গ্ল্যাডিয়েটর নামটার সাথে যাদের পরিচিতি আছে, নামটি শুনলেই তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সু-সাজে সজ্জিত, বলিষ্ঠ দেহের প্রাচীন যুগের বীর যোদ্ধাদের একটি প্রতিচ্ছবি! তাদের সাহস আর বীরত্বের কাহিনী আজও চির অম্লান করে রেখেছে তাদের নাম ইতিহাসের পাতায়।
আমরা বিভিন্ন সময় বর্তমান সময়েও বিনোদনের জন্য মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যকার নানা ধরনের খেলার আয়োজন করতে দেখি। তবে গ্ল্যাডিয়েটরদের এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে লড়াই-রেসলিং ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয় কার শক্তিমত্তা কত বেশি! ঠিক যেমনভাবে আয়োজন করা হয় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, মহিষের লড়াই-এসবের ক্ষেত্রে প্রমাণ করতে কার পশু কত শক্তিশালী। আর এরপর বিজয়ীকে দেয়া হয় পুরস্কার।
গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই, তাই তো মানুষের মনের খোরাক জোগাতে আর কল্পনাকে বাস্তবে চোখের সামনে তুলে ধরতে বর্তমানে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রকম মুভি, সিরিজ এবং ডকুমেন্টারি। গ্ল্যাডিয়েটরদের ওপর নির্মিত হয়েছে গ্ল্যাডিয়েটর, গ্ল্যাডিয়েটর সেভেন, সাইক্লোপস, স্পার্টাকাস, টেন গ্ল্যাডিয়েটর, দ্য সাইন অব দ্য ক্রস, গ্ল্যাডিয়েটরস অব রোম ইত্যাদি নামের বিখ্যাত সব ছবি। এমনকি বেশ কিছু অ্যানিমেটেড কার্টুনও নির্মিত হয়েছে। আর এসব ছবি এবং কার্টুনে গ্ল্যাডিয়েটরকে দেখানো হয়েছে লড়াকু যোদ্ধা, বীর আর সাহসী হিসেবে।
গ্ল্যাডিয়েটর অর্থ কি?
ল্যাটিন শব্দ ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ অর্থ হচ্ছে ‘তরবারিওয়ালা মানব’। এই শব্দটির উৎপত্তি ‘গ্ল্যাডিয়াস’ বা ‘সোর্ড’ অর্থাৎ তরবারি থেকে। গ্ল্যাডিয়েটর সাধারণত হচ্ছেন এমন একজন অস্ত্রধারী যোদ্ধা যিনি অন্য কোনো গ্ল্যাডিয়েটরের সঙ্গে লড়াই করে সাধারণ মানুষ ও রাজাদের আনন্দ দেন; অনেকটা আজকের যুগের রেসলিং খেলার মতনই। মূলত প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে এই রীতি প্রচলিত ছিল যা কালের বিবর্তনে বর্তমানে হারিয়ে গেছে।
হাজার হাজার দর্শক, রাজাদের সামনে অন্য গ্ল্যাডিয়েটরের সাথে যুদ্ধ করা এবং নিজের বীরত্বে জাহির করাই মূলত এই রীতির প্রধান দিক। তবে তারা যে শুধু বিনোদন-এর জন্য বা রাজাকে খুশি করতে যুদ্ধ করতো তা কিন্তু না! বরং ভয়ংকর আসামি কিংবা বন্য জন্তু-জানোয়ারের সাথে লড়াইয়ের কাজটাও করতো।
আপনি জানলে অবাকও হতে পারেন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি-এর জন্য গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়ে করা একটি ডকুমেন্টারিতে এন্ড্রু ক্যারি বলেন,
গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াইয়ের প্রাচীন দৃশ্যটি সম্ভবত এতটা মারাত্মক বা তারা এত হিংস্র ছিল না যতটা উপস্থাপন করা হয় বর্তমানে।
গত ২০ বছরে গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়ে করা গবেষণা প্রকাশ করেছে যে, গ্ল্যাডিয়েটররা সর্বদা একে অপরকে হত্যা করার চেষ্টা করতো ব্যাপারটা সেরকমও নয়। বরং দশটি গ্ল্যাডিয়েটরের মধ্যে নয়জন একটি ম্যাচে বেঁচে যেতেন বলে তাদের ধারণা।
প্রাচীন যেকোনো কিছুর মতোই গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়েও রয়েছে ধোয়াশা এবং অসত্যে মোড়া অনেক গাল-গল্প। আর এজন্যই গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়ে বাস্তব কাহিনী পুনর্গঠনের জন্য, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদরা বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন শিল্প খননে এবং প্রাচীন গ্রন্থের লাইনগুলির মধ্যে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন।
আর এর জন্য করেন ব্যাপক অনুসন্ধান। যেমনটি ফ্রান্সের আর্লেসের একটি ১৯০০ বছরের পুরোনো রোমান অঙ্গনের উপরে চিত্রিত সংঘর্ষ, যুদ্ধ গবেষকদের সাহায্য করে আসল সত্যিটা বের করে আনতে।
গ্ল্যাডিয়েটরদের শ্রেণি
জানতে হয়তো অবাক হবেন যে শক্তিশালী এই গ্ল্যাডিয়েটরদের অধিকাংশই কিন্তু দাস শ্রেনিতে অবস্থান করতো। তবে তাদের এই ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ পরিচয়টাই তাদের দিয়েছিল সমাজে আলাদা সম্মান আর অবস্থান! আর খ্যাতির কথা তো সবার জানাই! না হলে কি আর আজও আমরা গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়ে জানার ব্যাপারে এত উৎসুক? তাদের ছবিতে ছবিতে ভরে যেত শহরের দেওয়াল…বাচ্চা আর কিশোরদের কাছে ছিল তারা হিরো, আর শত রমনীর প্রেমিক পুরুষ!
তবে প্রাচীন রোমের এই সকল গ্ল্যাডিয়েটরদের ভেতরও কিন্তু ছিল বেশ কিছু রকম আর ধরন। আর তাদের এই বৈচিত্রতা আসতো মূলত তাদেরই ব্যবহৃত অস্ত্র, সরঞ্জাম, যুদ্ধের ধরন এমনকি প্রতিপক্ষ কে বা কি তার বিচারে!
বেস্টিয়ারি
অন্য সকল গ্ল্যাডিয়েটরের মতন বেস্টিয়ারিরা কিন্তু মানুষের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হতো না; বরং তার হিংস্র পশুদের সাথে লড়াইয়ে নামতো। মূলত বিস্ট অর্থ পশু থেকেই তাদের এই নামকরণ। এই ধরনের গ্ল্যাডিয়েটররা সাধারণত একটি বর্শা অথবা একটি ছুরি এবং কখনো কখনো একটি চাবুক দিয়ে যুদ্ধ করতো।
পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে তাদের ছিল তামার হেলমেট আর বর্ম সাথে চামড়ার তৈরি হাত ও পায়ে মোড়ানো বন্ধনী। আর ঢাল হিসেবে নিতো ছোট তামার তৈরি বস্তু। অনেক সময় জুতা পরতো আবার অনেক সময় খালি পায়েই তারা লড়াই চালিয়ে যেত।
বেস্টিয়ারি নামে পরিচিত গ্ল্যাডিয়েটরের জনপ্রিয়তা নেহাত কম ছিল না সেই সময়ে। সুতরাং প্রচুর সংখ্যক গ্ল্যাডিয়েটর ছিল যারা পুরষ্কার এবং প্রশংসার কারণে এই ভূমিকা নিতে আগ্রহী ছিল। এছাড়া, অন্যান্য গ্ল্যাডিয়েটরদের তুলনায় এরা বেশ কম বিপজ্জনক দলেরও অন্তর্ভুক্ত বলা হতো।
যেখানে অন্যরা প্রায় প্রতিবারই রোমান কলোসিয়ামের মতো ময়দানে প্রবেশ করে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতো, জয়ী হও অথবা মৃত্যকে বরণ করো-ছিল যাদের বেদবাক্য। অন্যদিকে বেস্টিয়ারিদের পশুদের সাথে লাড়াইয়ের প্লট এমনভাবে সাজানো থাকতো যেখানে আসলে পশুদের-ই বেস্টিয়ারিকে পরাজিত করতে হতো। তাই, জয়-পরাজয় নিয়ে চ্যালেঞ্জটাও এখানে ছিল না।
বেস্টিয়ারিদের নির্দিষ্ট স্কুলে প্রশিক্ষিত করা হতো। যেখানে তারা বন্য জানোয়ারদের সাথে লড়াইয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে উঠতো। আর এসকল স্কুলগুলোকে বলা হতো ‘স্কুল অফ বেস্টিয়ারাম বা বেস্টিয়ারিয়াম’। প্রাচীন রোমের বেস্টিয়ারিজ স্কুলটিকে লুডাস ম্যাটুটিনাস বলা হতো, এটি ছিল রোমান কলোসিয়ামের পাশে অবস্থিত একটি ভবন যা সম্রাট ডেমিশিয়ান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার সময়ে দাস এবং স্বেচ্ছাসেবক উভয়কেই বন্য জানোয়ারদের সাথে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার রীতি ছিল।
নক্সি গ্লাডিয়েটর
নক্সি গ্ল্যাডিয়েটরদেরকে সত্যিকারের গ্ল্যাডিয়েটর বলা যায় না। কারণ, এই যোদ্ধারা সাধারণত অপরাধী বা যুদ্ধবন্দী অথবা বিল্পবী ছিল, যাদের অন্য দক্ষ গ্ল্যাডিয়েটরদের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে ফিরে আসতে বলা হতো। এমনকি তাদের যুদ্ধের জন্য সরঞ্জামও দেওয়া হতো খুব কম। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাও দেওয়া হতো না; যার ফলে তাদের জয়ের আশা ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়।
যেহেতু নক্সিরা ক্রিমিনাল শ্রেনীর লোক ছিল। তাই প্রাচীন রোমের আদালত তাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি প্রদর্শন করতে ইচ্ছুক ছিল না। অনেক সময় তাদের হেলমেট প্রদান করা হতো। কিন্তু এসকল হেলমেটের এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না যাতে তারা তাদের প্রতিপক্ষের আক্রমণকে লক্ষ্য করতে পারে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এসকল হেলমেট এই নক্সি গ্ল্যাডিয়েটরদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করতো বেশি!
একজন নক্সি গ্ল্যাডিয়েটরকে আসলে এমন একটি পরিস্থিতিতে ছেড়ে দেওয়া হতো যেখানে কেউ আশা করতো না যে তারা বেঁচে ফিরে আসবে। সত্যিকারের যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ এবং পরিচিতি ছাড়া শুধুমাত্র রোমান সাম্রাজ্যের রক্তের লালসা মেটানোর জন্য এবং অ্যাম্ফিথিয়েটার ও এর পৃষ্ঠপোষকদের খুশি রাখার জন্য তারা তাদের জীবন দান করতো।
রেটিরিয়াস গ্লাডিয়েটর
রেটিরিয়াস গ্ল্যাডিয়েটররা ছিল প্রাচীন রোমান কলোসিয়ামের অন্যতম স্বীকৃত যোদ্ধা। রেটিরিয়াস গ্ল্যাডিয়েটরের নামটি ল্যাটিন ভাষার এর অর্থ ‘নেট ফাইটার’, এই গ্ল্যাডিয়েটর প্রকৃতপক্ষে একটি জাল এবং একটি ত্রিশূলের নিয়ে যুদ্ধ করতো। অনেকটা জেলেদের সাজ-সরঞ্জাম এর সাথে এদের মিল পাওয়া যায়। রেটিরিয়াস যুদ্ধের কলা-কৌশল তার অস্ত্রশস্ত্র এবং তার বর্ম এর মতোই বৈচিত্রময় ছিল। ত্রিশূলের দৈর্ঘ্য রেটিয়ারিকে দূরত্ব বজায় রাখতে, এবং দীর্ঘ পরিসর থেকে আক্রমণ করতে সাহায্য করতো।
হালকা বর্ম তাদের দ্রুত চলাফেরা করার উপযোগী ছিল। এমনকি তারা কোনো হেলমেট পরতো না যাতে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করতে পারে, এবং দ্রুত মাথা নাড়ানোর যে কৌশল তারা রপ্ত করেছিল, তা ছিল সত্যিই সবার থেকে আলাদা!
এমনই রিটেরিয়াস কার্যকরীভাবে একাধিক উপায়ে নেট ব্যবহার করতে পারতো যা দিয়ে সে অন্য গ্ল্যাডিয়েটরকে ফাঁদে ফেলতো সুকৌশলে। রেটিরিয়াসরা অন্য যেকোনো গ্লাডিয়েটরদের মতোই ছিল চৌকশ, কৌশলী একটা দল যদিও অন্যদের তুলনায় তাদের সরঞ্জাম কিছুটা অনুন্নত ছিল তখনকার রোমের বিবেচনায়।
শুধুমাত্র ইতিহাস বিবেচিত করে খুব সহজেই হয়তো আমি আপনি রোমানদের বিচার করে ফেলতে পারি যে, তারা ছিল খুব হিংস্র, যুদ্ধবাজ আর কিছুটা মানবতাহীন। এছাড়াও, যখন হিংসাত্মক আর হিংস্রতম কাজ এর কথা আস , তখন আমরা কল্পনা করতে পছন্দ করি তাদের চেয়ে হয়তো আমরা অনেক বেশি সভ্য আর আধুনিক। কিন্তু আসলেই কি তাই?
জেনে অবাক হবেন যে, এমনকি বর্তমান সময়ের ক্রীড়াবিদরা এই আধুনিক সময়েও যারা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলাকে নেশা এবং পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন; যেমন—ফুটবল থেকে বক্সিং এমনি মিক্সড মার্শাল আর্ট—এবং যাদের এই ম্যাচ লক্ষ লক্ষ দর্শকদের আকর্ষণ করে তাদের বাস্তবিক পরিস্থিতি এবং চলার পথটা ততটা মসৃণ নয় যতটা আমরা সাদা চোখে দেখি। ভাবনার বিষয় হলো, এমনকি এই বর্তমান যুগের এসকল ক্রীড়াবিদদেরও পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন।
Feature Image: pinterest.com References: 01. The Roman Gladiators. 02. The Real History of The Gladiators. 03. Infamous Roman Gladiators.