স্মৃতির পাহাড় ঝরবে শুধুই আমার বুকের বামে
নিখোঁজ হওয়ার লিস্টি থাকুক আনজিকুনি গ্রামে!
১৯৩০ সালের কথা। শরৎ শেষের দিকে। নভেম্বর মাস ক্রমশ শীতের দমদমাতে তার আগমন জানান দিচ্ছে। চারপাশ চাঁদরে মোড়ানো শীতের আবেশে। এমনকি হাঁটা-চলার পথঘাটও বরফে আবৃত। কানাডার এক প্রত্যন্ত এস্কিমোদের গ্রাম। নাম আনজিকুনি। গ্রামের নাম পাশে অবস্থিত আনজিকুনি লেকের নামানুসারে।
লেকে রয়েছে বিপুল পরিমাণে পাইক এবং ট্রাউট মাছের সমাহার। আর এই আনজিকুনি গ্রামটি কানাডার বিরল এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাজান নদীর তীরে অবস্থিত। পৃথিবীর প্রতিদিনকার নিয়মের মতোই এখানে সূর্য উঠে আর অস্ত নামে। লেকের পেছনে পাইন গাছের অবাধ সারি আর মানুষের কোলাহল; আনজিকুনি গ্রামের মানুষ এভাবেই পার করে যাচ্ছিল তাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের মোড়। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন ঘনিয়ে আসে এক লোমহর্ষক ঘটনা।
ঘটনার সূত্রপাত সেই নভেম্বর মাসেই। জো লেবেলে নামের একজন আনজিকুনিতে আসে। লেবেলে পেশায় শিকারী। প্রত্যেকবারের মতো বছরের রসদ আর মাংস নিয়ে লেবেলে এসে ঢুকে তার প্রিয় আনজিকুনি গ্রামে। শিকারের সন্ধানে এবার লেবেলে বেশ কিছু সপ্তাহ গ্রামের বাইরে ছিল। তো গ্রামে ঢুকেই অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতার খরা স্রোত লেবেলের শিরাতে বয়ে গেল। মনে হচ্ছে সমস্ত গ্রাম যেন এক মৃত আত্মা। লেবেলে ভাবলো হয়তো আজ একটু তাড়াতাড়ি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে গ্রামের ভেতরে যায়।
কিন্তু গ্রামের যত ভেতরে যায় লেবেলের চোখ আস্ত চড়কগাছ দেখছে যেন! পুরো গ্রামে পিনপতনের নীরবতা। লেবেলের গায়ে এবার কাঁটা দিতে শুরু করে। শেষ আশা নিয়ে সে গ্রামের মধ্যখানে এসে দাঁড়ায়। এস্কিমোদের এই গ্রামগুলোতে অতিথিদের জন্য সবসময় কিছু বিশ্রামখানা খোলা থাকে। যত রাত হোক এই বিশ্রামখানা গুলোতে মানুষজন পাওয়া যায়। লেবেলে ঠিক এসে দাঁড়ায় গ্রামের তেমন এক বিশ্রামখানার সামনে। এবং এবার তার মনে চূড়ান্তভাবে ধরা পড়ে গ্রামে ভয়াবহ কিছু হয়েছে।
বিশ্রামখানার আশেপাশে মানুষের টিকিটুকুও নেই। লেবেলে এবার এস্কিমোদের ঘরগুলো ঢুকে দেখতে লাগলো। নাহ! কোথাও কেউ নেই। কুড়েঘরগুলো খালি। ঘরের মধ্যে খাবারগুলো উনুনের পাশেই রয়েছে। এস্কিমোরা তাদের অস্ত্র ছাড়া কখনো বাইরে যায় না। যথারীতি অস্ত্রগুলোও ঘরের এক কোণাতে রয়েছে। তাহলে মানুষগুলো গেল কোথায়?
বাইরে স্থানীয় লোকদের কায়াক নৌকাগুলি ঠিক স্বাভাবিক জায়গায় রয়েছে মানে ঘাটে ছিল। এবং তারচেয়েও আশ্চর্যের কথা সমস্ত প্রয়োজনীয় গৃহস্থালী জিনিসপত্র এবং অস্ত্র বাড়িতে রাখা। এমনকি ঘরে হাঁড়িতে পাওয়া ঐতিহ্যগত স্টুও পড়ে রয়েছে। লেক থেকে পাওয়া মাছের মজুদও ছিল জায়গায়। এক কথায় বলতে গেলে মানুষ ছাড়া পুরো গ্রামের সবকিছু ঠিক আগের মতোই ছিল।
প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি উপজাতি সমৃদ্ধ একটি গ্রামের মানুষ যাদের কিনা কোনো পাত্তাই নেই। তাও আবার ঝড়-তুফান ছাড়া প্রতিদিনকার মতো সাধারণ একটি দিনে কোনও চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেল। লেবেলে আশেপাশে অনেক অনুসন্ধান করেও কোনো বলাৎকার বা জুলুমের নমুনা পেল না। আর এই নমুনা না পাওয়া পুরো পৃথিবীর জন্য বয়ে আনলো এক রহস্যের আভাস। লেবেলের পেটে তখন ভয়ে অবর্ণনীয় আতঙ্ক এবং উত্তেজনা শুরু হয়েছে। সে আর দেরী না করেই ছুট লাগায় টেলিগ্রাফ অফিসে।
রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেন পুলিশকে একটি সতর্কবার্তা প্রেরণ করে। যেহেতু কেউ কখনও এমন ঘটনা কিছু শুনেনি তাই পুলিশ অবিলম্বে গ্রামে অভিযান পাঠায়। লেকের সমগ্র কিনারা ধরে তন্নতন্ন করে গ্রামের লোকজনের খোঁজ করা হয়। যখন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তখন আরও বেশ কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হয়। যা ইঙ্গিত করে যে মানুষের নিখোঁজ হওয়ার সাথে রহস্যময় প্রকৃতির সংযোগ ছিল।
প্রথম কথা, এস্কিমোরা কোনো স্লেজ কুকুর নেয়নি। যেটা লেবেলেও প্রথমে খেয়াল করেছিল। দ্বিতীয়, বরফের ভেতরে কঙ্কাল গভীরে পাওয়া যায় যারা মুলত ক্ষুধায় মারা গিয়েছিল। তদুপরি, এটি প্রমাণিত হয় যে পূর্বপুরুষদের কবরগুলি খোলা হয়েছিল এবং মৃতদের দেহগুলি কোনও চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যায়। স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি একদম নাড়িয়ে দেয়।
যেহেতু স্লেজগাড়িগুলো ব্যবহার হয়নি তার মানে দাঁড়ায় তারা যদি স্বেচ্ছায় গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, তাহলে কুকুরগুলোকে বেঁধে রেখে যেত না। তারা কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিতো যাতে নিজেদের খাবার খুঁজে নেওয়ার সুযোগ পায় কুকুরগুলো। অনুসন্ধানে অংশ নেওয়া এক পুলিশ কর্মকর্তার মতে,
আনজিকুনি গ্রামে যা ঘটেছে তা শারীরিকভাবে একেবারেই অসম্ভব।
সাত দশক কেটে যাওয়ার পরেও এই দাবিকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত কানাডা কর্তৃপক্ষ লেক আনজিকুনির রহস্যের সমাধান করতে পারেনি। তাছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ এস্কিমোদের সেই গোত্রের সদস্যদের কোনো বংশধরদের খুঁজে পায়নি। এবং সবকিছু দেখে যে কারো মনে হবে আনজিকুনি নামে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব পৃথিবীতে কখনও ছিল না।
অন্তত একটি গোটা গ্রামের এমন অদ্ভুত নিখোঁজ হওয়া সমস্ত যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করার মতো। এমনকি যদি কেউ উপজাতির উপর আক্রমণ করতো, পুলিশ লোকদের দেহাবশেষ বা সংঘর্ষের চিহ্ন খুঁজে পেতো। কিন্তু সেরকম কিছুই পাওয়া যায়নি পুরো গ্রামের নাড়ি নক্ষত্র খুঁজে।
আর এভাবেই ইতিহাসে কাজান নদীর পাশের এই শান্তশিষ্ট এস্কিমো গ্রামটি “মৃতদের আত্মা”র গ্রাম বলে পরিচিতি পায়। আনজিকুনির সঠিক হদিশ বলতে গেলে একটু কানাডার নুনাভুতের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত নুনাভুত হল কানাডার সবচেয়ে বৃহত্তম একটি অঞ্চল এবং উত্তরের মধ্যে সবচেয়ে বড়। পৃথিবীর সবচেয়ে কম জনবহুল অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি হলো এই নুনাভুত।
নুনাভুতে জনপ্রতি ৫০ বর্গ কি.মি ভূমি অতি অনুর্বর, পাথর বেষ্টিত এবং বরফে আচ্ছাদিত। গ্রিনল্যান্ডের অর্ধেক ঘনত্ব এই অঞ্চলকে ঘিরেই। আনজিকুনি লেক থেকে ১৫০০ কি.মি পূর্বে সাত হাজারের এর কম জনসংখ্যার এর রাজধানী হলো ইকালুইট। এই বিশাল ভূখণ্ডের মধ্যে শুধুমাত্র এটিই প্রধান বসতি।
নুনাভুত কানাডাতে আর্কটিক দ্বীপপুঞ্জের বেশিরভাগ অংশকে ঘিরে রেখেছে এবং এর মূল ভূখণ্ডের অংশটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে হিমবাহ দ্বারা সমতল। যা শুধুমাত্র অনুর্বর শিলা দিয়ে বেষ্টিত। তুন্দ্রাকে অগভীর পুকুর এবং স্রোত দ্বারা আবৃত হয়ে এখানে লেকের সৃষ্টি করেছে। যা থেকে আনজিকুনি লেকের উৎস।
বছরের বেশিরভাগ সময় এটি বরফ এবং তুষারে ঢাকা একটি অবিচ্ছিন্ন সমতল সমভূমি হিসেবে দেখা যায়। আনজিকুনি থেকে পাঁচশ কি.মি মধ্যে যেকোনো কিছু দেখা এক কথায় অসম্ভব; সম্পূর্ণরূপে অস্পষ্ট। মানুষ কানাডার এই অংশটিকে অনুর্বর ভুমি বলে আখ্যায়িত করে।
আনজিকুনির নিশ্চিহ্ন নিয়ে প্রথম দর্শক জো লেবেলের বর্ণনা নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত আর্টিকেলটি আসে ১৯৫৯ সালে ফ্রাঙ্ক এডওয়ার্ডসের বই ‘স্ট্রেঞ্জার দ্যান সায়েন্স’। যেখানে লেবেলে থেকে শুরু করে পুলিশ সবার তদন্তের বর্ণনা উঠে আসে। বইটির শেষ অধ্যায়ে এডওয়ার্ড লিখেন,
কয়েক মাস ধরে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান আর হাড় ভাঙ্গানো তদন্তের পরেও পুলিশ আনজিকুনি গ্রামের কোনো এস্কিমোর নাগাল পায় না। একসময় কেসটি ‘অমীমাংসিত’ কেসদের র্যাকে চলে যায় আর তাবৎ রহস্যের ভাণ্ডার কাঁধে নিয়ে আনজিকুনি লেক বয়ে চলেছে আপণ গতিতে।
পৃথিবীতে নিখোঁজ হওয়ার এই সারিতে শুধু যে কানাডার আনজিকুনি গ্রাম তা নয়। কেনিয়ার এনভাইটনেট দ্বীপ, রাশিয়ার লেক প্লেশচেয়েভো, উত্তর আমেরিকার রোয়ানোক এমন অনেক অঞ্চল; ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বি বাথর্স্ট, নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির বোঝা কাঁধে নিয়ে হারিয়ে গেছে অতল পৃথিবীর বুকে।
নিখোঁজের এই তালিকা থেকে একটি কথা নিশ্চিত যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিডিয়ার পাতায় এসবের খবর আসে না, কারণ অজ্ঞাত এই রহস্যের কারণ সম্পর্কে বলার মতো বা সাক্ষ্য দিতেও কেউ থাকেনা! কেউ থাকেনি!
Feature Image: Pinterest.com References: 01. Lake Anjikuni Village. 02. Village of the dead: The enduring mystery of Anjikuni. 03. Village of the dead: Anjikuni mystery.
রীতিমতো গায়ে কাটা দিছিল। মনে হচ্ছিল কোনো গোয়েন্দার গল্প পড়ছি। এবার বোধয় কিছু খুঁজে পাবে কিন্তু না। ইতিহাস নিয়ে এমন অসাধারণ লেখা আমার চোখে খুব কম এসেছে। অসাধারণ লেখা। আর ছবি গুলিও এক একটি সাক্ষী করা ইতিহাস। অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ লেখা 👌👌👌👌👌
রহস্যজনক আসলেই। কি হয়েছিল আল্লাহ ভালো জানে।
অদ্ভুত। কি হয়েছিল আসলে?
অসাধারণ একটি লেখা।। আমাদের হারানো শহড় হরপ্পা-মহেঞ্জদরোর কথা মনে পরিয়ে দেয়।।
স্মৃতির পাহাড় ঝরবে শুধুই আমার বুকের বামে
নিখোঁজ হওয়ার লিস্টি থাকুক আনজিকুনি গ্রামে.অসাধারন❤️
অসাধারণ লাগলো। বিশেষ করে একদম রহস্যঘেরা গল্পের মতো। আসলেই অসাধারণ
❤️
লেখা জীবনমুখি হলে পড়তে গিয়ে অতলে হারিয়ে যেতে হয় এভাবেই! আমার পড়তে ভীষণ ভাল লাগলো। এত সাবলীল আর কোথায় যেন মায়া ভরে লেখা। এই আবেগ লেখিকার কলমে অন্যরকম শক্তি এনে দেয়।
স্মৃতির পাহাড় ঝরবে শুধুই আমার বুকের বামে
নিখোঁজ হওয়ার লিস্টি থাকুক আনজিকুনি গ্রামে!
এক কথায় অসাধারন❤️
Reply