব চিত্রকর্ম উপহার দিয়ে গেছেন।

সারা জীবন অস্তিত্বের লড়াই চালিয়ে গেছেন। তার এই মানসিক অবস্থায় পাশে ছিলেন ড. গ্যাশে। তিনিই তার চিকিৎসা করছিলেন। আর গগের কাছে তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তার পোট্রের্ট তিনি খুব যত্ন করে এঁকেছিলেন। তবে গ্যাশে শেষ রক্ষা করতে পারেননি।

ভ্যান গগের চিঠিপত্র। Image Source: van gogh museum

১৮৯০ সালে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে একদিন তিনি ক্যানভাস নিয়ে গম ক্ষেতে যান। সেখানে তিনি নিজেই বুকের মধ্যে গুলি করে বসেন। পরবর্তীতে অবশ্য কোনোভাবে তিনি গ্যাশের কাছে ফিরে আসেন। এর ক’দিন পর তিনি মারা যান।

গগের মৃত্যুসংবাদ থিও মেনে নিতে পারেননি। একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। ছয় মাসের ভেতর তিনিও মারা যান। তাকে ভাইয়ের পাশে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি তার কর্মের জন্য তুমুল জনপ্রিয়। তার ছবিগুলো নতুন করে আবার সাড়া ফেলেছে।

ফ্যাশন, লাইফস্টাইল সব জায়গায় গগের জয়জয়কার। পোস্ট ইম্প্রেশনিজমকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। ব্যর্থ একটা ব্যক্তিগত জীবন পার করে সফল এই চিত্রশিল্পী এক রকম অভিমান করেই চলে গেছেন। ফেলে গেছেন তার অসামান্য সব সৃষ্টি।

 

Feature Image Source: www.vangoghmuseum.nl 
Reference:

01. Vincent Van Gogh. 
02. Vincent Van Gogh.
03. Vincent Van Gogh.