বার্গার: অল-আমেরিকান স্যান্ডউইচের ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ

630
0

ফাস্ট ফুডের কথা ভাবলে, প্রথম যেটা মাথায় আসে তা হল বার্গার। এটিকে অল-আমেরিকান স্যান্ডউইচ এমনিই বলা হয় না। কিন্তু আপনি জানেন, বার্গারকে বলা হতো এমন খাবার যা শয়তানকেও শক্তিশালী করতে পারে?সাধ্যের মাঝে সহজ এবং মজাদার এই খাবারের গল্প হবে আজ। সাথে জেনে নিবো, কীভাবে আজকের এই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এই ফাস্ট ফুড আইটেমটি।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, রুটির মাঝে মাংসের টুকরো বা কিমা দিয়ে পরিবেশন করা অনেক প্রাচীন এক পদ্ধতি। চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক জর্জ মোটজ বার্গারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন, ১ম শতাব্দীতে পাওয়া অ্যাপিসিয়াসের রোমান রান্নার বইয়ে আধুনিক বার্গারের কাছাকাছি একটি রেসিপি রয়েছে।

প্রচলিত গল্প 

প্রচলিত আছে, ১৯০০ সালে কানেক্টিকাটের নিউ হ্যাভেনের “লুইস লাঞ্চে” একজন কাস্টমার পথে যেতে যেতে খেতে পারবেন এমন কিছু চাচ্ছিলেন। মালিক লুই ল্যাসেন তাকে দুই টুকরো টোস্টের মধ্যে স্টেকের প্যাটি দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রস্তুত করে দেন। আর এভাবেই বিশ্ব হ্যামবার্গার স্যান্ডউইচ পেয়েছে।

লুইস লাঞ্চ রেস্টুরেন্ট Image source: Getty Image

অনেকে দাবি করেন, ১৮৮৫ সালে উইসকনসিনের সেমুরের একটি মেলায়, চার্লি নাগ্রিন রুটির মাঝে মিটবল দিয়ে বিক্রি করার মাধ্যমে বার্গারের প্রচলন করেন। এথেন্সে ফ্লেচার ডেভিসকে “হ্যামবার্গার স্রষ্টা” উপাধি দেওয়া হয়, ১৮৮০-এর দশকে। এরকম আরও অনেক গল্পই প্রচলিত আছে। তবে কোনোটারই সত্যতা পাওয়া যায়নি।

বার্গার এবং মঙ্গোলিয়ান

এই গল্পের শুরু সুদূর মঙ্গোল সাম্রাজ্য থেকে। মঙ্গোলরা যুদ্ধযাত্রায় কাঁচা গ্রাউন্ড মিট বা মাংসের কিমা তাদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করতো। কেননা, আগুন জ্বালিয়ে খাবার তৈরি করা সহজ ছিল না। পরবর্তীতে রাশিয়া আক্রমণ করার পর মঙ্গোলদের মাধ্যমে এই রেসিপি “স্টেক টারটারে” নামে রাশিয়াতে প্রচলিত হয়।

স্টেক টারটারে Image source: Wikipedia

হ্যামবার্গার 

হ্যামবার্গার Image source: CNN

“হ্যামবার্গার” নামের প্রচলন ঘটে ১৮০০ শতকের শেষের দিকে, জার্মানির হ্যামবার্গ বন্দরের নামানুসারে। আমেরিকায় আসা জার্মান ভাষাভাষী দেশের অভিবাসীরা তাদের সাথে বিভিন্ন খাবারের রেসিপির মধ্যে নিয়ে এসেছিল এই হ্যামবার্গ স্টেক।

আজকে আমরা যে বার্গারকে চিনি, তার শুরু  “হ্যামবার্গার স্টেক” নামে, যা ১৮৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে আমেরিকান মেনুতে যুক্ত হতে শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্টেকের সাথে রুটি এবং স্যান্ডউইচও পরিবেশন করা হত। পরবর্তীতে বানও যুক্ত হয় এর সাথে। তবে উৎপত্তি যাই হোক না কেন, বার্গার এবং বান ১৯০৪ সালে সেন্ট লুইস ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে, প্রথম জনপ্রিয়তা পায়। যা লাখ লাখ আমেরিকানকে নতুন খাবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। 

হোয়াইট ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট

আপটন সিনক্লেয়ারের সাংবাদিকতামূলক বই “দ্য জঙ্গলে” আমেরিকান “মিট প্যাকিং শিল্পের” দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ার পর, হ্যামবার্গারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। এডগার বিলি ইনগ্রাম এবং ওয়াল্টার অ্যান্ডারসনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে হ্যামবার্গার, আমেরিকান খাবারের তালিকায় বিশেষ স্থানে হয়তো থাকতে পারত না। ১৯২১ সালে ক্যানসাসে তাদের প্রথম “হোয়াইট ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট” শুরু করার মধ্য দিয়ে হ্যামবার্গারের নতুন যাত্রা শুরু হয়। 

হোয়াইট ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট Image source: RoadsideArchitecture.com

চিনামাটির বাসন এবং স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে ভিতরে এবং বাইরে আবৃত হোয়াইট ক্যাসেল; পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে হ্যামবার্গারের মাংস নিয়ে তোলা অভিযোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমনকি হ্যামবার্গারের স্বাস্থ্য উপকারিতা দেখানোর জন্য ইনগ্রাম, একটি মেডিকেল স্কুলে রিসার্চেরও ব্যবস্থা করেছিল। তার “অন-প্রিমিস মিট গ্রাইন্ডিং” সিস্টেম ভাল ফল দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য হ্যামবার্গার চেইনগুলো যেমন,ম্যাকডোনাল্ডস এবং ইন-এন-আউট বার্গার (১৯৪৮), বার্গার কিং ( ১৯৫৪) এবং ওয়েন্ডি’স (১৯৬৯)- এর জন্য অনুপ্রেরণা ছিল। 

জনপ্রিয়তার কারণ 

সাশ্রয়ী 

বার্গার সাশ্রয়ী মূল্যের এবং যে কোনও ধরনের বাজেটের সাথে মানানসই। প্রিমিয়াম উপাদান থেকে সাধারণ উপাদান পর্যন্ত, যেকোনো বার্গার আপনি সহজেই কিনতে পারবেন।

স্বাদের ভিন্নতা

পিজ্জার মতোই, বার্গারের ফিলিংস এবং প্যাটিতে ভিন্নতা আছে। সময়ের সাথে এই বৈচিত্র্যতা বাড়ানোরও চেষ্টা চলছে। বেকন, মাশরুম, মাংস, স্টেকস, মাছ, পেঁয়াজ, আনারস এবং প্রচুর অন্যান্য আইটেম রয়েছে এই ভিন্নতা আনার জন্য। 

ফ্রি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং কোল্ড ড্রিঙ্কস 

ফাস্ট ফুড চেইন এবং বার্গার জয়েন্টগুলোতে, মেনুতে বার্গার ফ্রাই এবং কোল্ড ড্রিঙ্কসের সাথেই আসে। ফলে সাশ্রয়ী মূল্যে একটি সম্পূর্ণ মিল পাওয়া যায়।

ব্যস্ত জীবনের সহজ খাবার

কম সময়ে তাৎক্ষণিক সুস্বাদু খাবার হিসাবে বার্গার থাকবে সবার আগে। ড্রাইভ-থ্রো সুবিধার জন্য যাত্রা পথে বার্গার হতে পারে পারফেক্ট সঙ্গি। 

বার্গারের ভবিষ্যৎ 

পরিবেশ এবং প্রাণির সুরক্ষার জন্য বার্গারের প্যাটি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। যেমন, “মোমোফুকু নিশি” থেকে “হোয়াইট ক্যাসেলে;” প্যাটি মূলত গম এবং আলুর প্রোটিন এবং নারকেল তেল দিয়ে তৈরি, তবে এতে “হেম” বা সয়া থেকে তৈরি একটি অণু রয়েছে। 

উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন কৃত্রিম মাংস Image source: Green Queen

আছে প্ল্যান্ট বেসড মিট বা উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন কৃত্রিম মাংসের কিমা। “বিয়ন্ড মিট” নামের প্রতিষ্ঠান বিট এবং মটর থেকে কৃত্রিম মাংসের কিমা উৎপন্ন করছে। সয়া, আলু, গম, মাশরুম ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমেও বার্গারের সুস্বাদু প্যাটি তৈরি হচ্ছে। ল্যাবে প্রাণির স্টেম সেল থেকে “ক্লিন মিট” তৈরি হচ্ছে যদিও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এর বিক্রয়ের দিক থেকে।

যদিও মাংসের তৈরি প্যাটিই জনপ্রিয় বেশি। তবে, ভেজিটেরিয়ান বা ভেগানদের জন্য, পরিবেশ রক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের ক্ষেত্রে; ভবিষ্যৎ বার্গারের পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক। পরিবর্তন শুরু হয়েও গিয়েছে বলা যায়। তবে, প্রতিনিয়ত সবাই যেমন এর স্বাদের বৃদ্ধি আর বৈচিত্র্যতায় পরিশ্রম করে যাচ্ছে; নতুন সময়ের বার্গার নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়।   

বার্গার ছোট, বড়ো সবার কাছেই একটি প্রিয় খাবার। সেরা ফাস্ট ফুড আইটেম হিসেবে এটি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বার্গারে যে ধরনের ফিলিংই যোগ করা হোক না কেন, সবসময়ই তা সুস্বাদু হয়। সম্ভবত এই কারণেই সবাই এটি পছন্দ করে এবং এটি একটি প্রিয় ফাস্ট ফুড আইটেম হিসাবে পরিচিত। সুদূর মঙ্গোল থেকে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া এই খাবার, তার সাশ্রয়ী মূল্য, সহজলভ্যতা, স্বাদের ভিন্নতা আর নিত্য-নতুন স্বাদের জন্য সময়ের সাথে পুরো পৃথিবীতেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। 

Feature Image: lean and green

References:

  1. Hamburger-origin-story 
  2. History/hamburgerhistory 
  3. Hamburger-helpers-the-history-of-America’s-favorite-sandwich 
  4. Why-are-burgers-the-most-popular-fast-food-item?
  5. The-future-of-burgers