লোফটাস হল: একটি ভৌতিক বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম

414
0

ভূত-প্রেত, রাক্ষস-খোক্ষস, প্লানচেট এসব বিষয় যেন অনন্তকাল ধরেই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিগনিত হয়েছে এদের অস্বাভাবিক, অবাস্তবিক সব ঘটনা ঘটানোর ক্ষমতার জন্য। ঠিক কি কারনে যে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে, এত বেশি আধুনিক হয়েও ভূতে বিশ্বাস করে বা এসবে ভয় পায় তা এখনো অজানা।

কি জানি, হয়তো অজানা সকল কিছুকেই ভয় করা মানুষের জিনগত একটি বৈশিষ্ট্য। এই ভয়কে পুজি করে কালের বিবর্তনে রটেছে অনেক গাল-গল্প, ভৌতিক সব অভিজ্ঞতারও বর্ণনা।

সত্যি মিথ্যা যা ই হোক না কেনো এসব ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কিন্তু প্রচুর! শিশু থেকে বৃদ্ধ ভূতের গল্পে মজে না আর রাত হলেই ভূতের কাল্পনিক একটা ভয়ে কুঁকড়ে যায় না এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম ও না! মানুষের সাব-কনশাস মাইন্ডের এই খেলাকে আরেকটু উসকে দিতে গল্পকাররা লিখেছে যেমন গল্প তেমনি নির্মাতারা বানিয়েছি মুভি, সিরিজ।

সে রকম ই ভূতের এক আস্তানার নাম ‘লোফটাস হল’। আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাড়িগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে এই ‘লোফটাস হল। তবে লোফটাস হলের ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা কিন্তু একেবারে গাল-গল্প না! 

লোফটাস হলের ভূতুরে একটি ঘর https://extra.ie/wp-content/uploads/2020/07/Loftus-Hall-3.jpg

লোফটাস হলের শুরু কাহিনী: 

লোফটাস হলের প্রাচীন ইতিহাস তুলে ধরতে চাইলে চলে যেতে হবে বেশ পেছনে! ঘটনাটা চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, হুক উপদ্বীপ বরাবর অবস্থিত এই বৃহৎ প্রাসাদ ঘর, ১৩৫০ সালে ব্ল্যাক ডেথের সময় রেডমন্ড পরিবার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।

১৬৫০ এর দশক পর্যন্ত এটি ‘রেডমন্ড হল’ নামেও পরিচিত ছিল, পরবর্তীতে এটি একটি  ইংরেজ পরিবার এর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর তখন থেকেই সেই পরিবারের নাম অনুসারে ‘লোফটাস হল’ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। 

প্রাসাদের বিবরনী দিলে বলতে হয়, ৯৭ টি জানালা সহ, ২২ টি বেডরুমের এই সুবিশাল প্রাসাদে নাকি প্রায়শই ভূতুড়ে কি সব ঘটনা নাকি ঘটতে দেখা যায়। অনেকেই বলে থাকে এটি নাকি শয়তানের প্রাসাদ! অবশ্য এখন বিভিন্ন পেইন্টিং দিয়ে আরো বেশি দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করা আর ভয় দেখানোর কাজ টাও তারা নিজ দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছে। ভূতুড়ে হোক আর যা-ই হোক প্রাসাদের দাম কিন্তু নেহাত কম না, বাজার মূল্য যার বর্তমানে ২.৫ মিলিয়ন ডলার! কি ভূত দেখার মতন ই চমকে গেলেন বুঝি? 

লোফটাস হলের ভেতরের বিভিন্ন অংশ  https://extra.ie/wp-content/uploads/2020/07/Loftus-Hall-Feature-768×448.jpg

লোকমুখে শোনা, যায় প্রাসাদটি শয়তান আর একজন কিশোরি ভূত উভয়ের দ্বারাই আচ্ছন্ন এবং তারাই মূলত ভয়ংকর সব ভুতুড়ে ঘটনা ঘটায়। অনেকেই নাকি অশরীরী কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করার পাশাপাশি দেখেছেও! ফলশ্রুতিতে কেউ ই এই সুবিশাল প্রাসাদে বেশি দিন টিকতে পারেনি। আর তাই বিল্ডিংটি বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন হাত বাদল হলেও এর প্যারানরমাল কাহিনি কিন্তু থামেনি। 

 

লোফটাস হলের বিভিন্ন মালিকগন   https://www.yaycork.ie/wp-content/uploads/2018/10/Loftus-Hall-1900-1.jpg

যে কারনে অভিশাপ্ত লোফটাস হল: 

তবে সবচেয়ে কৌতূহলী কাহিনী শুরু হয় যখন ১৭৬৬ সালে টটেনহ্যাম পরিবার  যখন এটি দখল করেছিল। লর্ড টটেনহ্যাম অ্যান লোফটাস নামে একজন মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন এবং এই দম্পতির দুটি সন্তান ছিল; এলিজাবেথ এবং অ্যান । কাহিনিটা মূলত অ্যান কে ঘিরে। 

যেহেতু লোফটাস হলটির পাশেই সমুদ্রের একাংশ ছিলো তাই প্রায়শই যখন সমুদ্রে ব্জ্রঝড় দেখা দিতো, নাবিক, ক্রুরা উপদ্বীপে আশ্রয় নিতো। সাধারণত এসব ঝড় শুরু হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেও সপ্তাখানেক সময় লাগতো। তাই বাধ্য হয়েই অনেকে লোফটাস হলে আশ্রয় নিতো। আর বাড়ির মালিক ও সরল মনে এই আগন্তুকদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতো। 

এভাবেই চলছিলো দিনকাল। অ্যান টটেনহ্যাম, তখন একজন যুবতী, তেমন ই এক ঝড়ের সময় এক আগন্তুক তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এবং আগন্তুক লোকটির সাথে খুব ভাব জমে অ্যান এর। বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তারা, দ্য টেপেস্ট্রি রুমে একসাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে কাটছিলো তাদের দিন। যেহেতু আবহাওয়া তখনও স্বাভাবিক হয়নি তাই লোকটি বেশ কিছু দিন ছিলেন । 

প্রাসাদে আসা বিভিন্ন আগন্তুকের কাল্পনিক অবয়ব  https://www.irishtimes.com/resizer/6SaG7YPNWpAXIEPfd2mLuicGxVQ=/1440×0/filters:format(jpg):quality(70)/cloudfront-eu-central-1.images.arcpublishing.com/irishtimes/OADKMO6WMUYTNNZR3LULAFMBSY.jpg

সাধারণত সন্ধ্যার সময়, প্রাসাদের বিভিন্ন বাসিন্দা চারপাশে বসে তাস খেলত, আর নিজেদের মাঝে গল্প গুজব করতো। তেমন-ই এক সন্ধ্যায়, যখন খেলা পুরোদমে চলছে, লেডি অ্যান এর হাত থেকে একটি কার্ড নিচে পরে যায়। আর যখনই সে এটি তুলতে নিচে ঝুঁকে পড়ল, তখনই তার চোখ পরলো আগন্তুকের পা এর দিকে।

কিন্তু সেখানে ছিলো মানুষের পা এর বদলে সেখানে ভয়ংকর এক শয়তানের কুৎসিত পা! আর এসব দেখে সাথে সাথেই অ্যান চিৎকার করে উঠলো এবং মূর্ছা গেলো। পরের ঘটনা যা ঘটলো তা আরো ভয়াবহ। আগন্তুকটি হঠাৎ করেই নিজের আসল শয়তানি রুপে নিজেকে প্রকাশ করে দেখা দিলো।

এবং একটি আগুনের গোলার আকার ধারণ করে ছাদ দিয়ে বের হয়ে গেলো। ছাদে যে গর্তটি হয়েছিলো সেটিও আর পরবর্তীতে মেরামত করা সম্ভব হয়নি। কারণ যখন ই মেরামতের কাজ শুরু করা হয়েছিলো তখন ই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিলো বলে জানা যায়। 

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই রুমেই ছিল অ্যান https://www.yaycork.ie/wp-content/uploads/2018/10/Loftus-Hall-card-table.jpg

 

ঘটনার আকস্মিকতায় অ্যান মূর্ছা গেলো এবং পরবর্তীতে যখন তার জ্ঞান ফিরলো তাদে দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না। প্রচন্ড অসুস্থতার জন্য আর আবোলতাবোল বলার জন্য তাকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। এমন ও শোনা যায়, অ্যান নাকি সন্তানসম্ভাবনা হয়েছিলো। এবং গির্জার ফাদার তাদের সতর্ক করে দেয়, বাচ্চাটি আসলে একটা শয়তান যে জন্ম নিলেই ভবিষ্যতে আরো ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে। 

যখন সে শিশুটিকে জন্ম দিলো অ্যানের  বাবা-মা শিশুটিকে হত্যা করে, এবং টেপেস্ট্রি রুমের দেয়ালে কবর দেয়, এবং তারা একজন যাজককেও বাড়িতে ডেকে এনে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করে ভূত প্রেত থেকে সুরক্ষা পেতে। অ্যান তার জীবনের শেষ কয়েক বছর টেপেস্ট্রি রুমে তালাবদ্ধ অবস্থায় কাটিয়েছেন।

যেখানে তার সন্তানের দেহাবশেষ দেয়ালের মধ্যে সমাহিত করা হয়েছিল। এমনকি শিশুটির কঙ্কালের অবশিষ্টাংশ পরে ১৮৭০ সালে বাড়ির সংস্কারের সময় আবিষ্কৃত হয়েছিল। এরপর থেকেই অনেকেই নাকি বিভিন্ন ধরনের ভূতুড়ে ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। 

দর্শনার্থীদের চোখে ভৌতিক অবয়বের অস্তিত্ব:

কোনো এক দর্শনার্থীর তোলা ছবিতে অশরীরির একাংশ https://mysterium-incognita.com/wp-content/uploads/2020/10/Loftus-Hall-Haunted-Ireland-2-740×416.jpg

জানলে অবাক হবেন বেশ কয়েক বার এখানে ভূতের বেশ কিছু ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে দর্শনার্থীরা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি ছবি হলো থমাস বিভিস নামক একজন ইংরেজ দর্শনার্থী দ্বারা নেওয়া হয়েছিল, যা দেখতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন অশরীরীর মতন মনে হচ্ছিলো! 

লোফটাস হল নিয়ে টিভি পর্দায় প্রদর্শিত প্রোগ্রাম:

বিভিন্ন জনপ্রিয় টিভি সিরিজেও লোফটাস হল নিয়ে বিভিন্ন পর্ব করা হয়,  যেমন – “ঘোস্ট অ্যাডভেঞ্চার” নামে একটি মার্কিন প্যারানরমাল টিভি সিরিজ এর একটি বিশেষ পর্বে দেখানো হয়েছে এছাড়া  জনপ্রিয়  ‘ফাউল ম্যানর’ সিরিজের অংশ বিশেষেও রেয়েছে এই প্রাসাদের প্যারানরমাল ঘটনা বৃত্তান্ত।

লোফটাস হিলের বর্তমান অবস্থা:

আয়ারল্যান্ডের অনেক আকর্ষণীয় স্থানের মতো, লোফটাস হলও ২০২০ সালে দর্শকদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তবে, এটি আর কখনো খোলা হয়নি এবং প্রাসেদের মালিকরা যারা ২০১১ সালে বাড়িটি কিনেছিলেন সিদ্ধান্ত নেয় প্রাসাদটি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য।

রহস্যে ঘেরা লোফটাস হল https://www.unreservedmedia.com/wp-content/uploads/2020/08/Loftus-Hall–1280×853.jpg

পরবর্তীতে ২০২০ ফাইনালি বিক্রির জন্য নিলামে তুললে ২০২১ সালে এটি বিক্রি হয়। বর্তমানে এটি এখন একটি বিলাসবহুল হোটেলে পরিণত হতে চলেছে এবং আশা করা যায় তখন আরো বেশি দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করবে যা মূলত ব্যাবসায়ীক উদ্দেশ্যের ই আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল। 

মানুষের আবাস সংকটের পাশাপাশি, অশরীরী এসব আত্মাদের ও যেনো আবাসস্থল সংকটের উপক্রম দেখা দিয়েছে। দেখা যাক নতুন অত্যাধুনিক এই হোটেলেও অ্যান টটেনহ্যাম তার অশরীরী আত্মা নিয়ে হানা দেয় কিনা!

 

The Story Behind Loftus Hall: The Most Haunted House In Ireland

https://ghosts.fandom.com/wiki/Loftus_Hall

https://www.waterfordvisitorcentre.com/blog/general-news/haunting-history-loftus-hall

https://www.irishtimes.com/life-and-style/homes-and-property/loftus-hall-spooky-pile-with-a-haunting-history-for-2-5m-1.4309910