ইতিহাদ এয়ারলাইন্স (Etihad Airlines) এর যাত্রা কেবল ২০ বছরের হলেও মিডল ইস্টসহ সমস্ত বিশ্বে প্রায় ভালো সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রায় শতাধিক এয়ারক্র্যাফটস নিয়ে বিশ্বের নানাপ্রান্তে প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়াচ্ছে।
ঠিক ১৯ বছর আগে ২০০৩ সালের জুলাই মাসে শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এর অনুমতিক্রমে এবং রাজকীয় ফরমান বা ডিক্রি অনুসারে, এটি যাত্রা শুরু করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বিতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স এটি। বেশ প্রশস্ত এই ধরনের এয়ারক্রাফটের চাহিদা বিশ্বে নানা দেশে রয়েছে, এই বিষয়কে মাথায় রেখে এই এয়ারলাইন্স উত্তরোত্তর বেশ উন্নতি করে গেছে এবং যাচ্ছে। এই এয়ারলাইনসের কিছু জানা-অজানা তথ্য নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
নামকরণের ইতিহাস
২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই এয়ারওয়েজ-এর ইতিহাদ, আরবি শব্দ “ইতিহাদ” যার অর্থ ঐক্য থেকে এসেছে। সেখান থেকে নামকরণের কিছুটা রোমানিকরণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একজন শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান-এর ফরমান অনুসারী এই প্রতিষ্ঠানটি তার যাত্রা শুরু করে ২০০৩ সালে। শুরুর দিকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন আরব আমিরাত দিরহাম মূলধন ছিল এই এয়ার ওয়েজের।
প্রথম যাত্রা
২০০৩ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত এই এয়ারওয়েজের প্রথম যাত্রা ছিল একই সালের ৫ নভেম্বর। এটি ছিল উদ্বোধনী ফ্লাইট। পরবর্তীতে ১২ নভেম্বর বৈরুতে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে অফিসিয়ালভাবে তাদের যাত্রা শুরু হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি শুরুর আগে আবুধাবি হতে পরিচালিত অধিকাংশ এয়ারওয়েজ ছিল গলফ এয়ার লাইন্সের যার বেশিরভাগ বাহরাইন এবং ওমানের অংশ ছিল।
গন্তব্য
ইতিহাদ এয়ারওয়েজ পরিচালিত বিমান প্রায় শতাধিক গন্তব্যস্থলে প্রতিদিন যাতায়াত করে। গন্তব্যস্থলের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের বিভিন্ন দেশ। গন্তব্যস্থলগুলো হলো পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এদের নানা দেশ।
ব্রিট্রিশ এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, কোরিয়ান এয়ার, কোয়ান্টাস, কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সসহ পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশেই তাদের বিমান পরিচালনা করে থাকে, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ তার মধ্যে অন্যতম। প্রতি সপ্তাহে পৃথিবীর ৫৫টি দেশের ৮৫টি গন্তব্যে ১৩০০ এর অধিক ফ্লাইট যাতায়াত করে। কেবল যাত্রী পরিবহন করেই ইতিহাদ থেমে থাকেনি। ইতিহাদ কার্গো প্রতিনিয়ত প্রচুর পণ্য পরিবহণ করে।
সদর দপ্তর
আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকট খলিফা সিদ্দিকে ইতিহাদের সদর দপ্তর অবস্থিত। ২০০৭ সালে নতুন হেড অফিস, ট্রেনিং সেন্টার এবং সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য প্রায় ১৮৪ মিলিয়ন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিরহাম ব্যয় করা হয়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের বিমানবহরে নিম্নের বিমানগুলো রয়েছে:
- এয়ারবাস এ৩১৯-১০০ (২টি)
- এয়ারবাস এ৩২০-২০০ (২৩টি)
- এয়ারবাস এ৩২১-২০০ (১০টি)
- এয়ারবাস এ৩৩০-২০০ (২০টি)
- এয়ারবাস এ৩৩০-৩০০ (১০টি)
- এয়ারবাস এ৩৪০-৫০০ (৩টি)
- এয়ারবাস এ৩৪০-৬০০ (৭টি)
- এয়ারবাস এ৩৮০-৮০০ (৮টি)
- বোয়িং ৭৭৭-২০০এলআর (৫টি)
- বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর (২৪টি)
- বোয়িং ৭৮৭-৯ (৯টি)
- এয়ারবাস এ৩৩০-২০০এফ (৪টি)
- বোয়িং ৭৪৭-৪০০এফ (১টি)
- বোয়িং ৭৪৭-৮এফ (১টি)
- বোয়িং ৭৭৭এফ (৫টি) এবং অন্যান্য।
উত্থান-পতন
২০২০ সালে কোভিড ১৯ যখন সমস্ত বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয় তার প্রভাব পড়েছিল এই এয়ারলান্সেও। একটা সময় বাধ্য হয়ে কিছু বিমান কার্গো হিসেবেও ব্যবহার করতে হয়েছিল। এদের মধ্যে বোয়িং ৭৪৭ ২০২০ সালে অস্থায়ী কার্গোপ্লেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জনসাধারণের চলাচল বন্ধ থাকায় বেশ বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
অনেকগুলো এয়ারবাসের মধ্যে এ৮০ এয়ারবাস গুলো ২০২০ সালে কোভিড অ্যাটাকের পর আর ব্যবহার করা হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির সূত্র মতে, তারা সেই ক্ষতি বেশ ভালোভাবেই পুষিয়ে গেছেন।
জানা-অজানা কিছু কথা
১. সংযুক্ত আরব আমিরাতে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ এয়ারলাইন্সের প্রতিষ্ঠান ইতিহাদ এয়ারলাইন্স। উত্তররোত্তর সেবার মান, ফ্লাইটের ভিন্নতা, গন্তব্য, পণ্য পরিবহন এবং অন্য সব সুবিধার জন্য এটি উন্নতি করে যাচ্ছে।
২. এই এয়ারলাইন্সের ভাড়ার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য এয়ারলাইন্স থেকে কম। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবার জন্য রয়েছে সেই সুযোগ। নানা ধরনের ক্লাস এবং নানা ধরনের সিট থেকে আপনার বাজেট এবং প্রয়োজন অনুসারে নিজের সিট বুকিং দিতে পারবেন।
৩. এক একটি প্লেনের প্রতিটি সিট প্রায় দুই মিটার। প্রতি সিটের সামনে রয়েছে ১৫ ইঞ্চি স্ক্রিন, যা ভিডিও দেখা বা অন্য কাজের জন্য বেশ আরামদায়ক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দীর্ঘ ভ্রমণে আপনি ক্লান্ত হবেন না। কারণ ইতিহাদ আপনার বিনোদনের জন্য ভিডিও-অডিও গেমসহ নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা মজুদ রেখেছে।
৪. প্রতিটি ফ্লাইটের নিবেদিত প্রাণ ন্যানী, ডাক্তার, নার্স রয়েছে, আপনি যে ক্লাসের সিট বুক করেন না কেন, সেবার মানে কোন ভেদাভেদ নেই।
৫. ট্যাক্স ফ্রি শপিং করতে পারবেন আপনি পারফিউম, কস্টিউমস, জুয়েলারি এবং প্রি-অর্ডার এর ক্ষেত্রে প্রায় ১০% ডিসকাউন্ট তারা দিয়ে থাকে।
৬. বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত এই এয়ারওয়েজ-এর কেবিনগুলো যথেষ্ট উন্নতমানের এবং রুচিশীল। ইকোনমি থেকে শুরু করে ফাস্ট ক্লাস বা বিজনেসসহ নানান নামে কেবিন বা সিট সুবিধা রয়েছে। কেবিনের নাম এবং ভাড়ার ভিন্নতা ভেদে সুবিধা কিছুটা কম-বেশি হতে পারে; তবে সেবার মান নিয়ে কোন সন্দেহ রাখার অবকাশ নেই।
৭. কেবিন এবং ভাড়ার তারতম্য থাকলেও খাবার এবং সেবার মান সবসময়ই সেরা। প্রতিটি যাত্রীর জন্য অত্যন্ত সুস্বাদু এবং মানসম্মত খাবার পরিবেশন করা হয়। সাথে রয়েছে সুপেয়পানীয়। সংশ্লিষ্ট কর্মীরা সবসময় যাত্রীদের সেবার দিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে থাকেন এক্ষেত্রে।
৮. প্রয়োজনবোধে যাত্রীরা তাদের ফ্লাইট বা এয়ারপোর্ট চেঞ্জ করতে পারবেন, বিশ্বস্ত মাধ্যমে। ধরুন, প্রয়োজন অনুসারে আপনার ফ্লাইট এই শহর থেকে না নিয়ে অন্য শহর থেকে নেয়া ইতিহাদ-এর সাথে সংযুক্ত এজেন্সির মাধ্যমে সেটি বদলে ফেলতে বেগ পেতে হবে না।
৯. বিশ্বের অন্যতম সেরা ওয়েটিং লাউঞ্জ, ডাইনিং সুবিধা রয়েছে এই এয়ারলাইন্সের। বিশ্রাম করতে পারবেন, কোন রকম ভোগান্তি ছাড়াই।
১০. বিমানে যাত্রার সময় পাবেন পাবলিকেশন্স, যেখানে এই প্রতিষ্ঠানের সব সুবিধা নিয়ে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। কোথায় কোন ফ্লাইট যাবে, কবে যাবে, কখন যাবে ইত্যাদি সম্পর্কে সহজেই জেনে নিতে পারবেন।
বিশ্বের অন্যতম সেরা এয়ারলাইন্সের তালিকায় প্রথম সারিতে থাকা এই ইতিহাদ এয়ারলাইন্স মাত্র ২০ বছরে পা দিলো। অথচ ইতোমধ্যেই যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে, এটি ফাইভ স্টার এয়ারলাইন্স বলে চিহ্নিত। এর সার্ভিস, কাস্টোমারদের সাথে ভালো এবং সৎ আচরণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সব মিলিয়ে গ্রাহক পর্যায় থেকে বেশ ভালো ফিডব্যাক পাচ্ছে। সততা আর নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করছেন বলেই নিজেরা অন্য অনেক এজেন্সি থেকে বেশ এগিয়ে রয়েছেন। আশা করা যায়, আর কিছুদিনের মধ্যে এর অবস্থান আরো উপরে চলে আসবে, এবং পৃথিবীর নানা প্রান্তের সাথে মানুষ যুক্ত হতে পারবে এই এয়ার লাইন্সের মাধ্যমে।
Feature Image: unsplash.com References: 01. 20-interesting-facts-about-Etihad-airways. 02. Etihad-airways/history. 03. From Abu Dhabi To The World: The History Of Etihad Airways.