বেদুঈনদের গল্পগাঁথা: মরুর বুকে খেপাটে যাযাবর যারা

761
1

কবি-সাহিত্যিকদের কবিতার পঙ্কতিতে বারবার ফুটে উঠেছে একদল খেপাটে যাযাবরের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার কথা। চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাওয়া যায়, ধুলোয় ধূসরিত মরুর বুকে ক্ষ্যাপাটে ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটে চলছে বোহেমিয়ান এক অভিযাত্রী। মরুর বুকে এই খেপাটে যাযাবর জাতি নিয়ে গবেষণাও হয়েছে অনেক। 

এদের জীবন রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ হলেও জীবনে হাসি- কান্নার অভাব নেই। বেঁচে থাকা থেকে শুরু করে জীবিকা তথা মরুভূমির শুষ্ক-অনুর্বর পরিবেশে দু’বেলা খাদ্য সংগ্রহের তাড়নায় চালিয়ে যেতে হয় কঠিন সংগ্রাম। এমন এক জাতির নাম বেদুঈন। আজকের আলোচনা এই খেপাটেদের ঘিরে। 

বেদুঈন কারা? 

আরবের একটি যাযাবর জাতি হলো বেদুঈন। বেদুঈন শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘বেদু’ শব্দ থেকে হয়েছে। যার অর্থ-বাদিয়াবাসি। বাদিয়া শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে মরুভূমি। তাহলে বেদুঈন শব্দের অর্থ দাঁড়ায়-যারা মরুভূমির বাসিন্দা। এছাড়াও কেউ কেউ মনে করেন, বেদেয়া শব্দ থেকে বেদুঈন শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ দাঁড়ায়-আরম্ভ। 

বেদুঈনরা আরবভাষী। নিজেদেরকে প্রকৃত আরব হিসেবে মনে ও প্রাণে বিশ্বাসী এরা নিজেদেরকে অভিহিত করে থাকে ‘Heirs of Glory’ তথা ‘গৌরবের উত্তরাধিকারী’ হিসেবে। 

পোষা চিতার পাশে দাঁড়ানো এক বেদুঈন; Image Source: Flicker

বেদুঈনদের ইতিহাস ও জীবনযাত্রা

বেদুঈনরা আরব উপদ্বীপ (বর্তমান ইয়েমেন, আরব আমিরাত), মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকা-এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যাযাবর অধিবাসী। তবে বাইবেল থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, তারা একসময় ‘The Holy Land’ অর্থাৎ বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের অধিবাসী ছিল। তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও বাইবেল থেকে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায়।   

এরা উপজাতীয় গোত্র এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। তাছাড়াও এরা অন্তঃবিবাহী এবং বহুগামী। পরিবারের প্রধান, সেই সাথে গোত্রীয় কাঠামো গঠনকারী প্রতিটি ধারাবাহিক বৃহত্তর সোশ্যাল ইউনিটকে তারা শেখ বলে। শেখকে পুরুষ প্রবীণদের একটি ইনফর্মাল উপজাতীয় কাউন্সিল সাহায্য করে থাকে। 

এরা অন্যান্য পেশার মানুষের মতো একস্থানে বসবাস না করে যাযাবর হিসেবে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে। তারা উট, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি চরায়। তবে যেখানে তারা তাদের পোষা প্রাণীদের জন্যে দরকারি খড়-খাগড়া বা ঘাসের সন্ধান পায় সেখানেই পশুর দল নিয়ে বসবাস করা শুরু করে।  

বেদুঈনদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকা খুবই সাধারণ। খেজুর এবং দুধ, দই, মাংস এবং পনির দৈনন্দিন খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে। এরা উলের ব্যবসা করে, অন্যান্য জিনিসপত্র যেমন-চা, কফি উৎপাদন এবং পশুর চামড়াও বিক্রি করে থাকে। কেউ কেউ চোরাকারবারি হিসেবে কাজ করে। নিম্নভূমি অঞ্চলে উটের প্রজনন ঐতিহ্যগতভাবে প্রাথমিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। উচ্চভূমি অঞ্চলে ভেড়া ও ছাগল পালনই প্রধান কাজ। 

এছাড়াও, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সাল থেকে যাযাবর বৃত্তি, কৃষিকাজ এবং কখনো কখনো সিরিয়ার প্রান্তরে মাছ ধরে জীবনযাপন করতো বলে কিছু কিছু উৎস থেকে জানা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ সালের মধ্যে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সময়ে তাদের আয়ের একটি প্রধান উৎস ছিল মরু ভুমির কাফেলা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা। তাছাড়াও, মরুভূমিতে গৃহপালিত উট দ্বারা পণ্য টানা এবং কাফেলার লোকজন পরিবহণের মাধ্যমেও অর্থ উপার্জন অর্জন করতো বলে জানা গিয়েছে। এছাড়াও,  মালামাল বহনের জন্য মরুভূমিতে গাইড হিসেবেও বেদুঈনরা কাজ করতো।   

বেদুঈনরা তাদের জীবনধারা, ভাষা, সামাজিক কাঠামো এবং সংস্কৃতি দ্বারা স্বীকৃত। অন্যান্য মিশরীয়দের তুলনায় তাদের মুখের গড়ন আলাদা এবং তারা সাধারণত আলাদা পোশাক পরে। পুরুষেরা লম্বা ‘গালাবেয়া’ পরিধান করে। যার নিচে একটি পাতলা সুতির প্যান্টালন, একটি লাল/সাদা (স্মেঘ) বা সাদা (আমেমা) হেডস্কার্ফ, কখনও কখনও একটি কালো দড়ি (আগেল) রাখা হয়। 

বেদুঈনদের রুটি তৈরীর প্রক্রিয়া; Image Source: Richard Nowitz

মহিলারা রঙিন লম্বা পোশাক পরে এবং যখন তারা বাইরে যায় তারা একটি পাতলা, দীর্ঘ, কালো কোট (আবায়া) পরে। তারা সবসময় একটি কালো, পাতলা স্কার্ফ (তারহা) দিয়ে তাদের চুল ঢেকে রাখে। যদিও আজকাল কেউ কেউ রঙিন স্কার্ফও পড়ে। ঐতিহ্যগতভাবে বেদুঈন মহিলারা একটি সজ্জিত মুখের পর্দার (বোরকা) আড়ালে তাদের মুখ ঢেকে রাখতো; কিন্তু তরুণ প্রজন্ম কেবল তাদের তরহা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। 

বেদুঈনরা প্রকৃতি পূজা করতো। প্রাচীন নানা ধর্মের ন্যায় তারা মূর্তিপূজাও করতো। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আরবে ইসলামের প্রচার আরম্ভ করলে বেদুঈনদের অনেক গোত্র দলে দলে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মূলত সেই সময় থেকেই বেদুঈনরা সুন্নী মুসলিম। তবে খ্রিস্টধর্ম পালন করে এমন কিছু গোত্রও বিদ্যমান রয়েছে। মিশরের দক্ষিণ সিনাই ও লিবিয়াতে বসবাসরত কিছু বেদুঈন গোত্র রয়েছে, যাদের ভেতর সুফি মতবাদের প্রভাব রয়েছে। 

বেদুঈনদের চিন্তাধারা

বেদুঈনরা সাধারণত মুক্ত মনের অধিকারী হয়ে থাকে। নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী পরিবেশে যা ঘটছে তা সম্পর্কে আপডেট পেতে সবসময় আগ্রহী হয়ে থাকে, এর কারন অবশ্যই তাদের জীবনযাত্রার ধরন। যেহেতু তারা কোন জায়গায় বেশি দিন স্থায়ী থাকে না তাই চোখ কান সর্বদা খোলা রাখা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।  

তবে মরুর বুকে যাযাবরের মত ঘুরে বেড়ানোর কারনে এরা বেশ কলহপ্রবণও হয়। সামান্য পশু চারণভূমি নিয়েও এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব- কলহ বাঁধতে সময় লাগেনা! এছাড়াও এরা খুবই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে থাকে। কোন কারনে পরিবারের কেউ খুন হলে খুনিকে পরিবারের সবাই দলবেঁধে খুঁজে বেড়ায়। না খুঁজে পেলে খুনির পরিবারের একজন সদস্যকে হত্যা করে। 

বর্তমানে আধুনিক আরব দেশগুলো যাযাবর জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করে। বেদুঈনরা তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা দিতে চায় এবং এর জন্য তাদের শহুরে এলাকায় বসতি স্থাপন করতে চায়। এইভাবে তাদের জীবনধারা এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক, উপজাতীয় সংস্কৃতিতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় যা ধীরে ধীরে পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়েছে। 

পুরুষদের আধুনিক সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কিন্তু নারীরা পরিবারের পরিবেশের মধ্যে থাকার জন্য সম্মান এবং ঐতিহ্যের দ্বারা আবদ্ধ এবং তাই তাদের সম্ভাবনা কম। 

একজন বেদুঈন নারী; Image Source: pexels.com

বেদুঈনরা হলো স্বাধীনচেতা এবং আরবে স্বাধীনচেতার প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এদের। আর তাইতো, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আকর্ষিত করেছিল বেদুঈনদের যাযাবর জীবন। তাইতো তিনি তার ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় লিখেছেন-

ইহার চেয়ে হতেম যদি
আরব বেদুয়িন!
চরণতলে বিশাল মরু
দিগন্ত বিলীন।

এছাড়াও, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও বেদুঈনের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। কবির আরব বেদুঈন হওয়ার বাসনা থাকবে সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চরণে তিনি লিখেছেন- 

আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ!

 

Feature Photo: pexels.com 
Source:

01. Bedouin. 
02. Bedouins| Facts and Details. 
03. THE BEDOUIN IN HISTORY OR BEDOUIN HISTORY? 
04. BEDOUIN CULTURE | bedawi.com. 
05. Bedouin life at Al Marmoom in Dubai. 
06. Bedouin in the Bible.

1 COMMENT