এই বুঝি লেগে গেলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ !
এমন ধারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই দেখা যেত। যদিও বর্তমান দুনিয়ায় দুটো বড় দেশের যুদ্ধ লাগা প্রায় অকল্পণীয় এক বিষয় বলা চলে।
হয়তো রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সরাসরি সমরাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে আমেরিকা-রাশিয়া না জড়ালেও পরোক্ষভাবে ইউরোপ আমেরিকার সাথে এক যুদ্ধ রাশিয়া করেই চলেছে।
অনেকে বলবে, তৃতীয় একটি দেশে দুই পরাশক্তির এমন যুদ্ধ আগেও মধ্যপ্রাচ্যে দেখা গিয়েছে। কিন্ত সেটা কি রাশিয়ার একদম বর্ডারে হয়েছিল? একদমই না!
রাশিয়া ইউক্রেনের এই যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে এক অস্থিতিশীল অবস্থানে ফেলে দিয়েছে। একে তো করোনা ভাইরাসের তোপে বিশ্ব ছিল পঙ্গু প্রায়, এই অবস্থা উত্তরণ করতে না করতেই লেগে গেল এমন এক যুদ্ধ যা কেউ হয়তো কল্পনাই করতে পারেনি।
তো ইউক্রেনকে কেনই বা রাশিয়া আক্রমণ করলো? কি কি প্রভাব এর ফলে পড়েছে? আজকের আয়োজনে এসব আলোচনা করারই চেষ্টা করা হবে।
ইতিহাস
ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ যার সাথে রাশিয়া, বেলারুশ ,পোল্যান্ড-এর বর্ডারের সাথে সাথে এর উপকূলে রয়েছে কৃষ্ণসাগর।
পূর্বে এদেরকে রুস ভাইকিং (Rus Viking) বলা হতো যারা দাস ব্যবসা করতো। পরে এদেরকে স্লাভস (Slavs) নাম দেয় বলে জানা যায়। এজন্য আজ পূর্ব ইউরোপের জনগণকে স্লাভিক পপুলেশন নামেও ডাকা হয়।
সে যাই হোক, তৎকালীন সময়ে ইউক্রেনের বর্তমান রাজধানী কিয়েভ রাশিয়ান সাম্রাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এই সাম্রাজে নানা ভাষার দেশের ভাগ দেখা যায়। ভাষা একটি আলাদা পরিচয় বহন করে। তাই কিয়েভের এই অঞ্চলটিতে মূল রাশিয়া থেকে একটু আলাদা ধাঁচের সংস্কৃতি দেখা যায়। আস্তে আস্তে তাদের এই সংস্কৃতি নিজস্বতা পেতে থাকলে তারা তাদের আলাদা পরিচয় দিতে শুরু করে। আর এভাবেই ইউক্রেন অর্থাৎ মূলত দেশটির পূর্ব অংশ রাশিয়ার থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। যদিও তাই বলে এটি বলা যাবে না যে তারা সম্পূর্ণভাবে রাশিয়ান পরিচিতি প্রত্যাখ্যান করে।
১৯২১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা লাভ করলো তখনো দেখা যায় যে ইউক্রেনকে এক আলাদা প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দিতে দেখা যায়। কারণ এর আলাদা গুরুত্ব ছিল। তবে ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় তখন থেকে ইউক্রেন সম্পূর্ণরুপে এক স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে যার দরুণ আজ রাশিয়ারই সাবেক শাসিত এই দেশটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
তাহলে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের এক সম্পর্ক পূর্ব থেকেই বিদ্যমান যার কারণে প্রেসিডেন্ট পুতিন এক ভাষণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলেও আখ্যা দেন।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সাথে ভূ রাজনীতির মিশ্রণ
বেলারুশ ও ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার জন্য বাফার রাষ্ট্র (Buffer State)। এর পূর্বে লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়ার মতো দেশগুলোকেও রাশিয়া বাফার রাষ্ট্র করতে চাইলেও তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে যায়।
মূলত ইউরোপ থেকে সরাসরি কোন আঘাত না পাওয়ার কৌশল হিসেবে রাশিয়া সবসময়ই ইউক্রেন আর বেলারুশকে তাদের আয়ত্তে রাখতে চেয়েছিল। বেলারুশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও বর্তমানে ইউক্রেন তার বাইরে।
আবার ইউক্রেনে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস এবং বিভিন্ন শস্য উৎপন্ন হয়। তাই অর্থনৈতিক বিবেচনাটিও এখানে মুখ্য।
রাশিয়া ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও কয়েক বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হতে চাচ্ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানের ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নে রাশিয়া ইউক্রেনকে যুক্ত করতে চাইলে তারা সেটি প্রত্যাখ্যান করে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নও যখন তাদেরকে অবাধ বাণিজ্যের কথা বলে তখনও সেটি ইউক্রেন গ্রহণ করেনি।
তাহলে দেখা যায় যে, ইউক্রেন পশ্চিমা দেশগুলো এবং রাশিয়ার মাঝে এক মাঝামাঝি অবস্থানে ছিল। যদিও বিভিন্ন সময় নতুন শাসক আসার পর তা একটু এদিক-সেদিক হচ্ছিল। ইউক্রেনের এই অবস্থায় ২০০৪ সালে এক ধারাবাহিক প্রতিবাদের শুরু হয়। মূলত নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বিরোধীরা এই প্রতিবাদ করে যা আস্তে আস্তে সাধারণ মানুষের কাছেও ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশ অভ্যত্থানের গর্জনে ফুটে উঠলে হাই কোর্টের আদেশে ইয়ানুকোভিচের পরিবর্তে ইউশচেঙ্কোকে নির্বাচিত করা হলে এই গণঅভ্যুত্থান শেষ হয়। যদিও কেউ কেউ এটিকে সিআইএ অর্থাৎ আমেরিকার মদদে হয়েছিল বলে দাবি করেন, তবে এর শক্ত কোন প্রমাণ নেই।
কিন্ত ২০১০ সালে আবার ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্টের পদে বসেন। তিনি মূলত পুতিনের ঘনিষ্ঠ হলেও রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ভারসাম্য এক অবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। পূর্বেই বলেছি যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে অবাধ বাণিজ্যের চুক্তিতে যুক্ত করতে চেয়েছিল। সেই চুক্তি এই ইয়ানুকোভিচই নাকচ করে দেন।
ইয়ানুকোভিচ প্রায় চার বছর ক্ষমতায় থাকেন। তার আমলে হওয়া অনিয়ম দুর্নীতির জন্য তাকেও পদ ছাড়তে হয়। এরপর সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট বদলে যেতে শুরু করে।
যেই ইউক্রেন পূর্বে রাশিয়ার মদদে চলছিল, সেই ইউক্রেনে নির্বাচিত হয় ইউরোপ পন্থী সরকার।
এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, পূর্ব ইউক্রেনে ইউক্রেনিয় জাতীয়তাবাদী জনগণ থাকলেও পশ্চিম ইউক্রেনে রাশিয়াপন্থী জনগণ রয়েছে যারা রাশিয়ান পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
ইউক্রেন যে রাশিয়ার হাত থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সেটি রাশিয়া বুঝতে পেরে তারা পশ্চিম ইউক্রেনে মুখোশধারী সৈন্য পাঠায় যদিও তারা বিষয়টি অস্বীকার করে। এতে করে সেখানে ইউক্রেন বাহিনী এবং সেই রাশিয়ান বাহিনী যাদেরকে শান্তিরক্ষী বলা হচ্ছিল তাদের সাথে যুদ্ধ লেগে যায়। লুহানস্ক এবং দোনেস্ক অঞ্চল নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যদিও ২০২২ সালের এই যুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাশিয়া এই দুই অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেয়নি কৌশলগত কারণেই।
এভাবেই ২০১৪ সালে রাশিয়া পুরো বিশ্বকে অবাক করে ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নিজেদের অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে।
তাহলে বুঝাই যাচ্ছে, বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধটি কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন কোন যুদ্ধ নয় এর অনেক বিরাট কারণ আছে।
কিন্ত এখন প্রশ্ন আসে যে, তাহলে এখনই কেন ইউক্রেনকে আক্রমণ করতে হলো?
এখনই কেন এই আক্রমণ?
ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার নজর পূর্বে থেকে ছিল তার প্রমাণ খুব সহজেই পাওয়া যায়। তবে এখন আক্রমণ করার মূল কারণ হিসেবে বলা যায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনিস্কির ন্যাটোতে যোগ দেওয়া আকাঙ্খা। ন্যাটো হচ্ছে পশ্চিমা সামরিক একটি জোট যাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে সামরিকভাবে সহায়তা করে।
রাশিয়ার মূল উদ্বেগ হলো, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে রাশিয়ান বর্ডারেই ন্যাটোর সামরিক অস্ত্র মোতায়েন থাকবে যা প্রতিরক্ষার জন্য আশংকাজনক।
কয়েকবার তারা ইউক্রেনকে এই ব্যাপারে সতর্ক করলেও তাদের অদম্য ইচ্ছা দেখে রাশিয়া বাধ্য হয়ে এই আক্রমণ করেছে বলে জানা যায়। অর্থাৎ এখানে আত্নরক্ষার বিষয়টি যুক্ত।
এছাড়াও অনেকে দাবি করেন যে, পুতিন তার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই এই আক্রমণ করেছে। তার জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে বিধায় যুদ্ধ দ্বারা এটির মোড় ঘোরানোর চেষ্টা তিনি করেছেন।
প্রভাব
রাশিয়ার উপর আমেরিকা, ইউরোপ নানা নিষেধাজ্ঞা দিলেও যুদ্ধের প্রভাব থেকে কেউই বাঁচছে না। মূলত এটি তেল রপ্তানি এবং খাদ্যের সংকট সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনের গম, সূর্যমুখী তেলের উপর অনেকেই নির্ভর করে। আবার রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার দরুন তেল রপ্তানি বন্ধ বা ব্যাহত অবস্থা তো রয়েছেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুলাই মাসে তাদের গ্যাসের চাহিদা ১৫ শতাংশ কমালেও তা তেমন একটা কাজে দিচ্ছে না।
বাংলাদেশকেও এই যুদ্ধ প্রভাবিত করেছে। তেল, গ্যাস আমদানিতে কয়েক গুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এর ফলে বাজারে সব কিছুর দামও বৃদ্ধির দিকে।
রাশিয়া ইউক্রেনের এই যুদ্ধের মেয়াদ যত বাড়বে ততই অবস্থা বেগতিক হবে বলে ধরে নেওয়াই যায়। এই যুদ্ধে সরাসরি কেউ না জিতলেও আমেরিকান অস্ত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যে চরম লাভবান হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দিন শেষে হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়েই তারাই সেই জয়লাভ করে হয়তো তৃপ্তি পায়।
Feature Image : Bloomberg
References