রোডসের কলোসাস প্রাচীন বিশ্বের এক বিস্ময়।প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি হল এই বিশাল কলোসাস বা প্রতিমূর্তিটি । গ্রীকদের বিশ্বাস অনুসারে এ প্রতিমূর্তিটি গ্রীক সূর্যদেবতা হেলিওসের প্রতিনিধি।৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডেমেট্রিয়াস পোলিওরসেটের দীর্ঘ অবরোধের বিরুদ্ধে রোডসবাসীর বিজয় উপলক্ষে দেবতাদের ধন্যবাদ জানাতে এ কলোসাস নির্মিত হয়েছিল।
প্রায় সবার কাছে পরিচিত এই রোডসের কলোসাসের ইতিহাস শুরু হয় ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উত্তরসূরি ডেমেট্রিওস পোলিওরসেটের অবরোধের মাধ্যমে।
ডেমেট্রিওস পরাজিত হওয়ার পর রোডসে তার সামরিক সরঞ্জাম ফেলে রেখে যান। পরবর্তীতে রোডিয়ানরা এসব সরঞ্জাম দিয়ে তাদের প্রিয় দেবতা হেলিওসের বিজয়ী মূর্তি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কাজটি লিন্ডোসের ভাস্কর চারেসকে অর্পণ করা হয়েছিল। এটি সম্পূর্ণ করতে বারো বছর সময় লেগেছিল।কিন্তু প্রতিমূর্তিটি তৈরির মাত্র ৫৬ বছর পরেই শক্তিশালী ভূমিকম্পে তা ভেঙ্গে পড়ে। তবে ১০৮ ফুট লম্বা ব্রোঞ্জ নির্মিত কলোসাস অব রোডস শত্রুদের উপর রোডসবাসীর বিজয়ের একটি অনুস্মারক ছিল যা পৃথিবীবাসীর স্মৃতিতে এখনও রয়ে গেছে।
কলোসাস অব রোডসের বর্ণনা
কলোসাসের প্রকৃত অবয়ব:
রোডসের কলোসাস প্রাচীন বিশ্বের এক বিস্ময় হলেও তা দেখতে কেমন ছিল অতি অল্প সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে জানা কঠিন ছিল।কারণ এর স্থায়িত্বকাল ছিল ৫৬ বছরের মত।তবে এটির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক এজন্য মূর্তিটির আকৃতি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রচলিত হয়েছে।
মূর্তিটির অবয়ব এমন ছিল যে একজন প্রায় নগ্ন ব্যক্তি যার মাথায় সৌর রশ্মির মুকুট বিদ্যমান এবং হাতে ছিল একটি প্রজ্বলিত মশাল । ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি এ মূর্তিটি ৩২ মিটার উঁচু , এছাড়া মূর্তিটি সাদা মার্বেলের তৈরি একটি স্তম্ভের উপর দাঁড় করানো ছিল। যা তার দৃঢ়তা নির্দেশ করে।তবে মূর্তিটির পায়ের অবস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। কোন মতবাদ অনুযায়ী দুই পায়ের মাঝে এমন ফাঁকা ছিল যার নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল করত। আবার কোন মতবাদ অনুযায়ী দুই পা একসাথেই একটি স্তম্ভের উপর রাখা হয়েছে।আর এসব ধারণার উপর ভিত্তি করে কলোসাসের চিত্রও আঁকা হয়েছে দুইভাবে।
বলা হয় যে রোডসের কলোসাসের মুখটি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ছিল, তবে এটি নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব।
রোডস অব কলোসাসের অবস্থান:
রোডস হল পূর্ব এজিয়ান সাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি তুরস্কের উপকূল থেকে প্রায় ১৯ কিমি পশ্চিমে, গ্রীক মূল ভূখণ্ড এবং সাইপ্রাস দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। এর রাজধানীর নাগরিকরা রোডস নামেও পরিচিত। একটি সামরিক আক্রমণ প্রতিহত করার পরে বিজয়ের স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে তারা কলোসাস তৈরি করেছিল। তবে মূর্তিটি রোডসে অবস্থিত হলেও এর সঠিক অবস্থানটি কেউ জানে না। কারণ ভেঙে পড়ার পর মূর্তিটির অবশিষ্টাংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আলোচনা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মূর্তিটির আকার ও অবস্থান নিয়ে কাল্পনিক ধারণা করি। রোডস শহরটি ছিল ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং একটি প্রশস্ত খাদ দ্বারা সুরক্ষিত।এ খাদের জন্য আক্রমণকারীদের শহরে প্রবেশ করতে হলে একটি টাওয়ার ব্যবহার করতে হত। এ শহরটিতে ইতিমধ্যেই হেলিওসের একটি বড় মন্দির ছিল।রোডীয়ানদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই ঈশ্বর হেলিওস রোডসের রক্ষাকর্তা ছিলেন।
এজন্য কিছু লোক মনে করেন যে মূর্তিটি এই মন্দিরের কাছে অবস্থিত ছিল, তবে অন্য মতবাদ অনুযায়ী মূর্তিটি বন্দরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত ছিল।যার দু পায়ের ফাঁকে খোলা পথ ছিল যেখান দিয়ে নৌযান চলাচল করত।
বন্দরের প্রবেশদ্বারে বিস্তৃত এ মূর্তির অবস্থান নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত।কিন্তু এসব মতবাদকে মানা যায় না কারণ ৩২ মিটার উঁচু দাঁড়ানো এ মূর্তিটির পায়ের ফাঁক দিয়ে বন্দরের নৌযান চলাচল একটি অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া যদি এটি করা হত, তবে ভূমিকম্পে এটি মূল ভূখণ্ডে না পড়ে বন্দরের প্রবেশপথে ধ্বসে পড়ত।
কলোসাস নির্মাণের কারণ:
রোডসবাসীরা কেন এই কলোসাসটি তৈরি করেছিল তার কারণ ছিল তারা ৩০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল। অর্থাৎ সেই বছর দ্বীপটি ডেমেট্রিওস পোলিওরসেটের একটি ভয়ানক অবরোধ থেকে বেঁচে গিয়েছিল, যিনি গ্রীক দ্বীপপুঞ্জের উপর তার আধিপত্য জাহির করতে চেয়েছিলেন। এ অবরোধে ব্যর্থ হয়ে ডেমেট্রিওস প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম ফেলে যান।আর রোডসবাসীরা অবরোধে বিজয়ী হয়ে তাদের সূর্যদেবতা হেলিয়াসকে ধন্যবাদজ্ঞাপন স্বরূপ এই কলোসাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
কলোসাস নির্মাণে অর্থায়ন:
রোডসের কলোসাস নির্মাণে অর্থায়ন ছিল একটু ব্যতিক্রমি ধরণের।কলোসাস নির্মাণের অর্থায়নের মূল উৎস ছিল ডেমেট্রিওস পোলিওরসেটের ফেলে যাওয়া মাটিতে পরিত্যক্ত সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অর্থ।
৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের উত্তরসূরি মেসিডোনিয়ার অ্যান্টিগোনাস দ্বীপটিতে আক্রমণ করেছিল কিন্তু সফল হয়নি।ঐ সময় ভূমধ্যসাগরের বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ তথা রোডসের উপর মিশরের রাজা টলেমি প্রথমের হস্তক্ষেপ ছিল।যে কারণে অ্যান্টিগোনাসের সাথে রাজা টলেমি প্রথমের দ্বৈরথ ছিল। এজন্য অ্যান্টিগোনাস রোডস শহর দখলের উদ্দেশ্যে তার পুত্র ডেমিট্রিয়াসকে পাঠায় দ্বীপে আক্রমণ করার জন্য।ডেমেট্রিওস ৪০,০০০ সৈন্য নিয়ে দ্বীপের রাজধানী আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিল যা চলে প্রায় একবছর পর্যন্ত। কিন্তু তারা যুূৃদ্ধে হেরে চলে যায় সব সামরিক সরঞ্জাম ফেলে। এই যুদ্ধের ফেলে যাওয়া সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অর্থ থেকেই কলোসাসের অর্থায়ন করা হয়েছিল।
তবে এছাড়াও মূর্তিটি নির্মাণে আরও অর্থের দরকার হয়েছিল।তবে এটি কী অনুপাতে ছিল বা কারা সেসব অর্থের যোগান দিয়েছিল তা অবশ্য জানা যায়নি।
কলোসাসের ভাস্কর চারেস ( Charès de Lindos)
কলোসাস অফ রোডসের ভাস্কর ছিলেন রোডসের প্রধান শহর লিন্ডোসের চারেস। তিনি লাইসিপোসের ছাত্র ছিলেন।
কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তিনি কলোসাসের ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই মারা যান।কথিত আছে যে কলোসাস নির্মাণের শেষ পর্যায়ে কিছু ত্রুটি তার সামনে তুলে ধরা হয় যা ছিল তার জন্য অপমানজনক।এছাড়াও প্রতিমূর্তিটি নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি প্রায় দেউলিয়া হয়েছিলেন।এসব কারণবশত তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।
কিন্ত এসব কথিত কথার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে।কারণ চারেস একজন শিক্ষিত এবং চতুর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কি তার কাজের অপূর্ণতা বা ভুল হিসাবের কারণে নিজের জীবন নিয়েছেন?
তবে যাই হোক, তার প্রতিভা তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে না। তিনি এমন ভাস্কর্য তৈরি করেছেন যা দীর্ঘকাল পৃথিবীবাসীর মনে থাকবে। কারণ তিনি প্রাচীন বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের একটি তৈরি করেছিলেন।
কলোসাস নির্মাণের উপকরণ বাছাই:
রোডসের কলোসাস নির্মাণের মূল উপকরণ ছিল ব্রোঞ্জ। মূর্তিটি তৈরিতে এ ধাতুটি এমনি এমনি ব্যবহার করা হয়নি,এটা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার পরই তা ব্যবহার করা হয়েছিল।ব্রোঞ্জ হল তামা এবং লোহার মধ্যকার একটি খাদ। এটা লোহার চেয়ে শক্তিশালী এবং চরম আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারে। তাই সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাসের জন্য মূর্তির বাইরের আবরণ হিসেবে ব্রোঞ্জ ছিল উপযুক্ত।
কলোসাসের নির্মাণ যা দিয়ে হয়েছিল:
সম্ভবত ২৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কলোসাস অফ রোডসের নির্মাণ শুরু হয়েছিল এবং ২৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল, অর্থাৎ কাজের সময়কাল ছিল মাত্র ১২ বছর।
৩০ মিটারেরও বেশি উচ্চতার এ মূর্তিটি নির্মাণের ভিত্তি ছিল মার্বেল পাথরের মত কঠিন উপাদান। এই ভিত্তির উপর শ্রমিকরা কাটা পাথর স্তুপ করে এর পা এবং শরীরের বাকি অংশ তৈরি করে।
এরপর শ্রমিকরা পুরো মূর্তিটির পাথর শক্তভাবে সুরক্ষিত করতে নিয়মিত বিরতিতে লোহার প্রলেপ লাগায়।এই লোহার প্রলেপ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করেছিল যার উপরে মূর্তিটিকে সাজানোর জন্য ব্রোঞ্জ পাতগুলি সেট করা হয়েছিল।
যেহেতু ব্রোঞ্জ হল তামা ও লোহার মিশ্রণ তাই ব্রোঞ্জ পাতগুলি তৈরি করার জন্য তামাকে প্রথমে বড় চুলায় গলানো হয়েছিল এবং পরে এতে ১০%-২০% লোহা যোগ করা হয়েছিল। তারপরে মিশ্রণটি বিভিন্ন ধরণের ছাঁচে ঢেলে এতে মূর্তির শরীরের আকৃতি দেওয়া হয়।ব্রোঞ্জ নির্মিত এ ছাঁচগুলোকে মইয়ের সাহায্যে মূর্তির শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগানো হয়েছিল । তবে এ কাজটি ছিল বেশ কঠিন।কারণ পাতগুলোকে মই বেয়ে উপরে নিয়ে যাওয়ার পরে সেগুলোকে আবার হাতুড়ি দিয়ে লোহার কাঠামোর উপর স্থাপন করতে হয়েছিল।একবারে সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেলে পুরো মূর্তিটিকে পালিশ করা হয়েছিল যাতে সূর্যের আলোর প্রতিফলন এটিকে যতটা সম্ভব উজ্জ্বল করে তোলে।
তবে মূর্তিটির পা রাখার অংশটি শুধুমাত্র পাথরেরই রাখা হয়েছিল।এতে কোন ধাতুর আস্তরণ দেওয়া হয় নি। সম্ভবত মূর্তিটির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় পায়ের অংশকে ভারী রাখতে হয়েছিল।
যেভাবে ধ্বসে পড়ে কলোসাস:
রোডসের কলোসাস প্রাচীন বিশ্বের এক বিস্ময় যার স্থায়িত্বকাল ছিল সবচেয়ে কম। মাত্র ৫৬ বছর বয়সী প্রায়। কিন্ত মূর্তিটির আকৃতি,এর বিশালতা, নির্মাণের কলাকৌশল ও উপকরণের জন্য একে দিয়েছে চরম খ্যাতি।যে কারণে ক্ষণজন্মা হয়েও এখনও এ প্রতিমূর্তি নিয়ে মানুষ ভাবে,তার মত করে আরও মূর্তি বানাতে চায়।
কিন্ত দূর্ভাগ্যের বিষয় যে ২২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক শক্তিশালী ভূমিকম্পের সময় রোডসের কলোসাস ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।কলোসাসের হাঁটুর জয়েন্টে ভেঙে যাওয়ায় পুরো স্তম্ভই গুড়িয়ে পড়ে। তবে এর ধ্বংসাবশেষ ৮০০ বছর ধরে ঘটনাস্থলেই রয়ে গিয়েছিল।আর এ ধ্বংসাবশেষও এমন দেখার বিষয় হয়েছিল যা দেখতেও দর্শনার্থী ভীড় করত।এরপর রোডসবাসীরা পুনরায় মূর্তিটি নির্মাণ করতে চাইলেও ডেলফির ওরাকলের সাবধানতা তথা গ্রীক দেবতা হেলিওসের অসন্তুষ্টতার কথা ভেবে আর পুনর্নির্মাণ করেনি।
এরপরে ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম খলিফা মুয়াবিয়া রোডস দ্বীপ দখল করে কলোসাসের ধ্বংসাবশেষ সিরিয়ান বণিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল । এসব ব্রোঞ্জ ৯০০টি উটের পিঠে পরিবহন করা হয়েছিল। এরপর থেকে রোডসে এই মূর্তির কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এতসব আলোচনার জন্যই রোডসের কলোসাস প্রাচীন বিশ্বের এক বিস্ময়।রোডসবাসীর মতে, এ কলোসাস তাদের রক্ষক ঈশ্বর হেলিওসকে খুশি করার পাশাপাশি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মূর্তি তৈরি করার মাধ্যমে দ্বীপে তাদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করবে।কিন্ত তাদের এ আশা শীঘ্রই ধূলিসাৎ হয়ে যায় যখন প্রায় ৫৬ বছর পরেই তীব্র ভূমিকম্পের সময় মূর্তিটি ভেঙে পড়ে। তবে কলোসাস অব রোডসের এর মত এমন মূর্তি তৈরির আকাঙ্ক্ষা যেন সব জাতিরই স্বপ্ন।কারণ অনেকটা এই কলোসাসের আদলেই নির্মিত হয়েছে বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় প্রতিমূর্তি “স্ট্যাচু অব লিবার্টি ”।
Feature Image: archdaily.com References: 01. The Colossus of Rhodes - critical summary review. 02. Colossus of Rhodes. 03. The colossus of Rhodes. 04. The Colossus Of Rhodes — What Happened To This Wonder Of The Ancient World? 05. Colossus of Rhodes.