উজ্জা, লাত ও মানাত-প্রাচীন আরবের প্রধান তিন দেবী

3065
6

গ্রীক মিথলজিতে জিউসের পরে সবচেয়ে চর্চিত দেবী আফ্রোদিতি। যার ভালোবাসার জালে ধরা দিয়েছিল দেবতা থেকে শুরু করে মরণশীল মানুষ। ভালোবাসার এই দেবী তার মোহনীয় আবেশে বিমোহিত করেছে তাবৎ দুনিয়াকে। আসলেই কি আফ্রোদিতি জগতকে মুগ্ধ করেছে প্রেমের এই বৈতরণীর? আসলে বিমোহিত করেছে হোমার, হেসিয়ড থেকে শুরু করে নানান কবিরা। যারা তাকে নিয়ে মিথে ভরা উপাখ্যান সাজিয়েছে।

যেমন হেসিয়ড তার থিউগোনীতে আফ্রোদিতির জন্ম নিয়ে চমৎকার আর বহুল প্রচলিত মিথটি উপস্থাপন করেন। থিউগোনীতে উল্লেখা করা হয় সৃষ্টির প্রথম দিকে গায়ার প্ররোচনায় যখন ক্রোনাস শক্ত কাস্তে দিয়ে ইউরেনাসকে নপুংসক করেন। তখন ইউরেনাসের অণ্ডকোষসহ জননাঙ্গটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। সিথেরার অদূরে যেখানে ফেলা হয় জননাঙ্গটি, সেই স্থান থেকে উত্থিত হয়েছিল দেবী আফ্রোদিতি। এই জন্য আফ্রোদিতিকে বলা হয় ‘ফেনা থেকে উদ্ভূত’। জন্মের পরে ঝিনুকে করে আফ্রোদিতিকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাইপ্রাসে। হেসিয়ডের এই মিথ অনুসারে আফ্রিদিতি হচ্ছে সবচেয়ে পুরোনো দেবী বা অলিম্পিয়ান। 

আবার, সিরিয়ান মিথ অনুসারে আফ্রোদিতির জন্ম ডিম থেকে। ডিমটি ছিল ইউফ্রেটিস নদীতে। মাছ সেটিকে তীরে নিয়ে আসে এবং পেঁচা সেই ডিমের ওপর বসে গরম করলে সেখান থেকে আফ্রোদিতির জন্ম। মিথের এই দেবী দেশভেদে তার রূপ আর নামের ভিন্নতা নিয়ে হাজির হয়েছে ভিন্ন ভিন্নভাবে। যেমন রোমে ভেনাস অথবা প্রাচীন আরবে আল উজ্জা। প্রাচীন আরবে উজ্জার সাথে ছিল আরো দু’জন দেবী ছিলেন। লাত ও মানত। আর এই তিনজন ছিল প্রাচীন আরবের প্রধান তিন দেবী! 

শিল্পী বোট্টিচেলির চোখে আফ্রোদিতি; Image source: commons.Wikimedia

এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের সূরা নাজ্বলে বর্ণনা করা হয়েছে, 

তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উজ্জা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরও একটি মানাহ সম্পর্কে। তোমরা কি মনে কর পুত্রসন্তান তোমাদের জন্য এবং কন্যাসন্তান আল্লাহর জন্য। এরুপ বন্টন তো অসঙ্গত বন্টন। এগুলো তো কেবল নামমাত্র যা তোমাদের পূর্বপুরুষদের ও তোমরা রেখেছো। এবং এর সমর্থনে আল্লাহ কোনো দলিল কোনো দলিল প্রেরণ করেননি। (আয়াত-৬২, রুকু-৩, কোরআন-৫৩ঃ ১৯-২১)

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মের চারশো বছর পূর্বের কথা। তখনকার দিনে মক্কাকে বলা হত বেক্কা। সেই সময়ে হেজাজের সম্রাট কোহতান বংশের সাবা নামক এক ব্যক্তি কাবার ছাদে হোবাল নামে পুতুল বা মূর্তি স্থাপন করেন। মোট স্থাপিত চারটি মূর্তির মধ্যে হোবাল ছাড়াও বাকি তিনটি ছিল- লাত, মানাত ও উজ্জা। তৎকালীন সময়ে কাবাঘরে মোট ৩৬০টি মূর্তি ছিল। প্রতিটি গোত্রে ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবী ছিল।

যেমন- তাইয়াফের বনি সাফিক গোত্র লাত, বনি কানানো গোত্র উজ্জা আর আস এবং খাজরাজ গোত্র মানাত দেবীর পূজো করতো। আর মক্কা ও ইয়াসরেবের মধ্যবর্তী কুদাইল নামক স্থানে মানাত দেবী ছিল। নাসলা নামক স্থানে উজ্জা এবং তায়িফে লাত প্রতিমা। শুধু মক্কা শহরেই যে তাদের দেবদেবী ও পুতুল সংরক্ষিত থাকতো তা নয়, যারা মক্কা আসতে অসমর্থ হতেন, তারা নিজ নিজ স্থানীয় শহরে মক্কার প্রতিনিধিস্বরুপ মূর্তি রাখতেন এবং সেগুলোর পুজো-অর্চনা করতেন। 

আফ্রোদিতির মিথের কবিদের মতো এখানে মানে আরবে আপন খেয়াল-খুশিমতো দেবদেবীদের চেহারা বা আকৃতি নির্ধারণ করা হতো। যেমন-ওয়াদ ছিল পুরুষাকৃতির, নাইলা নারীকৃতির, নসর শকুন আর যাগুস সিংহ আকৃতির। এই সমস্ত দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করা হতো নানান জীবজন্তু। সেই রক্তমাংস তাদের সামনে রেখে পূজো করা এমনকি মাঝে মাঝে মানুষও বলি দেওয়া হতো। 

ছবিতে প্রাচীন আরবের প্রধান তিন মূর্তি। মাঝে আল-লাত, ডানে আল-উজ্জা ও বামে মানাত; image source: commons.wikimedia

শুধুমাত্র কাবাই যে দেবদেবীর একমাত্র স্থান ছিল একথা বলা যায় না। কেননা, আরো কয়েকটি খুদে কাবাও তখন দেখা যেতো। যেমন- গাতফান গোত্রের ছিল লাইস, অনুরূপভাবে বনু হাসামের হলো খাসলা। এর অবস্থান ছিল ওহোদ পাহাড়ের কাছে, রাবেয়া গোত্রের ছিল যুল কাবাত।  

আরবের ধর্মরূপ ব্যাখা দিতে গিয়ে একটি কথা না বললে বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তারা যে শুধু দেবদেবীর পূজো করতো তাই নয়। চাঁদ, তারা, নক্ষত্র, সূর্যের পূজোও করতো তারা। প্রকৃতি জগতের প্রতি সাধারণ মানুষের চিরকাল এক মোহ থাকে। এই মোহ থেকেই ধর্মের সূচারু প্রভাব উঠে আসে দেব-দেবীর মাঝে। 

হযরত নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত ইব্রাহিম মূর্তিপূজা আর অগ্নি উপাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে চরম নিপীড়নের স্বীকার হয়। পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে হযরত ইব্রাহিমের মুখ থেকেও অনুরূপ কথা শুনা যায়,  

স্মরণ করো, ইব্রাহিম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক, এই নগরকে নিরাপদ করো এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে প্রতিমা পূজা থেকে দূরে রাখো। হে আমার প্রতিপালক, এসব প্রতিমা বহু মানুষ্কে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে-ই আমার দলভুক্ত। কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
(কোরআন-১৪ঃ৩৫-৩৬)

ছবিতে প্রাচীন আরবের প্রধান তিন মূর্তি। মাঝে আল-লাত, ডানে আল-উজ্জা ও বামে মানাত; image source: commons.wikimedia

সুতরাং মূর্তিপূজা যে প্রাচীন সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে একটি কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মানুষের মন আপাত  মনোহর ভ্রান্ত কোনো কিছুকে প্রত্যক্ষভাবে পেতে চায়, সেজন্যেই কিছু না কিছুতে আকড়ে রাখে। ঠিক এভাবে মক্কার কুরাইশরা তাদের প্রধান দেবী হিজায উজ্জা, লাত আর মান্নাতকেও আঁকড়ে রাখার জন্য নবী করিম (সাঃ) এর উপর নানামুখী নিপীড়ন শুরু করে। 

হিজায উজ্জা, লাত ও মানাতকে আল্লাহর কন্যা বলে মনে করতো কুরাইশরা। কুরাইশরা উজ্জাকে সর্বাপেক্ষা বেশি শ্রদ্ধা করতো। প্রাচীন আরবের প্রধান তিন দেবীর একজন এই আল-উজ্জা। উজ্জা ছিল শক্তি, সুরক্ষা ও ভালোবাসার দেবী। তাকে গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি এবং রোমান দেবী ভেনাসের সাথে তুলনা করা হয়। 

এই দেবীর প্রতীক ছিল তিনটি গাছ একাশিয়া বা আকাশমণি গাছ। পেট্রা ছিল তার প্রধান উপাসনালয়। মক্কা অঞ্চলেও তার উপাসনা হলেও মন্দির ছিল মক্কার পূর্বে তাইফের নাখলা নামক স্থানে। কুরাইশরা নিজেদের সমৃদ্ধি ও কল্যাণের আশায় তার পূজা করতো। উজ্জাকে আরবে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে গণনা করা হতো, এছাড়া তার নামে শপথবাক্য পাঠ করা হতো। 

দেবী লাতের মূর্তি; Image source: commons.Wikimedia

মুজাহিদ বলেছেন, উজ্জা ছিল গাতফান গোত্রের আবাসভূমিতে অবস্থিত একটি বৃক্ষের নাম। সমস্ত গাতফানিরা ঐ বৃক্ষের পূজা করতো। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণিত, নাখলার একটি কুঠুরির নাম ছিল উজ্জা। কুঠুরিটি রক্ষণাবেক্ষণ করার ভার ছিল বনি শায়বান গোত্রের লোকেদের উপর। আর বনি শায়বান ছিল কুরাইশদের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ। কুরাইশ ও বনি কেনানাদের এটাই ছিল সর্ববৃহৎ মূর্তি। আমর ইবনে লুহাই, বনি কেনানা ও কুরাইশদের বলেছিল,

তোমাদের প্রভু শীতকালে তায়েফে এসে লাতের সঙ্গে এবং
গ্রীষ্মকালে উজ্জার সঙ্গে কালযাপন করে।

মানাত ছিল ভাগ্যের দেবী। তার মন্দির স্থাপিত হয়েছিল মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী রাস্তার উপরে কুবেদ নামক স্থানে। এই মন্দিরে একটি কৃষ্ণপ্রস্তর রক্ষিত ছিল। মদিনায় আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকজন এই দেবীকে বেশি সম্মান দেখাতো। মক্কার প্রধান তিন দেবীর মধ্যে মানাত ছিল সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য, সময় ও মৃত্যুর দেবী। প্রধান তিন দেবীর মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। তাকে গ্রিক দেবী আনাঙ্কের সাথে তুলনা করা হয়। মানাতের আরবি অর্থ অনুসারে একে ভাগ্যের দেবী বলা হয়।

আরবের মানুষ তাদের উপাধি হিসেবেও মানাত ব্যবহার করতো। এই দেবীর প্রাচীন মূর্তি ছিল কাঠের উপর আঁকা। তবে উল্লেখযোগ্য মূর্তির অবস্থান ছিল আল মুসাল্লালে। তীর্থযাত্রীরা এখানে এসে নিজেদের মাথা মুণ্ডন করতো এবং তার মূর্তির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো। তারা মনে করতো, এই দেবীকে দর্শন না করলে তাদের তীর্থযাত্রা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। 

লাত অধিষ্ঠিত হয়েছিল তায়িফের কাছাকাছি পালমিরা নামক স্থানে। ইসলাম-পূর্ব যুগে মক্কাসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপে এই দেবীর উপাসনা করা হতো। তাকে যুদ্ধ, শান্তি ও সমৃদ্ধির দেবী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সিংহ, গেজেল, অর্ধচন্দ্র এবং ঘনকাকৃতির পাথর হলো তার প্রতীক। এছাড়া সিংহ, গেজেল বা হরিণ এবং উট তার পবিত্র পশু হিসেবে বিবেচিত।

এক হাতে খেজুর পাতাসহ সিংহের সাথে আল-লাতের প্রতিমূর্তি দেখা যায়। আরবের সংস্কৃতিতে বর্ষগণনা মূলত চন্দ্রকেন্দ্রিক। আল-লাতের প্রতীক ছিল চাঁদ। তাকে তিন দেবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ধরা হতো। তার প্রধান উপাসনা কেন্দ্র ছিল তায়েফের পালমিরাতে। সেখানে দেবী ‘লেডি অব দ্য টেম্পল’ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাকে গ্রিক দেবী এথেনা এবং রোমান দেবী মিনার্ভার সাথে তুলনা করা হতো। আল-লাত ছিল মেসোপটেমীয়দের পাতালের দেবী, যিনি এরেশকিগাল নামে পরিচিত। কার্থেজে তাকে আল্লাতু নামে ডাকা হতো। মূলত উত্তর আরবে এই দেবীর উপাসনা বেশি হতো। তবে মক্কার হেজাজ অঞ্চলেও তার উপাসনা হতো। পালমিরাতে স্থাপিত হওয়াই মানাতের চর্চা সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। 

প্রাচীন আরবের প্রধান দেবীদের মধ্যে প্রাচীনতম দেবী; Image source: commons.Wikimedia

মক্কা ও অন্যান্য অঞ্চলের লোকজন সেখানে গিয়ে তার পূজা করতো। এই দেবী- বিগ্রহগুলোর অস্তিত্ব থেকে বুঝতে পারা যায, আরবের সমাজ প্রাচীনকালে মাতৃপ্রধান ছিল। তথাপি, সবচেয়ে নারীর বঞ্ছনার ইতিহাস সেই সময়গুলোতে সবচেয় বেশি দেখা যায়।

সমাজে নারীর তেমন অধিকার ছিল না। কারো পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে সে নবজাতককে জ্যান্ত পুতে ফেলা হতো। সমাজে নারীর কোনো নিরাপত্তা ছিল না। কন্যা সন্তান হওয়াকে ঘৃণা ভরে দেখা হতো। 

সেই সময়ে মক্কার কাবাগৃহ অনেক দেবীর মূর্তি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। মক্কার অধিবাসীরা মনে করতো সকল দেব-দেবীর উপরে আল্লাহর স্থান। এই আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও ত্রাণকর্তা। আরবগণের পরলোক সম্বন্ধে বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। তারা ছিল ঐতিহ্যের প্রতি আসক্ত ও জীবনসর্বস্ব। 

সমসাময়িককালের ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থা আরবের আধ্যত্মিক দাবি মেটাতে পারছিল না। রাজনৈতিক কাঠামোও ভেঙ্গে পড়ছিল। জনৈক পণ্ডিত যথার্থই বলেছেন,

একজন মহান জাতীয় ও ধর্মীয় নেতার আবির্ভাবের জন্য এ সময় যেন মঞ্চ প্রস্তত হয়েছিল এবং আরবরাও এ উদ্দেশ্যে মানসিক প্রস্ততি গ্রহন করেছিল।

কাবা বিজয়ের পথে ৬৩০ অব্দে যখন আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল মুগিরাহ ইবনে-শুবাহকে পাঠান, তিনি প্রথমে আল লাতের মূর্তি ধ্বংস করেন এবং তার মন্দির মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। 

প্রাচীন আরব এবং মূর্তিপূজা; Image source: commons.Wikimedia

হিজায উজ্জার মূর্তি ইসলাম গ্রহণের পর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) ধ্বংস করেন। খালিদ প্রায় ত্রিশজন যোদ্ধা নিয়ে মন্দির ধ্বংস করার জন্য রওনা হয়। পথে দেখা যায়, আল-উজ্জার দুটি মূর্তি একটি আসল এবং অন্যটি নকল। খালিদ প্রথমে নকলটি আসল ভেবে ধ্বংস করে দেয়। তারপর নবী করিম (সঃ) কাছে ফিরে এসে যখন জানায় নবীজি প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি অস্বাভাবিক কিছু দেখেছো?’ প্রত্তুত্তরে খালিদ ‘না’ জবাব দেয়। তখন নবীজি আবার বলেন, ‘তাহলে তুমি আল-উজ্জার আসল মূর্তি ধ্বংস করোনি।’  

খালিদ আবার ছুটে যায়। এবার আসল মন্দির খুঁজে পায়। মন্দিরে প্রবেশ করে মন্দিরের সেবককেও দেখতে পায় তিনি। ধারালো অস্ত্র নিজ গলায় ধরে উজ্জার আবির্ভাবের জন্য সে তখন চিৎকার করছিল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে খালিদ এগিয়ে এসে তাকে হত্যা করে।

এরপর তিনি উজ্জার চারপাশের গাছগুলো কেটে ফেলেন। মূর্তি ধরতে গেলে দেখেন নগ্ন হয়ে আরেক সেবিকা মূর্তির সামনে খালিদকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। তিনি ঐ মন্দিরের শেষ রক্ষাকর্তাকেও মেরে ফেলেন। এরপরে, উজ্জার মূর্তি ধ্বংস করেন। 

ওই একই সময়ে খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ সাদ বিন জায়েদ আল-আশহালিকে সঙ্গী করে ২০ জন নিয়ে যায় আল-মাশাল্লালে মানাতের মূর্তি ধ্বংস করার জন্য। এই দলটি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মানাতেরই পূজারি ছিল। কিতাবুল আসনাম অনুসারে, মানাতের মূর্তি ধ্বংস করার সময় একজন কৃষ্ণ বর্ণের মহিলা নগ্ন বুকে আর্তনাদ করছিল। সা’দ বিন জায়েদ অবিলম্বে তাকে হত্যা করে এবং মূর্তিটি ধ্বংস করেন। 

প্রাচীন আরব ধারার সঙ্গে ভারতীয় ধারার একটি দিক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতীয় হিন্দুসমাজের অনেকে বলেন, তাঁরা দেব-দেবীর আরাধনা করেন তাদের ভগবান মনে করে নয়। ভগবান একজনই। এই দেব-দেবীর মধ্যে দিয়ে তারা ভগবানের সান্নিধ্যের প্রার্থনা করেন। প্রাচীন আরবরাও একই কথা বলতো, এরা আমাদের আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে।  

পবিত্র কোরআনুল কারিমে উল্লেখ করা রয়েছে, 

নিশ্চয় আমি সন্নিকটবর্তী, যখন প্রার্থী প্রার্থনা করে তখন তার প্রার্থনার সাড়া দেয়। অতএব আমার আহবানে উত্তর দান করা, আমাকে বিশ্বাস করাই তাদের উচিত। যাতে তারা সুপথ পাবে।
(কোরআন-২ঃ ১৮৬)

 

Feature Image: Wikimedia Commons
References:

01. Book of Idols by Hisham ibn al-Kalbi. 
02. Tafsir Ibn Kathir (53:19). 
03. Berkey, Jonathan Porter (2003), The Formation of Islam: Religion and Society in the Near East, 600-1800, Cambridge University Press. 
04. Bosworth, C. E.; Donzel, E. van; Lewis, B.; Pellat, Ch., eds. (1986), Encyclopaedia of Islam, vol. 5 
05. Frank, Richard M. (2006), Arabic Theology, Arabic Philosophy: From the Many to the One: Essays in Celebration of Richard M. Frank, Peeters publications. 
06.সহজ কুরআনঃ  আসিফ সিবগাত ভূইয়া (১ম খন্ড) 
07. আরব জাতির ইতিহাসঃ মুহাম্মদ রেজা-ই- করীম 
08. মহানবীঃ ড. ওসমান গনী 
09. গ্রীক মিথোলজিঃ আদি থেকে অন্ত- এস এম নিয়াজ মাওলা 
10. ইসলামের বিস্ময়কর কাহিনীঃ মাওলানা মোহাম্মদ আবুল খায়ের সিদ্দিকী। 

6 COMMENTS

  1. লাবণ্য ম্যাডামের প্রতিটি লেখা থেকে অনেক কিছু জানতে পারি। বেশ গুছিয়ে সরল ভাষা তে লেখেন।

  2. অনেক সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছে প্রতিটি ধাপ। এভাবেই আসলে আমাদের মত যারা জানতে আগ্রহী তাদের মনের ক্ষুধা মিঠানোর প্রয়াস নেওয়ায় লাবণ্যকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

  3. উজ্জা, লাত আর মানাত সম্পর্কে আগে থেকে জানতাম। কিন্তু মিথোলজির সাথে লিংক আপ করে শুরু থেকে আরবের সামগ্রিক অবস্থার মাধ্যমে এই লেখাটা একদমই ভিন্ন ভাবে সামনে এলো। আমার মনে হয়েছে একদম নতুন ভাবে পড়লাম এই তিনদেবীকে নিয়ে। ভাবনা চিন্তার দারুণ পরিস্ফুটন ফিচারটিতে। এই তিন দেবীকে নিয়ে যত লেখা পড়েছি এটা সেরা লেগেছে আমার কাছে।
    আমাদেরপ্যারিস টীমকে অনেক ধন্যবাদ এমন সব ফিচারের জন্য। অসাধারণ।

  4. এই পোস্ট পড়ে জানা গেল,নবীর নির্দেশে মন্দির ধ্বংস করা হতো এমনকি একজন আবিসিনিয়ান মহিলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।আর নবীর সুন্নত পালন করতে গিয়ে আজও দূর্গাপূজার সময় বাংলাদেশে মুসলমানরা মূর্তি ভাঙে।