ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউরোপ মহাদেশের একটি অনন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোট হিসেবেও পরিচিত। পারস্পরিক স্বার্থে শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে নিজেদের পণ্যের জন্য সুলভ বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্ম। ইউরোপের বেশিরভাগ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত আসে এই জোট থেকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৭টি সদস্য দেশের একটি ঐক্যবদ্ধ বাণিজ্য ও আর্থিক সংস্থা। এই সংস্থার মাধ্যমে বেশিরভাগ ইইউ সদস্য দেশের মধ্যে সমস্ত সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দেয়। ফলে খোলা সীমান্তের মাধ্যমে পণ্য এবং মানুষের অবাধ প্রবাহের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। অবাধে চলাচলের সুযোগ থাকলেও নিরাপত্তা কর্মী বা পুলিশ দিয়ে চেক করা হয়ে থাকে যদিও তা সীমান্তবর্তী স্থানে যতটা কড়াকড়ি হয়ে থাকে ততটা নয়।
কোনো রকম শুল্ক ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মধে পণ্য সামগ্রী আমদানি এবং রপ্তানি করতে পারে। যা ইইউ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অন্যতম একটা সুবিধা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবাদ তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। শুরু হয় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন সংকট। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কেউ কেউ একাত্বতার গুরুত্ব অনুভব করেন। এর ফলেই ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলোকে নিয়ে একটি জোট বা সংস্থা গঠন করার প্রয়োজন অনুভব করে অনেকেই।
তারই ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ঘটনার প্রবাহে সৃষ্টি হয় বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইইউ গঠনের পূর্বে স্বাক্ষরিত কিছু চুক্তি বিশেষভাবে বেগ মান করে ইইউ সংগঠিত হওয়াকে। যেমন, ১৯৫৭ সালের ২৫ মার্চ বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডসের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; যা রোম চুক্তি নামে পরিচিত।
১৯৫৮ সালের ১ জানুয়ারি European Economic Community (EEC) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চুক্তিটি কার্যকর হয়। ১৯৯৩ সালে EEC এর নাম পরিবর্তন করে European Community (EC) করা হয়।
ম্যাস্ট্রিচট চুক্তি: অন্য একটি চুক্তি হলো ম্যাসট্রিচট চুক্তি (Maastricht Treaty) যেটি ১৯৯২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডস এর ম্যাসট্রিচট শহরে স্বাক্ষরিত হয়। এবং আনুষ্ঠানিকভাবে European Union (EU) প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ১ নভেম্বর, ১৯৯৩ সালে চুক্তিটি কার্যকর হয়।
বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রর সংখ্যা ২৭টি। যথা-অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্লোভানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্পেন এবং সুইডেন।
তবে সাইপ্রাস ভৌগলিকভাবে ইউরোপের অংশ না হয়েও ইইউ-এর সদস্য। গ্রিসের সহায়তায় এবং একই ধরনের সংস্কৃতির কারনে সাইপ্রাস সদস্যপদ অর্জন করে।
ইইউ-এর রাজধানী হিসেবে ব্রাসেলস, ফ্রান্সের স্টারবার্গ, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং লুক্সেমবার্গ সিটি হিসেবে পরিচিত। তবে ইইউ এর মূল পার্লামেন্ট বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোর্ট অব জাস্টিসের অবস্থান লুক্সেমবার্গ সিটিতে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেন্ট্রাল ব্যাংক জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে অবস্থিত। এছাড়া, ইউরোপীয় কাউন্সিল থেকে শুরু করে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদর দপ্তর ফ্রান্সের স্ট্রারবার্গ শহরে অবস্থিত।
শুধুমাত্র ইউরোপ মহাদেশে না, ইইউ সারা বিশ্বে তাদের প্রভাব দিন দিন বাড়িয়ে চলেছে। এবং বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যতম প্রভাবশালী নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নয়। শান্তি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ইইউ তাদের শক্তিশালী একটা ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে বিশ্ববাসীর কাছে ইইউ পরিনত হয়েছে আস্থার প্রতীক হিসেবে।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক এবং সৌহার্দ্য রক্ষাতেও ইইউ-এর সফলতা প্রায় শতভাগ। বিশেষত ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা গ্রেট ব্রিটেন-এর মতন দেশগুলো যাদের সম্পর্ক বেশ সংবেদনশীল, তাদের মধ্যকার শীতলতা দূর করতে ইইউ এর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর এই বহুমুখী শান্তি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমের কারণেই ২০১২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করে এই সংস্থাটি। এছাড়াও, ইউরোপের পিছিয়ে পড়া, অনুন্নত দেশগুলোকে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা। সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ইইউ-এর কার্যক্রম বিশেষভাবে প্রতীয়মান।
শেনজেন চুক্তির ফলে একজন ইউরোপীয় নাগরিক নিজের ইচ্ছা এবং প্রয়োজন মতন ইউরোপের যেকোনো দেশে পাসপোর্ট এবং ভিসা ছাড়া যাতায়াতের সুযোগ লাভ করে। এমনকি স্থানীয়ভাবে বসবাসও করতে পারে। শুধু বসবাস না, চাকরি বা যেকোনো ব্যবসাও করতে পারে তারা।
উল্লেখ্য, শেনজেন চুক্তি অবাধ চলাচল সংক্রান্ত একটি চুক্তি। ১৪ জুন, ১৯৮৫ লুক্সেমবার্গের শেনজেন শহরে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৫ সালের ২৬ মার্চ চুক্তিটি কার্যকর হলে ভিসা মুক্ত ইউরোপ যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ইউরোপের ২৬টি দেশ শেনজেন এলাকাভুক্ত। যথা-
- ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২২টি দেশ (আয়ারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, সাইপ্রাস এবং ক্রোয়েশিয়া ব্যতিত)
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন বহির্ভূত ৪টি দেশ (আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং লিখটেনস্টেইন)
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে হলে কিছু শর্ত পূরন করতে হয়। এর মধ্যে কিছু আছে বাধ্যতামূলক। যা অবশ্যই ইইউ সদস্য দেশগুলোকে মেনে চলতে হবে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গ রাজ্যগুলো নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষ আইস পাশ করতে পারে। তবে তা ফেডারেল গভর্নমেন্ট-এর সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না, অন্য দেশগুলোও আইন পাশ করতে পারবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে তা যেন ইইউ-এর নিয়ম বা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।
অনেক অনেক ভালো কাজ এবং প্রশংসা থাকলেও বর্তমানে ইইউ এর বেশ কিছু কাজ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যেমন-ব্রেক্সিট ইস্যু। এছাড়া, ইউরোপের দেশগুলোতে কট্টরপন্থী দলগুলোর ক্ষমতা গ্রহন ও বিশ্ববাশী সুনজরে দেখছেন না। কারণ এতে করে বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ফলে এসব ব্যাপারে ইইউ কতটা তার ভূমিকা পালন করছে সেটাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে ইইউ-এর কারণেই ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষকে এক কাতারে আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে তারা নিজেদের প্রয়োজনে একে অন্যের পাশে অবস্থান নিতে পারছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহনে ইইউকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে, যা লক্ষ্যনীয়। এছাড়া, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিদায়, ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোকেও ইইউ ত্যাগ করার ব্যাপারটাকে উস্কে দিতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। আর একারণেই ভবিষ্যতে যেন যুক্তরাজ্যের মতন ঘটনা না ঘটে সে কারনে সকল দেশের সমান অংশগ্রহণ জরুরি।
বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর কার্যক্রম এবং এর প্রভাব অন্যান্য দেশ বা সংস্থার উপর বেশ শক্তিশালী। এবং শুধুমাত্র ইউরোপের দেশগুলোর উপরই না; এর প্রভাব সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশ এবং দেশের নাগরিকের উপর ইইউ এর যে কোনো কার্যকলাপ-এর প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাই বিশ্ব শান্তি এবং সমৃদ্ধির স্বার্থেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর উচিত প্রতিটি পদক্ষেপ অতি বিচক্ষণতার সাথে গ্রহন করা।
Feature Image: pinterest.com References: 01. European-Union. 02. What is the European Union how it works and history. 03. History of the European Union. 04. History of the european union.