ভাইকিং বলতেই লুণ্ঠন আর ধ্বংসকারী এক ভয়ংকর জাতিকেই মনে করি আমরা। কিন্তু, এর বেশিরভাগ ভুল ধারণা এবং কিছুটা অতিরঞ্জিত। অধিকাংশ ভাইকিং মূলত সাধারণ কৃষক ছিল। আজ আমাদের যাত্রা হবে ভাইকিং আমলে। জানবো কারা ছিল এই ভাইকিং আর সাথে থাকবে তাদের জীবনযাত্রা আর দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প।
ভাইকিং কারা
আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১ শতক পর্যন্ত, বিপুল সংখ্যক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাগ্য অন্বেষণে দেশ ত্যাগ করে। এই সামুদ্রিক যোদ্ধা এবং নাবিকেরাই সম্মিলিতভাবে ভাইকিং বা নরসম্যান (উত্তরবাসী) নামে পরিচিতি। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলীয় স্থান, বিশেষ করে অরক্ষিত মঠগুলোতে শুরু হয়েছিল তাদের অভিযান। পরবর্তী তিন শতাব্দীতে, তারা জলদস্যু, আক্রমণকারী, ব্যবসায়ী এবং বসতি স্থাপনকারী হিসাবে ব্রিটেন ও ইউরোপ মহাদেশের বেশিরভাগ অংশে, আধুনিক রাশিয়া, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং নিউফাউন্ডল্যান্ডের কিছু অংশে তাদের চিহ্ন রেখে গেছে।
দৈহিক গঠন
আরবি লেখক ইবনে ফাদলান ভাইকিংদের বর্ণনায় বলেছেন, ”আমি কখনোই এতো নিখুঁত শরীরের মানুষ দেখিনি।” ভাইকিংদের দৈহিক গঠন সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় সেই সময়ের প্রাপ্ত কঙ্কাল থেকে। প্রাপ্ত হাড়গুলো দেখে মনে হয় তারা দাঁতের সমস্যা এবং জয়েন্টের ব্যথায় ভুগছিল। জেনেটিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, পশ্চিম স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং ডেনমার্কের ভাইকিংরা বেশিরভাগই লাল চুলের অধিকারী ছিল। উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়, স্টকহোমের আশেপাশের এলাকায়, স্বর্ণকেশের প্রাধান্য ছিল।
স্বাস্থ্যবিধি এবং সৌন্দর্য
ভাইকিং যুগে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে কাঠ বা হাড়ের চিরুনি । একইসাথে টুইজার, কানের পিক ও মেকআপও ভাইকিংরা নিয়মিত ব্যবহার করতো। ১০০০ সালের দিকে হেডেবি শহর ভ্রমণে যাওয়া এক স্প্যানিশ আরব বলেছেন, শহরের পুরুষ এবং নারী উভয়েই তরুণ এবং আরও আকর্ষণীয় দেখাতে মেক-আপ ব্যবহার করতেন।
পোশাক এবং অলংকার
পুরুষরা ট্রাউজার ও টিউনিক এবং নারীরা স্ট্র্যাপের পোষাক পরতো। স্থানীয় উপকরণ যেমন উল এবং শণ দিয়ে কাপড় বোনা হতো। অন্যদিকে, ধনী ব্যক্তিদের দেহাবশেষ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, বাইজেন্টিয়ামের স্টাইলে রেশম এবং সোনার সুতোর পোশাক আমদানি হতো। নারীপুরুষ উভয়ই বেল্ট এবং পার্স রাখতেন ছোট ছোট জিনিসপত্র এবং পুরুষরা ছুড়ি রাখার জন্য। চামড়ার জুতার প্রচলন ছিল।
পুরুষরা চামড়ার তৈরি ক্যাপ বা বৃত্তাকার মুকুট পরতেন। ভাইকিংরা দুল পরতেন না, তবে চুলে অলংকার এবং শাল বা চাদর বাঁধতে ব্রচ ব্যবহার করতেন৷ এছাড়া যোদ্ধারা পোশাকের সাথে বিভিন্ন অস্ত্র বহন করতেন। এমনকি তারা ওয়াটারপ্রুফ পোশাকও তৈরি করেছিলেন।
ভাইকিং যুগে নারী
লিখিত উৎসের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ভাইকিং নারীরা তুলনামূলক স্বাধীন ছিলেন। তবে, নারী ও পুরুষের সমঅবস্থান ছিল না। নারীদের আদালতে উপস্থিতি এবং উত্তরাধিকারে অংশ নেওয়ার অধিকার ছিল না। বেশিরভাগ নারীরা গৃহিণী ছিলেন। তবে যারা শহরে বাস করতেন, তারা উদ্যোক্তা ছিলেন এবং টেক্সটাইল শিল্পে কাজ করতেন।
উৎসব ও বিনোদন
বিভিন্ন সামাজিক সমাবেশ এবং উৎসবে বোর্ড গেম এবং পাশা খেলার প্রচলন ছিল। এছাড়া গল্প বলা, স্কাল্ডিক কবিতা, সঙ্গীত এবং মদ্যপান ছিল তাদের জীবনের অংশ। জুয়া খেলাও সাধারণ বিষয় ছিল। শীতকালে তারা স্কেটিং করতো।
সংগীত ভাইকিংদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাঁশি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র। এটি সাধারণত হাড় থেকে এবং কখনও কখনও কাঠ থেকে তৈরি হতো। এছাড়াও ছিল ছয় তার বিশিষ্ট বীণার মতো একটি বাদ্যযন্ত্র।
বাসস্থান এবং ব্যক্তিগত জীবন
ডেনমার্কের প্রায় সব জায়গায় ভাইকিংদের বাড়ি পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ ভাইকিং বেড়া দ্বারা আবদ্ধ খামারে বাস করত, যার মাঝে থাকতো লংহাউস বা প্রধান ভবন। এছাড়াও থাকতো আউটবিল্ডিং, শস্যাগার, আস্তাবল এবং ওয়ার্কশপসহ অন্যান্য ভবন। বাড়িতে চিমনি বা জানালা ছিল না। ছাদে একটি গর্ত থাকতো ধোঁয়া বাইরে যাওয়ার জন্য। ধোঁয়া এবং বদ্ধ পরিবেশের জন্য নারী এবং শিশুরা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হতো।
ভাইকিং যুগে আতিথেয়তা এবং ভোজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। ভ্রমণে আসা অপরিচিত ব্যক্তিদের নিকটস্থ খামারে খাবার এবং থাকার ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। গাঁথা সাহিত্য এবং এডিক কবিতায় এসব বর্ণনা পাওয়া যায়।
ভাইকিংয়ের জন্য জীবন কঠিন ছিল। শিশুমৃত্যুর হার ছিল বেশি এবং খুব কম ভাইকিংই ৩৫-৪০ বছর বয়সে পৌঁছাতো। ৫০ বছরের বেশি বয়সের মাত্র কয়েকজন মানুষ ছিলেন। আজকের মতো, নারীরা প্রায়শই পুরুষদের তুলনায় কিছুটা বেশি দিন বাঁচতেন।
ধর্মবিশ্বাস এবং আচারবিধি
নর্স দেবতাদের প্রতি ভাইকিংদের বিশ্বাস প্রায় সমস্ত কাজের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলিদান প্রথা ছিল। ভাইকিং যুগে খ্রিস্টধর্ম একটি শক্তিশালী অবস্থানে ছিল এবং ৮০০ এর দশকে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে।
বাণিজ্য ও ভ্রমণ
বাণিজ্য ছিল ভাইকিংদের অন্যতম পেশা। জার্মানির শ্লেসউইগের হেডেবি বন্দর, ভাইকিং আমলে ডেনমার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। হেডেবির চারদিকে প্রতিরক্ষামূলক দুর্গ ছিল। দুর্গের ভেতরের রাস্তা বণিক এবং কারিগরদের নেটওয়ার্ক হিসেবে ব্যবহার হতো। তারা রাজার সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণে কাজ করত।
৭০০ এর দশকের শুরুতে, রিবে নদীর উত্তর দিকে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাইকিংদের সময়ে পণ্য বিনিময় প্রথা ছিল। পরবর্তীতে রূপা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে লেনদেনের ক্ষেত্রে।
ভাইকিংরা দক্ষ নাবিক ছিল। উন্নত জাহাজ বিশেষ করে, পাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ। ভাইকিং জাহাজ পশ্চিমে গ্রীনল্যান্ড ও আমেরিকা মহাদেশ এবং পূর্বে বাগদাদ ও কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এর মধ্যে লংশিপ সবচেয়ে পরিচিত।
পরবর্তী ভাইকিং যুগের লংশিপগুলো ছিল বিশেষায়িত জাহাজ, যেগুলো উচ্চ গতিতে পৌঁছানোর জন্য এবং সৈন্যদের পরিবহনের জন্য নির্মিত হয়েছিল। এছাড়াও ছিল বাণিজ্য জাহাজ। যুদ্ধজাহাজের মতোই এই ধরনের জাহাজ বিভিন্ন আকারে তৈরি হতো। এগুলো ছোট জাহাজ থেকে শুরু করে ডেনিশ জলের আশেপাশে ৬০ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করতে পারতো।
গির্জা এবং মঠ অভিযান
ভাইকিং যুগের শুরুকে সাধারণত ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ হিসাবে ধরা হয়, ভাইকিং আক্রমণ হয়েছিল বলে নথিতে পাওয়া যায়। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল, উত্তর ইংল্যান্ডের লিন্ডিসফার্ন দ্বীপের একটি মঠ। ভাইকিংদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই আক্রমণগুলো সম্ভবত অর্থের জন্য করা হয়েছিল।
তবে যেহেতু অধিকাংশ সংরক্ষিত লিখিত উৎস সন্ন্যাসীদের লেখা, ভাইকিংদের সম্পর্কে তাদের বর্ণনা স্পষ্টভাবে নেতিবাচক। যেহেতু ভাইকিংরা তাদের নিজস্ব ইতিহাস রচনা করেনি, তাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা এখনও আগের মতোই। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে, তারা বেশিরভাগই বাণিজ্য, মাছ ধরা এবং কৃষিকাজে যুক্ত ছিল।
ভাইকিং যুগের সমাপ্তি
ইংল্যান্ডে ১০০৬ সালে ভাইকিং যুগের সমাপ্তি হয়। সেই সময়ের মধ্যে, সমস্ত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাজ্য খ্রিস্ট ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল, এবং ভাইকিং সংস্কৃতি থেকে যা অবশিষ্ট ছিল তা খ্রিস্টান এবং ইউরোপের সংস্কৃতিতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। আজ, ভাইকিং উত্তরাধিকারের লক্ষণগুলি বেশিরভাগই পাওয়া যায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান উৎসের কিছু শব্দভাণ্ডারে এবং সাহিত্যের একটি বিস্তৃত অংশে।
অবশ্য, এই গল্পগুলো শুধুমাত্র স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় নয়, সারা বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য উত্তরাধিকার রেখে গেছে। সেখানে টিভি শো, সিনেমা, স্পোর্টস দল ও অন্যান্য ক্লাব এবং অ্যাসোসিয়েশন সবই ভাইকিং নামে। ভাইকিংদের গল্প অনেকটাই একপাক্ষিক। তবে, তাদের নিয়ে আগ্রহ এবং গবেষণা এখনও চলছে। কোনদিন হয়তো, তাদের নেতিবাচক গল্পের মাঝে দুঃসাহস আর অভিযানের গল্পও উঠে আসবে।
Feature Image: Life in Norway References: 01. Vikings-history. 02. Viking-age.