জীবনকে আমরা ভালোবাসি কমবেশি সবাই। জীবন দর্শন নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। কেউ এর বহিঃপ্রকাশ ঘটায় নিজের বক্তব্য বা লেখার ভেতর, কেউ হয় নিভৃতচারী আবার কেউবা জীবনের রঙকে ফুটিয়ে তোলে তুলির আঁচড়ে। ফ্রিদা কাহলো ছিলেন শেষোক্ত শ্রেণির। কে ছিলেন এই ফ্রিদা কাহলো? সহজ ভাষায় একজন শিল্পী। যিনি তার নারী সত্ত্বাকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নানানভাবে।
পুরো নাম ম্যাগডেলিনা কারমেন ফ্রিদা কাহলো ওয়াই ক্যালডেরন ডি রিভেরা। জন্ম ৬ জুলাই ১৯০৭। যদিও তিনি মেক্সিকান বিপ্লবের সাথে মিল রেখে জন্মসাল হিসেবে ঘোষণা দেন ১৯১০ সালকে। বাবা গিলেরমো কাহলো এবং মা মাতিলদা ক্যালডেরন। তার ভাষ্যমতে তার বাবা ছিলেন ইহুদী হাংগেরিয়ান বংশোদ্ভূত। যদিও পরবর্তীতে তার বংশমূল চিহ্নিত হয় জার্মান হিসেবে। মা ছিলেন স্প্যানিশ এবং নেটিভ আমেরিকান বংশোদ্ভূত।
তার জন্ম হয় ‘লা কাসা আসুল’ নামের বাড়িতে। এর অর্থ ‘নীল নীড়’। এখানেই বেড়ে ওঠা তার। ফ্রিদা ছিলেন তার বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। খুব ছোটবেলায় পোলিওতে আক্রান্ত হোন তিনি। ফলে তার ডান পা অপেক্ষাকৃত চিকন ছিল। নিজের এই খুঁত ঢেকে রাখতে তিনি দীর্ঘ ঝুলের স্কার্ট পরতেন। ডান পায়ে জুতাও পরতেন সামান্য উঁচু।
এছাড়াও, ‘স্পাইনা বাইফিডা’ নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন জন্মগতভাবে। যার ফলে তার মেরুদন্ড ও পায়ের বৃদ্ধি সঠিকভাবে হতে পারেনি। শারিরীক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতেন। এই আগ্রহ থেকে তিনি বক্সিং-এ যোগদান করেন। এমনকি তিনি একটি গ্যাংয়ের সাথেও যুক্ত হন। সেখানে তার জীবনে প্রেম আসে। তাও আবার সেই গ্যাংয়ের নেতার সাথে।
ফ্রিদা কাহলোর বাবা ছিলেন একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার। তিনি তার বাবার স্টুডিওতে কাজে সাহায্য করতেন। তার তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল। যদিও তিনি বেশ কিছুদিন ড্রয়িং ক্লাস করেছেন, তবে তার আগ্রহের জায়গা ছিল বিজ্ঞান। ১৯২২ সালে তিনি মেডিসিন নিয়ে পড়ার ইচ্ছায় মেক্সিকোর ন্যাশনাল প্রিপারেটরি স্কুলে যান। সেখানে তার ডিয়াগো রিভেরার সাথে পরিচয় হয়। রিভেরা ছিলেন একজন ম্যুরাল আর্টিস্ট।
১৯২৫ সালে তিনি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন। এই জন্য তার জীবদ্দশায় তাকে ৩০ বারের মতো অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল। পড়াশোনাও আর এগুতে পারেনি। কারণ আরোগ্য লাভের প্রক্রিয়া ছিল খুবই ধীর এবং দীর্ঘ। এই সময়টাতে তিনি নিজে নিজে পেইন্টিং শেখা শুরু করেন।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। তার মা তাকে বিশেষ ধরণের তুলি দেন যার সাহায্যে শুয়ে ছবি আঁকা যায়। বাবা ছবি আঁকার সরঞ্জাম যোগান দেন। এই সময় বেশকিছু ছবি আঁকেন তিনি। তার প্রথম দিকের পোট্রের্টে তাকে ভেলভেট ড্রেস পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।
তিনি ১৯২৯ সালে ডিয়েগো রিভেরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। বিয়ের পর তিনি তার ব্যক্তিগত স্টাইল এবং পেইন্টিং-এর ধারা পরিবর্তন করেন। বিয়ের পর তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘তিহুয়ানা’ ড্রেস পরিধান শুরু করেন। মাথায় ফুল, স্বর্ণালংকার, ঢিলেঢালা ব্লাউজ আর লম্বা স্কার্ট। ১৯৩১ সালে করা চিত্রকর্ম ‘ফ্রিদা এ্যান্ড ডিয়েগো রিভেরা’-য় শুধু তার পরিধেয়ই নয়, বরং মেক্সিকান ফোক আর্টের উপর তার আগ্রহের ব্যাপারেও ইঙ্গিত দেয়।
১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ ফ্রিদা এবং রিভেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করেন। রিভেরা তখন ম্যুরাল আর্টিস্ট হিসেবে বিভিন্ন শহরে কমিশনে কাজ করতেন। ঐ সময়ে ফ্রিদার গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দেয়। মিসক্যারেজের ফলে এবং নিজের কিছু প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে তিনি মুষড়ে পড়েন। ঐ সময় তিনি বেশ কিছু বিখ্যাত চিত্রকর্ম সম্পন্ন করেন।
১৯৩২ সালে হেনরি ফোর্ড হসপিটালে তিনি তার বহুল আলোচিত চিত্রকর্ম ‘মাই বার্থ’ আঁকেন। সন্তান জন্ম দেয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয় তিনি তার চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তোলেন।
১৯৩৩ সালে ফ্রিদা এবং রিভেরা মেক্সিকো ফিরে আসেন। সেখানে তারা একটি নবনির্মিত বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। বাড়িটিতে চিত্রশিল্পী এবং রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের আনাগোনা ছিল। তারা ফ্রিদার চিত্রকর্ম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
তখনকার সময়ের একজন আলোচিত সুররিয়েলিস্ট ছিলেন আন্দ্রে ব্রিটন। তিনি ফ্রিদার কাজকে সমর্থন করতেন। ফ্রিদার প্রথম একক প্রদর্শনীর ব্রশিয়ারের ভূমিকায় তিনি ফ্রিদাকে অভিহিত করেন স্বশিক্ষিত সুররিয়েলিস্ট হিসেবে। প্রদর্শনীটি ১৯৩৮ সালে নিউইয়র্কের জুলিয়ান লেভি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং ব্যাপক সাফল্য পায়।
তার পরের কয়েক বছর তিনি তার চিত্রকর্ম প্রদর্শনের জন্য প্যারিস ভ্রমণ করেন। সেখানে তার অন্যান্য সুররিয়েলিস্টদের সাথে পরিচয় হয়। ২০ শতকের প্রথম মেক্সিকান শিল্পী হিসেবে তার আঁকা ‘দ্য ফ্রেম’ (১৯৩৮) লুভ্যর মিউজিয়াম কালেকশনে স্থান পায়।
১৯৩৯ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের কারণ ছিল একাধিক। রিভেরার পরনারীতে আসক্তি, ফ্রিদার অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব তিক্ত করে তুলেছিল।
১৯৪০ সালে তারা পুনরায় বিয়ে করেন। তবে এবারের পরিস্থিতি ছিল পূর্বের চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। এরপর তিনি আর কখনো বিয়ে করেননি। তিনি বলেন –
আমার জীবনে দূর্ঘটনা দু’টি। একটি বাস এক্সিডেন্টে, অন্যটি ডিয়াগো। আর ডিয়াগোই এর ভেতর অধিকতর মন্দ।
তবে এটা ঠিক এতকিছুর পরও তিনি ডিয়াগোকেই ভালোবেসে গেছেন। ডিয়াগোর জন্য তার বাৎসল্য, প্রেম সবই ছিল অনেক গভীর। তার জগতের পুরোটা জুড়েই ছিল ডিয়াগো। তার চিত্রকর্মেও তিনি বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন।
তার ১৪৩টি পেইন্টিং-এর মধ্যে ৫৫টি আত্মপ্রতিকৃতি। আত্মপ্রতিকৃতি আঁকা সম্পর্কে তিনি বলেন-
আমি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকি কারণ প্রায়শই আমি একা, কারণ আমি আমাকে সবচেয়ে ভালো জানি।
তিনি আরো বলেন-
লোকে ভাবে আমি পরাবাস্তববাদী। কিন্তু আমি তা না। আমি স্বপ্ন আঁকি না। আমি আঁকি আমার নিজস্ব বাস্তবতা।
পেইন্টিংগুলোর মধ্যে তিনি অনেক রূপক বিষয় এবং অব্যক্ত কথা তুলে ধরেছেন। তাকে পরাবাস্তববাদী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। যে সময় সবাই হলিউডকে অনুসরণ করে পোশাক পরিধান করতেন সেই সময়টাতে তিনি মেক্সিকোর ঐতিহ্যের আদলে পোশাক ডিজাইন করেন। তার ফ্যাশন মানুষ এখনও অনুসরণ করে।
তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। মৃত্যুর এত বছর পরও তাকে নিয়ে চর্চা একটুও কমেনি। বরং আরো বেড়ে চলেছে। বই, পেইন্টিং, পুতুল, কাপড়, গয়না সব জায়গায় ফ্রিদার আধিপত্য। হেইডেন হেরেরা-র ‘ফ্রিদা- দ্য বায়োগ্রাফি অব ফ্রিদা কাহলো’ (১৯৮৩) বেশ সাড়া ফেলেছে। তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। অভিনয় করেছেন গুণী অভিনেত্রী সালমা হায়েক।
১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই এই গুণী শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে। তবে এত বর্ণাঢ্য এক জীবন তিনি পার করে গেছেন যে মৃত্যু তাকে নিয়ে চর্চা থামাতে পারেনি। তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলে শেষ হবে না। জীবনে বহুবার তিনি দুঃসহ বেদনায় নীল হয়েছেন, ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে বেড়িয়েছেন তবুও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ব্যথাগুলো তাকে জীবনকে পড়তে শিখিয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছেন এক কঠিন বাস্তবতার মূর্ত প্রতীক।
Feature Image: bbc.com Reference: 01. Frida Kahlo. 02. Frida Kahlo. 03. Frida Kahlo Biography.
দারুণ লিখা, পড়ে ভালো লাগলো।