মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড়। কথাটা আসলে মিথ্যে নয়। স্বপ্ন দেখার সাহস সবার হয় না। আর যারা এই সাহসটা করতে পারে তারা নিজেরা কখনও কল্পনা করতে পারে না যে, তাদের স্বপ্ন একদিন তাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে! এমনই একজন স্বপ্নবাজ মানুষ জেফ বেজোস। তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন।
বইফেরি করা দিয়ে শুরু করে আজ বিশ্বের মানুষের প্রতিটি প্রয়োজনে পাশে আছে প্রতিষ্ঠানটি। এর প্রধান কার্যালয় বর্তমানে ওয়াশিংটনের সিয়াটলে। গ্যারেজ থেকে শুরু করা সেই ছোট্ট স্বপ্নটি আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে পুরো পৃথিবীর ক্যানভাসে।
জেফ নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন পদার্থবিদ্যা ও গণিতের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু একটি পার্শিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন বদলে দেয় তার ক্যারিয়ারের গতিপথ। সময়কাল ছিল ১৯৮৪। এরপর ১৯৮৬ সালে প্রিস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর স্নাতক সম্পন্ন করেন।
পেশাগত জীবনে তিনি খুব দ্রুত সাফল্য লাভ করেছিলেন। স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি ওয়াল স্ট্রিট ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে যোগদান করেন এবং কয়েক বছরের ব্যবধানে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত হন। তিনিই ছিলেন উক্ত পদে নিযুক্ত সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি। পরবর্তীতে নিজে কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে তিনি সিয়াটলে পাড়ি জমান। এবং সেই স্বপ্নটা ছিল একটা ই-কমার্স সাইট প্রতিষ্ঠা করা।
৫ জুলাই, ১৯৯৪। প্রতিষ্ঠা হলো বেজোসের স্বপ্নের অনলাইন বিজনেস সাইট। নাম রাখা হল ক্যাডাবরা ইঙ্ক। তবে এটিকে ক্যাডাভার ভেবে মানুষ ভুলভাল উচ্চারণ করতে থাকে। এ তালিকায় বেজোসের আইনজীবীও ছিল। এরপর সাইটটির নাম রাখা হয় রিলেন্টলেস। বেজোস Relentless.com নামে ডোমেইন নেইম কিনেছিলেন।
১৯৯৪ সালে জেফ বেজোস অ্যামাজন ডট কম নামটি প্রাথমিকভাবে চিন্তা করেন। কারণ অ্যামাজন শব্দটি শুরু হয় ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম বর্ণ দিয়ে। আবার একটি দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত নদীর নাম। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর বই বিক্রিকেই তার সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। তাদের অঙ্গিকার ছিল, যে কোনো বই যে কোনো পাঠকের কাছে যে কোনো জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। সেই সাথে এই প্রযুক্তি কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল অনলাইন সেবা মানুষের কাছে কত সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়।
জেফ বেজোস ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত কোম্পানির সিইও পদে ছিলেন। এরপর তিনি কোম্পানির নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে যোগদান করেন। অ্যামাজন সর্বসাধারণকে যুক্ত করে ১৯৯৭ সালে। অর্থাৎ জনগণও এখন অ্যামাজনের শেয়ার কিনতে সক্ষম।
অ্যামাজনের সব থেকে সুদূরপ্রসারী ব্যবসায়িক সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় ১৯৯৯ সালে নেয়া একটি সিদ্ধান্ত।
সে বছর তারা সাইটের মাধ্যমে থার্ড পার্টি সেলারদের পণ্য কেনাবেচার সুযোগ করে দেয়। ফলে পরবর্তী চারমাসে এর গ্রাহক সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০০৫ সালে কাস্টমার লয়্যালটি প্রোগ্রাম ঘোষণা করা হয়। এই প্রোগ্রাম মোতাবেক কাস্টমার বছরে ৭৯ ডলার প্রদান করে যে কোনো পণ্য ফ্রি শিপমেন্টে নিতে পারবে এবং পণ্যও পৌঁছে দেয়া হবে দুই তিন কর্মদিবসের ভেতর।
ইলেকট্রনিক ই-কমার্সের দুনিয়ার আইকনিক উদাহরণ হলো অ্যামাজন ডট কম। এটি মূলত একটি বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি। এরা কাজ করে ই-কমার্স, ডিজিটাল স্ট্রিমিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি এবং ক্লাউড কম্পিউটিং নিয়ে। এই বিশাল ব্যাণ্ডভ্যালুর কোম্পানিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল বেলভিউয়ের ছোট্ট গ্যারেজ থেকে। বই, সিনেমা, ইলেকট্রনিক পণ্য, গৃহস্থালি জিনিসপত্র, খেলনা এবং আরও বহুরকম পণ্য মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে অ্যামাজন।
আজ আমরা বিশ্বসাহিত্যের রস আস্বাদন করতে পারছি একেবারে কাগুজে বই দিয়ে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের যে কোনো ভাষার সাহিত্যের বই আমরা যে কোনো সময় অর্ডার করতে পারি অ্যামাজনের মাধ্যমে। এরপর হাতে পাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। সিনেমা জগতেও সাফল্যের ছাপ রেখেছে অ্যামাজন। দৈনিক ব্যবহার্য জিনিস বিক্রি থেকে শুরু করে ওয়েবাসাইট ভাড়া দেয়া সবই সমান তালে সফলতার সাথে করছে অ্যামাজন।
পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই কাজ করে অথবা ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। আর ক্লাউড কম্পিউটিং তাদের ওয়েব সার্ভিসের আওতায় পড়ে। তাদের তৈরি কিন্ডেল ই-বুক জগতে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। ই-বুক পাবলিশিং উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
নিঃসন্দেহে পৃথিবীর একটি সফলতম অ্যাফিলিয়েট ওয়েবসাইট অ্যামাজন। কয়েক বছর আগেও এক দেশের মানুষ আরেক দেশ থেকে কাজের বা শখের কোনো পণ্য এত সহজে আনতে পারতো না। নানারকম আন্তর্জাতিক জটিলতায় পড়তে হতো। এখন অ্যাফিলিয়েট ওয়েবসাইটের বদৌলতে ঘরে বসেই পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে পছন্দের প্রোডাক্ট অর্ডার করা যায়। আর পেমেন্টও করা যায় কার্ডের মাধ্যমে খুব সহজেই।
অ্যামাজনের সিগনেচার পণ্য হিসেবে সব থেকে এগিয়ে থাকবে অ্যালেক্সা। এটি একটি ভার্চুয়াল অ্যাসিসট্যান্ট টেকনোলজি। অ্যামাজন এটি বাজারে আনে ২০১৩ সালে। এটি কথোপকথনে সক্ষম, মিউজিক প্লে-ব্যাক, টু-ডু লিস্ট তৈরি, অ্যালার্ম দেয়া, খবর, আবহাওয়া, খেলাধুলা, অডিওবুক শোনানো, পডকাস্ট স্ট্রিমিংসহ নানা কাজ করে থাকে। এটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অন্যান্য স্মার্ট ডিভাইসও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সর্বপ্রথম অ্যালেক্সা বাজারে আসে সফটওয়্যার হিসেবে। পরবর্তীতে অ্যালেক্সা ইকো ডট বাজারে আসে হার্ডওয়্যার হিসেবে।
অ্যামাজন যেসব পরীক্ষামূলক পণ্য বাজারে নিয়ে এসেছে মোটামুটি সবগুলোই সফলতার মুখ দেখেছে। বই পড়ার অভ্যাস বর্তমান সময়ে অনেকটাই কমে গিয়েছে। মানুষ যন্ত্রনির্ভর হয়ে গেছে। সেই বিষয়টা মাথায় রেখেই কাজ করেছে অ্যামাজন। যন্ত্রের মাধ্যমেই বই পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছে মানুষের কাছে। এখন পর্যন্ত কিন্ডেল তাদের জনপ্রিয় পণ্যগুলোর একটি।
আবার বর্তমান পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে স্মার্ট জীবন যাপনের নিমিত্তে কায়িক শ্রমের পরিবর্তে শুধুমাত্র ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে যন্ত্রকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার ধারণা থেকে তৈরি করেছে অ্যালেক্সা। ই-কমার্স সাইট, নতুনন পণ্য উদ্ভাবন, ব্যবসায়িক বিস্তৃতি সকল দিক থেকেই সফল অ্যামাজন।
সবথেকে বড় ব্যাপার আজ পর্যন্ত যতগুলো উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখেছে, বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছে, তাদের সবার শুরুটা ছিল খুব সাদামাটা। কিন্তু স্বপ্নটা ছিল অদম্য। অ্যামাজন তাদের স্বপ্নের শুরুটা করেছিল বইফেরি দিয়ে। তাদের সেই স্বপ্নবাজ মানসিকতার জন্যই আজ আমরা বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে পছন্দের পণ্যটি সহজেই নিজের করে নিতে পারছি। অ্যামাজন আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে।
Feature Image: amazon.com Reference: 01. Amazon. 02. amazon-history-timeline. 03. amazon-com.