একবার ভেবে দেখুন তো, বাবা যদি বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপতি হোন তবে সন্তানের আচরণ কিংবা প্রাত্যহিক জীবন কেমন হতে পারে? প্রায় সবাইই হয়তো নিজেকে প্রচারে রাখতে চাইবে। কিংবা বাবারই মতো রাজনীতিতে পা রেখে নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবেই গড়ে তুলতে চাইবে।
সেখানে চীনের মতো একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কন্যা হয়েও নিজেকে আড়ালে রেখেছেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাও ছদ্মনামে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর এই কন্যার নাম শি মিংজে। আবার জিয়াও মু জি নামেও পরিচিত তিনি। তার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনাই হবে আজকের আয়োজনে।
কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির সন্তান মানেই বাবা-মার পরিচয়ের সদ্ব্যবহার করা। সেই পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে কেউ এগিয়ে যায় নিজের জীবনে, সমাজ কল্যাণে। আবার কেউ কেউ ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; সচরাচর এমনটাই দেখা যায়। শাশা ওবামা, ইভাঙ্কা ট্রাম্প প্রমুখসহ প্রায় সর্বত্রই এটা লক্ষণীয়।
কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠও আছে। চীনের প্রেসিডেন্ট কন্যা মু জি সেই ব্যতিক্রমী উদাহরণ। দাদা জি ঝোংজুন ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা। আর বাবা শি জিনপিং বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সেই পরিবারের সদস্য হয়েও নিজেকে রেখেছেন আড়ালে। এতটাই নমনীয় ছিলেন যে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশ থেকে পড়াশোনা করেছেন অথচ বন্ধুরা অবধি টের পায়নি তার আসল পরিচয়।
জন্ম পরিচয়
শি জিনপিং ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী, লোকসংগীত শিল্পী পেং লিউয়ানের একমাত্র মেয়ে জিয়াও মু জি। তার জন্ম ১৯৯২ সালের ২৭ জুন। চায়না টাইমস এর তথ্যমতে, চীনের অন্যতম কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও সাবেক রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, দাদা শি ঝোনজুন নাতনির নামকরণ করেন।
প্রসঙ্গত, মু জি-র মা পেং বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী ছিলেন। এমনকি বিয়ের সময় স্বামীর চেয়েও তার খ্যাতি বেশি ছিল তার। জন্মের কিছু সময় পরই মু জি স্পটলাইটের বাইরে চলে যান। পারিবারিক গোপনীয়তার স্বার্থে প্রকাশ্যে আসার আগ অবধি নব্বইয়ের দশকের কিছু ছবি ছাড়া অন্য কোনো ছবিও পাওয়া যায় নি মু জির।
পড়াশোনার প্রথম পাঠ
পড়াশোনার শুরুতেই হ্যাংঝো বিদেশি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ফরাসি ভাষা শেখেন মু জি। এরপর চীনেই আন্ডারগ্র্যাজুয়েশন-এর পড়াশোনা সম্পন্ন করলেও উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে অবস্থিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তিনি। ২০১০ সালে ভর্তি হন মনস্তত্ত্ব ও ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে।
তবে সেখানে ভর্তি হলেও ২০১৫ সালে সবার সামনে আসার আগ অবধি অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করেন তিনি। প্রকাশ্যে আসার আগে অল্প কয়েকজন শিক্ষক এবং ক’জন বন্ধু তার আসল পরিচয় জানতে পারেন। আর সে সংখ্যাটাও দশ এর কম ছিল।
গোপনে স্নাতক সম্পন্নকরণ
পরিচয় আড়াল করলেও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত থাকতেন মু জি। ২৪ ঘন্টাই চীনা দেহরক্ষী দ্বারা আবৃত চাদরে থাকতেন মু জি। গোপনীয়তা রক্ষায় খুব একটা বাইরে যেতেন না এমনকি মিশতেনও না সবার সাথে।
খুব অল্প কয়জন বন্ধুই ছিল তার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও উপস্থিতি না থাকায় তার ছদ্মনাম ব্যবহারে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। বাইরে ছবি না যাওয়ায় কেউ টেরই পায়নি তার আসল পরিচয়।
তবে ২০১২ সালে তার পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। একই বছরের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যের ‘মেইল অন সানডে’-র একজন সাংবাদিক মু জি কে চেনেন এমন কয়েকজন বন্ধুর খোঁজ পান এবং ছবিসহ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন যা চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০১৪ সালে স্নাতক সম্পন্ন করে বেইজিং প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।
কেন গোপন জীবনযাপন
মূলত পারিবারিক কারণেই আড়ালে থেকে শিক্ষাজীবন কাটিয়েছেন মু জি। তিনি যখন হার্ভার্ডে যান তার বাবা শি জিনপিং তখনও রাষ্ট্রপ্রধান হননি। তবে তার দাদা জি ঝোংজুন ছিলেন চীনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। কমিউনিস্ট এই নেতা মাও সে তুং-এর শাসনামলে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে কিছু কারণে জি ঝোংজুনকে জেলে প্রেরণ করা হলে শি জিনপিংসহ বাকিদের জীবনে দূর্বিষহ পরিস্থিতি নেমে আসে। পরবর্তীতে বাবা আবার পুনর্বাসিত হলে শি-র দিনবদল ঘটতে থাকে। বাবার হাত ধরে কমিউনিস্ট পার্টিতে নিজেকে পাকাপোক্ত করেন শি জিনপিং।
সবমিলিয়ে বাবা-দাদার বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবনের প্রভাব যেন কোনোভাবেই মু জির উপর না পড়ে তাই এত গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। বাবা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হওয়ার পরের বছরেই মু জি সকলের সামনে এলে এই কারণটিই আরো স্পষ্ট হয়।
লোকপ্রকাশ্যে গমন
২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসীন হন শি জিনপিং। আর ২০১৫ সালে বাবা মায়ের সাথে প্রকাশ্যে আসেন হার্ভার্ড হতে স্নাতক প্রেসিডেন্ট কন্যা মু জি। শানসি প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ইয়ানানের স্থানীয়দের চান্দ্র নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, নতুন বছর উপলক্ষ্যে গোটা চীন জুড়েই বসন্ত উৎসব পালিত হয়।
ব্যক্তিজীবনে যেমন মু জি
চীনা গণমাধ্যমের বরাতে যতটা জানা যায়, খুবই ছিমছাম ও সাবলীল জীবনযাপন করেন মু জি। ট্রাম্পকন্যা ইভাংকা বা অন্যান্যদের মতো বাবার পরিচয়ের বড়াই করতে দেখা যায় না তাকে। আগে থেকেই আড়ালে থাকা মু জি প্রকাশ্যে আসার পরও খুব যে সামনে আসেন তা নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম সবই এড়িয়ে চলায় তার সম্পর্কে তথ্য বা ছবি কোনোটাই সহজে মেলানো যায় না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে না থাকলেও সামাজিক কার্যক্রমে মু জি খুবই সক্রিয়। ২০০৮ সালে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়। ১৬ বছর বয়সী মু জি উদ্ধারকার্যে অংশ নিতে সেখানে চলে যান। পরবর্তীতে অনুপস্থিতির জন্য স্কুল থেকে ছুটির আবেদন করেন তিনি। সেই সময় স্থানীয় মিডিয়াকে এমন তথ্যই দিয়েছিলেন তার মা।
চীনা গণমাধ্যমে দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যায়িত মু জিকে পারিবারিক ধারায় রাজনীতি দেখা যাবে বলে ধারণা করেন অনেকে। অনেকেই তাকে বাবা শি জিনপিং এর যোগ্য উত্তরসূরীও বলেন। তবে তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনবিরোধী গণমাধ্যমে উঠে এসেছে উল্টো চিত্র।
তাদের দাবি রাজনীতিতে আগ্রহই নেই মু জির। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দূর্বলতা রয়েছে তার। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় ম্যাসাচুসেটস এ কাটানো দিনগুলোই মু জির বেশি প্রিয়। মু জির বর্তমান অবস্থান নিয়েও কথা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রতিনিধি ভিকি হার্টজলার ‘দ্য ইকোনোমিক টাইমস’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করেন মু জি এখন আমেরিকায় বসবাস করছেন।
ব্যক্তিজীবনে বই পড়তে ভালোবাসেন মু জি। জানা যায় ফ্যাশন নিয়ে কাজ করতেও আগ্রহ আছে তার। তবে আড়ালে আবডালে থাকা মু জির নীরব জীবনযাপন যেন তাকে রহস্যময়ী কন্যায় পরিণত করেছে। আর তাই তিনি রাজনীতিতে আসবেন কি না তা জানা যায় না। কমিউনিস্টের লাল নিশানা তার মাথায় চড়বে কি না, আর রাজনীতিতে এলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কেমন প্রভাব আসবে-সব উত্তর সময়ই বলে দেবে।
Feature Image: thefirstpost.com References: 01. China: Xi Jinping's Harvard-educated daughter Xi Mingze makes first public appearance. 02. What Did China’s First Daughter Find in America? 03. Xi Mingze: Who is Chinese president Xi Jinping's daughter?