বর্তমান বিশ্বে মুসলিম বিজ্ঞানীদের শক্ত অবস্থান না থাকলেও আধুনিক বিজ্ঞানের শুরু মুসলিম মনীষীদের হাত ধরেই। মূলত জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করেন তারা আর তাদের আবিস্কারের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের উন্নত বিশ্ব। গণিতের প্রাণভোমরা অ্যালজেব্রা থেকে আধুনিক রসায়নবিজ্ঞান চর্চা, চোখ থেকে আলো নির্গমন না বস্তু থেকে চোখের আলো গ্রহণ, চিকিৎসা দেয়ার জন্য হাসপাতাল, পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-প্রতিটি তত্ত্বেরই ভিত্তি রচিত হয়েছে মুসলিম বিদ্বানদের হাত ধরেই।
প্রসঙ্গত, পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক পৃথিবী, সৃষ্টি, দিন-রাতের পরিবর্তন প্রভৃতি বিষয়ে মুমিন বান্দাদের চিন্তা করতে বলেন। কোরআনের অনুপ্রেরণা থেকেই মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চার শুরু হয় এবং অষ্টম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক অবধি ইসলামি স্বর্ণযুগে মুসলিমদের একের পর এক আবিষ্কার যেন নতুন যুগের সূচনা করে। মুসলিম মনীষীদের হাত ধরে আজকের যুগের আবিষ্কারগুলো নিয়েই আজকের আলোচনা।
আজকের দুনিয়ায় এটাকে কল্পনা মনে হলেও সত্য এই যে, মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোই আজকের উন্নত বিশ্বের ভিত্তি। চলুন জেনে নেয়া যাক মুসলিম মনীষীদের অসামান্য আবিষ্কারগুলো যা পথ দেখিয়েছে বিজ্ঞানীদের।
অ্যালজেব্রা
গণিতের ভিত্তি অ্যালজেব্রা তথা বীজগণিত মূলত ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম আবিষ্কার। বিখ্যাত গণিতবিদ মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমির গাণিতিক কিতাব ‘আল মুখতাসার ফি হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’ গ্রন্থে বীজগণিতের প্রাথমিক সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ করেন। মূলত তিনি ইসলামি শরিয়াহর উপর ভিত্তি করে উত্তরাধিকারদের সম্পত্তি বণ্টন ও যাকাত আদায়ের হিসাবকে সহজ সমীকরণে আনার চেষ্টা করেন।
পরবর্তীতে ব্রিটিশদের দ্বারা বইটি অনুবাদিত হলে তিনি অ্যালগোরিদমি নামে পরিচিত হোন এবং তারই নামের অপ্রভংশ হতে গণিতের ‘অ্যালগরিদম’ নামের স্বতন্ত্র শাখার জন্ম হয়। এরপর তাঁর সূত্রগুলো থেকে বিস্তৃতি ঘটিয়ে আবিষ্কার করা হয় গণিতের মূল কাঠামো বীজগণিতের অন্যান্য সূত্রসমূহ। বর্তমান শতাব্দীর সুউচ্চ দালানকোঠা, নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণের কৃতিত্বও অনেকাংশে বহন করে বীজগণিতের সমীকরণগুলো।
চিকিৎসাশাস্ত্র
চিকিৎসাক্ষেত্রে মুসলিম মনীষীদের অবস্থানও যথেষ্ট শক্ত। শল্যচিকিৎসার যেকোনো অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত সূক্ষ্ম কাঁচি, অস্থি কাটার ছুরিসহ প্রায় দুই শতাধিক সরঞ্জাম আবিষ্কার করেন শল্যবিদ আল জাওয়াহিরি; যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানেও ব্যবহৃত হচ্ছে। দেহ সেলাইয়ে ব্যবহৃত সুতা যা প্রাকৃতিকভাবেই অদৃশ্য হয়ে যায়, আবিষ্কারের কৃতিত্বও একমাত্র তাঁরই। তাঁর রচিত ১৫০০ পৃষ্ঠার এনসাইক্লোপিডিয়াটি বহু সময় ধরে ইউরোপের মেডিকেল কলেজগুলোতে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়া, রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি উইলিয়াম হার্ভে দ্বারা আবিষ্কৃত জানানো হলেও এর তিনশ বছর আগেই এক মুসলিম মেডিকেল ছাত্র ইবনে নাফিস রক্তসঞ্চালন পদ্ধতি বর্ণনা করেন। শুধু তাই-ই নয়, অ্যালকোহল ও আফিমের মিশ্রণে চেতনানাশক তৈরি, চোখে ছানি অপারেশনের জন্য নীডলের উন্নতি প্রভৃতিও মুসলিমদের দ্বারাই আবিস্কৃত হয়।
আধুনিক রসায়ন
রসায়ন শাস্ত্রের জনক হিসেবে যার নাম অবিস্মরণীয়, জাবির ইবনে হাইয়াম। বিভিন্ন মৌলিক প্রক্রিয়া ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে আলকেমিকে রসায়নশাস্ত্রে পূর্ণতা দান করেন তিনি। ডিস্টিলেশন, ফিলট্রেশন, বাষ্পীভবন, ঘনীভবন, স্ফটিকিকরণ প্রভৃতি বিভিন্ন পদ্ধতির জনক তিনি।
ব্যবহারিক ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছেন। উনার আবিষ্কারের উপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান আধুনিক রসায়নবিদ্যা।
ফ্লায়িং মেশিন বা প্যারাসুট
অরভিল রাইট ও উইলভার রাইটের মাধ্যমে প্রথম উড়োজাহাজ আবিষ্কৃত হলেও এরও হাজার বছর আগে উড়ার প্রচেষ্টা চালান স্পেনের বিখ্যাত কবি, জ্যোতির্বিদ, প্রকৌশলী আব্বাস ইবনে ফিরনাস। ৮৫২ সালে পুরোনো কাপড়ে কাঠের পাত লাগিয়ে মিনার থেকে লাফ দেন। যদিও গতি কমে যাওয়ায় তিনি বড় আঘাত থেকে বেঁচে যান।
মূলত উড়ার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলেও তাঁর সেই বাহনটিই ইতিহাসের প্রথম প্যারাসুট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীতে সিল্কের কাপড়ের সাথে ঈগল পাখির পালক লাগিয়ে উড়ার চেষ্টা করেন এবং দশ মিনিট ভেসেও থাকেন। কিন্তু নামতে ব্যর্থ হওয়ায় পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় এই গুণীর।
বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যবহারিক যেকোনো শিক্ষার পূর্ণ বিকাশ ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনতে অবাক লাগতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয় মুসলিমদের হাতেই। মুসলিম রাজকুমারী ফাতিমা আল ফিহরি ও তার বোন মরিয়ম খুব অল্প বয়সেই উত্তরাধিকার লাভ করেন। মরোক্কোর জনসাধারণের উন্নয়ন সাধনে তারা বিভিন্ন মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, তখন মসজিদগুলোতেও ধর্মের পাশাপাশি দর্শন, আইন, ফিকহ প্রভৃতির চর্চা হতো।
পরবর্তীতে মসজিদ কমপ্লেক্সের একটি অংশে আরবি, কুরআন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান শুরু হয় যা ‘আল কারাউইন’ নামে পরিচিত হয়। টিউশনি ফি নেয়ার বদলে শিক্ষার্থীদের বাসস্থান ভাতা ও বিনামূল্যে খাদ্যও দেয়া হতো। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত রচিত হয়। ইসলামি স্বর্ণযুগে প্রতিষ্ঠিত অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় মিশরের কায়রোতে অবস্থিত আল আযহার যা এখনো চলছে সগৌরবে।
হাসপাতাল
শল্যচিকিৎসার জন্য প্রথম নির্মিত হাসপাতালের পেছনেও রয়েছেন মুসলিম মনীষীরা। খলিফা হারুন অর রশীদের মাধ্যমে ৮০৫ সালে প্রথম স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ধারণা প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে মিশরে আহমদ ইবনে তুলুন ৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেডিকেল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর এই প্রতিষ্ঠান থেকেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ধারণাটি প্রসারিত হয়। এভাবেই মেডিকেল সেন্টারগুলোর মাধ্যমে সরাসরি রোগীদের সেবা দেয়ার দ্বার উন্মোচন হয়।
ক্যামেরা
যেকোনো মুহূর্তকে ধরে রাখার জন্য ক্যামেরাকে স্মরণ করবে সবাইই। কিন্তু জানা আছে কি, এই ক্যামেরা আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছে কোনো মুসলিম মনীষীর তত্ত্ব। জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী ইবন আল হাইথামের আলোকতত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই আবিষ্কৃত হয় পিনহোল ক্যামেরা। ফাতেমীয় শাসক আল হাকিম তাঁকে গৃহবন্দী করলে তিনি আলো নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি দেখান অ্যাপারচার যত ছোট হবে চিত্রের গুণমান ততো তীক্ষ্ণ হবে।
তাঁর গবেষণাটি ‘কিতাব আল মানাযির’ যা ইংরেজিতে The Book of Optics নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর গবেষণার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে ক্যামেরা উদ্ভাবিত হয়। এছাড়াও ইবনে হাইথাম বস্তু থেকে চোখে আলোর প্রবেশও প্রমাণ করেন এবং টলেমির তত্ত্বের ভুল প্রমাণ করেন।
কফি
পানীয় হিসেবে কফির অনেকেরই প্রধান অনুষঙ্গ। কফির আবিষ্কারও এক মুসলিম বালকের হাত ধরে। খালিদ নামের দক্ষিণ ইথিওপিয়ান নিজের ছাগলদের এক ধরণের বেরি খেতে লক্ষ্য করে এবং তা নিজে সংগ্রহ করে সেদ্ধ করে পান করে। এটিই কফির সূচনা পর্ব।
পরবর্তীতে ইয়েমেনের সুফি সাধকগণ রাত জেগে ইবাদত করার জন্য এই পানীয় পান শুরু করেন। এরপর অটোমানদের মাধ্যমে আস্তে আস্তে তা তুর্কি এবং পরে সপ্তদশ শতকে ইতালির হাত ধরে পশ্চিমা বিশ্বে প্রসার লাভ করে। আরবি শব্দ ‘কাহওয়া’ থেকে তুর্কি ‘কাহভে’, পরবর্তীতে ইতালীয় ‘ক্যাফে’ এবং সর্বশেষ ইংরেজি শব্দ ‘কফি’র মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠে পানীয়টি।
টুথব্রাশ
প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই যা ব্যবহার করা হয় তা টুথব্রাশ। আর টুথব্রাশের ধারণাও আসে মুসলিমদের মাধ্যমেই। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) স্বয়ং মেসওয়াক তথা গাছের ডাল দ্বারা দাঁত পরিষ্কারের বিষয়টি সামনে আনেন এবং একে মুসলিমদের জন্য আমল তথা পুণ্যের কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
উপরোক্ত জিনিসগুলোই শেষ নয়। বর্তমান বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত ওয়াইন্ড মিল তথা বায়ুকলের ধারণাও আসে মুসলিম মনীষীদের মাধ্যমে। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অন্যতম ক্রাংকশাফট উদ্ভাবন করেন আল জাহারি।
মূলত পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণ ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম সমাজ বর্তমানে খানিকটা আড়ালে থাকলেও আধুনিক বিশ্বের ভিত্তি রচিত হয়েছে তাদেরই পূর্বজনদের হাত ধরে। বর্তমানের দিকে তাকালে হয়তো তা কল্পনা করা যাবে না। কিন্তু ইসলামি শাসনামলে মুসলিম মনীষীরা যেভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি বাড়িয়েছেন, তৎকালীন পশ্চিমা সমাজও তাদের অনুসরণে এগুতে বাধ্য হয়েছেন। আজকের উন্নত বিশ্ব অবশ্যই তাদের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।
Feature Image: islamic-study.org References: 01. Muslim inventions that shaped the modern world. 02. TOP 10 MUSLIM INVENTIONS IN HISTORY. 03. Five Muslim inventions that shaped our world.