ইন্টিগ্রেটেড ইলেক্ট্রনিক্স থেকে এসেছে ইন্টেল কর্পোরেশন (Intel Corporation) এর নাম। এটি একটি আমেরিকান ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি, যারা সেমিকন্ডাক্টর কম্পিউটার সার্কিট প্রস্তুত করে তার গ্রাহকদের জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ায় সান্টা ক্লারা অঞ্চলে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৮ সালে তাদের যাত্রা শুরু করে। ইন্টেল এর শুরুর গল্প, জানা-অজানা অনেক তথ্য নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
শুরুর গল্প
রবার্ট নয়েস এবং গর্ডন মুর নামে দুই জন আমেরিকা ইঞ্জিনিয়ার ইন্টেল (Intel Corporation) প্রতিষ্ঠা করেন। সময়টা ছিল ১৯৬৮, অন্য সব সার্কিট কোম্পানির থেকে কিছুটা হলেও আলাদা ছিল। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন মুর ছিলেন রসায়নবিদ এবং একই সাথে পদার্থবিদ। অন্যদিকে রবার্ট নয়েস ছিলেন পদার্থবিদ। দুইজন মিলে সেদিন এক স্বপ্ন শুরু করেছিলেন বলেই আজ আমরা এত সুন্দর করে সব কাজ সহজেই সমাধান করতে পারছি।
বর্তমানে বাজারে এসেছে সর্বাধুনিক ইন্টেলের নতুন চিপ, যা 16 cores and 24 threads এর, এটি 12th Gen Intel Core processor Core i9-12900K। প্রসেসরের দুনিয়ায় এটি সর্বোসেরা গেমিং প্রসেসর। 4004 নামে ৪ বিটের একটি প্রসেসর দিয়ে যাত্রা শুরু হইয়েছিল ইন্টেলের। মূলত ক্যালকুলেটরে এই চিপ ব্যবহার করা হতো।
জানা অজানা যত তথ্য
ইন্টেল কোম্পানির পূর্ব নাম কী ছিল?
কিছুদিন আগে ৫০ বছর পার করা এই কোম্পানির (Intel Corporation) পূর্বনাম ছিল এন-এম ইলেক্ট্রনিকস (N-M electronics)। প্রতিষ্ঠাতা নয়েস এবং মুরের নামানুসারে এটির নামকরন করা হয়েছিল। সেই সময় ইন্টেলকো নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান ছিল, সেখান থেকে স্বত্ব কেনা হয়, ইন্টেল নামটি প্রতিষ্ঠিত করতে। বর্তমান নাম সবার জানা, ইন্টেল কর্পোরেশন।
ইন্টেল ৬০ হাজার ডলার খরচ করেছিল কেন?
পৃথিবীর যত প্রতিষ্ঠান আছে সবার আছে বেশ মজার মজার ইতিহাস। এখানে মজার কথা হলো ইন্টেল তাদের প্রথম চিপের স্বত্ব কিনেছিল ৬০ হাজার ডলার খরচ করে। জাপানি ক্যালকুলেটর কোম্পানি বিজিকম থেকে এটি তারা কিনে নেয়। ১৯৭১ সালে ৪০০৪ নামে সেই চিপ পরিবর্তিত আর আপগ্রেড করে বাজারে আনে তারা। এটা ছিল ইন্টেল এর মাইক্রো প্রসেসর বেজড কম্পিউটার সিস্টেম প্রসেসর।
জাদুঘরে ইন্টেল নাকি ইন্টেল এর জাদুঘর?
ইন্টেলের যাত্রা শুরু হয় সেই ৭০-র দশকে, এরপর ১৯৮০-এর দিকে তারা নিজস্ব জাদুঘরের কাজ শুরু করেন। যদিও ১৯৯২ সালে তা জনসাধারনের জন্য খুলে দেয়া হয়। প্রায় ১০ হাজার স্কয়ারফিটের এই যাদুঘরে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ দেখতে আসেন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হওয়া সকল চিপসহ নানা ধরনের সিলিকন চিপ, সিলিকন ভ্যালির সকল পথিকৃতসহ আরো অনেকের অনেক কাজের দেখা মিলবে এখানে।
সুট্যেট বুট্যেড কর্মীরা
চিপ তৈরির সময় খুব সাবধানে কাজ করতে হয়। সে হোক চিপ তৈরি, এসাম্বেল করা কিংবা আলাদা করা। এর মূল কারণ হল, সামান্য ধূলিকণা কিংবা বাতাস অথবা পানির বিন্দু কিন্তু একটা চিপের অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে। প্রতিটি কর্মীকে কড়া অনুশাসনে রাখা হতো। শুধু কর্মীরা নয় ধুলাহীন থাকতে হতো চিপ তৈরির রুমও।
সেই সময় কর্মীরা যে স্যুট পড়ত তাকে “বানি স্যুট” বলা হতো। প্রথম দিকে, ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এই পোশাক পড়তেন জরুরী কাজে, পরবর্তীতে এটি ধীরে ধীরে ইন্টেলের জাতীয় পোশাক হয়ে ওঠে।
সময় হাতে সময়ের আগে
তাবৎ দুনিয়ায় যত বড় বড় টেক জায়ান্ট বা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি আছে, সবাই তাদের অবস্থান কেবল তাদের পন্যের জন্য করেনি, সাথে ছিল তাদের কঠোর অধ্যাবসায় আর দূরদর্শী চিন্তাভাবনা। তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। যাত্রা শুরুর কিছুদিন এর মধ্যে ঘড়ি তৈরির ব্যবসায় নামেন মুর-নয়েসের কোম্পানি ইন্টেল।
১৯৭২ সালে শুরু হওয়া এই ব্যবসা ১৯৭৮ সালে টাইম এক্সকে বিক্রি করার আগ পর্যন্ত ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। এখনও তারা বেশ কিছু ঘড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান-এর সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ফসিল অন্যতম জনপ্রিয়।
ইন্টেল-এর নিট মূল্য কত?
প্রায় ৫৪ বছরের এই প্রতিষ্ঠান ২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। সেই সময় নয়েস সিলিকন ইন্টেগ্রেটেড চিপ আবিষ্কার করেন। যদিও তিনি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন, তবু তার স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁবার। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ আর্থার রকের বদান্যতায় শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান মূল্য ১৪৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
কর্মী ছাটাই এবং বাছাই
কর্মী ছাটাই করা কে আমরা যতই খারাপ চোখে দেখি না কেন, ইন্টেল করপোরেশন-এর মতো এত বড় একটা কোম্পানি যদি তা করে, আপনি কিভাবে দেখবেন? ২০০৬ থেকে শুরু করে প্রতি বছর বেশ কিছু কর্মী ছাটাই করে এই প্রতিষ্ঠানটি। এর পেছনে কী কারন থাকতে পারে?
প্রথম দুই বছর প্রায় ১৬ হাজার কর্মী ছাটাই করে তারা। যদি সারা বিশ্বে প্রায় লক্ষাধিক কর্মী কর্মরত আছেন, তবুও অনেকেই জানে না কেন বা কবে তার ছুটির ঘন্টা বাজবে। কেবল কর্মী ছাটাই না এর সাথে ছোট বড় অনেক পরিবর্তন করে থাকে কর্তৃপক্ষ।
ইন্টেল মানুষের জন্য
বড় বড় প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার অন্যতম বড় কারণ তাদের জনসেবা। একদিকে যেমন তারা ব্যাপক অর্থ উপার্জন করে, অন্য দিকে জনসেবা। জনসেবা বলতে কিন্তু শুধু অর্থগত সাহায্য না, আছে সব ধরনের সাহায্য। বিগত কয়েক বছর ধরে, প্রায় ১০০ মিলিয়নের কাছাকাছি অর্থ তারা ব্যয় করছে ক্যালিফোর্নিয়ার বেশ কিছু স্কুল, এন জি ও, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।
এমনকি তাদের কর্মীরা প্রায় ৩০০,০০০ ঘন্টা সেবামূলক কাজে ব্যয় করে। কী দারুন চিন্তা ভাবনা, তাই না? তারা এমনকি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, বিশেষত কম্পিউটার সায়েন্সে আগ্রহী করে তুলছে।
ইন্টেল-এর প্রতিদ্বন্দ্বী কারা?
আজকের দিনে যদি প্রশ্ন করি, এই বিশালাকার টেক কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী কে বা কারা? সবার আগে উঠে আসবে একটি নাম এ এম ডি (AMD: Advanced Micro Devices)। দাম তুলনামূলক কম, তুলনামূলক বেশি কার্যকর আর আধুনিক আই পি সি (জেন ৩) ইন্টেলের চাইতে বেশি হওয়াতে এ এম ডি এগিয়ে গেছে।
মজার ব্যাপার হলো এ এম ডি কিন্তু তার যাত্রা শুরু করে ১৯৬৯ সালে, একই শান্তা ক্লারা থেকে, যেখান থেকে শুরু হয় ইন্টেল। পাশাপাশি এই দুই তুমুল শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী কীভাবে টিকে আছে বলুন তো? কেউ কিন্তু কারো চেয়ে কম নয়।
আমাদের মোবাইল বলুন কিংবা ল্যাপটপ অথবা হাতের স্মার্টওয়াচ, সব খানেই সিলিকন চিপের প্রয়োজনীয়তা আছে। উত্তরোত্তর উন্নতি তারা যেমন করছে আমাদের জন্য, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকার প্রয়াস চলে অবিরত।
এ এম ডি (AMD: Advanced Micro Devices) হোক বা ইন্টেল (Intel Corporation) সবাই নতুন নতুন চিপ বানাতে থাকুক আর আমাদের দৈনন্দিন জীবন হোক আরো সহজতর।
Feature Image: pinteret.com
References:
01.
02.
03.
ntel | History, Products, & Facts | Britannica
https://www.bizjournals.com/sanjose/news/2018/07/10/intel-history-intc.html
https://history-computer.com/intel-history/