মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম জনবহুল ও ইরানের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার শহর তেহরান। প্রাচীন গ্রাম থেকে ইরানের রাজধানী এবং ক্রমেই আরব বিশ্বে কাছে নিজেকে পরিণত করেছে অন্যতম এক প্রভাবশালী নগরীতে। পৃথিবীর ৬ষ্ঠ সর্বোচ্চ টাওয়ারকে ধারণ করা এই শহরেই হবে ইসলামি বিশ্বের প্রথম পর্যটন প্রদর্শনী।
তবে ফল ও নান্দনিক বাগানের জন্য বিখ্যাত শহরটি আজ বায়ুদূষণের কারণে বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। চলুন, জেনে নেই, ইরানের রাজধানী তেহরানের কথা।
যেভাবে তেহরান ইরানের রাজধানী
তেহরান ইরানের ৩২তম রাজধানী। প্রথমবারের মতো আঘা মোহাম্মদ খান এই শহরকে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। মূলত তৎকালীন রাশিয়া-ইরান যুদ্ধের ভূ-তাত্ত্বিক প্রভাবেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাজধানী হওয়ার আগেই অবশ্য তেহরান ইরানের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
মঙ্গোলীয় আক্রমণে দিশেহারা ‘শাহরে রে’ অঞ্চলীয় লোকজন পালিয়ে আসে নান্দনিক বাগান পূর্ণ গ্রাম তেহরানে। এই গ্রামে ক্রমেই বাড়তে থাকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্থাপনা ও দূর্গের সাফাভি রাজা শাহ তাহমাসভ সাফাভিদ রাজত্বের প্রশাসনিক কেন্দ্র নির্বাচন করেন এই শহরকে। মাত্র দশ বছরেই সিংহাসনে বসা বাদশাহর ধর্ম অনুরাগ প্রবল থাকায় নগরে তিনি ১১৪টি ভবন নির্মাণ করান যাতে পবিত্র কোরআন মাজিদের একটি করে সূরা লিপিবদ্ধ করা হয়।
জান্ড রাজবংশীয় শাসনে এটি ছোট শহর থাকলেও সামরিক গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। এরপর কাজা রাজাদের শাসনামল শুরু হলে আঘা মোহাম্মদ খান এই শহরকে ইরানের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তবে শহর হিসেবে তেহরানের মূল উন্নতির শুরু হয় রাজা ফাত আলী শাহ-এর সময় থেকে। এরপর কাজাবংশীয় রাজারাও একে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ফলশ্রুতিতে তেহরানের আধিপত্য বাড়তে থাকে।
বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আর জীবনযাত্রায় পাশ্চাত্য প্রভাবে তেহরান শুধু আরববিশ্বেই প্রভাব ফেলছে না, ইউরোপের শহরগুলোর সাথেও তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে।
তেহরানের ভৌগলিক তথ্য
৭৩০ বর্গ কিলোমিটারের শহর তেহরান বিশ্বের অন্যতম ঘন জনবসতি পূর্ণ শহর। জনসংখ্যার তুলনায় ঘরবাড়িও কম। নগরের মানুষ পারস্য জাতিভুক্ত তেহরানের প্রায় ৯৯ ভাগই ফার্সি ভাষায় কথা বলে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীরাও একে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে।
রাজধানীতে দুটো বিমানবন্দর রয়েছে। যার একটি অভ্যন্তরীণ অন্যটি আন্তর্জাতিক। এছাড়াও, মেট্রোপলিটন-এ শহরটিতে বেশ ভালো যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিদ্যমান।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ মিটার উঁচু এই শহরটিতে চার ধরনের ঋতু লক্ষ্যণীয়। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়ালেও শীতে তা হিমাঙ্কের নিচে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি নেমে যায়। শুষ্ক জলবায়ুর এই শহরটিতে প্রতিদিন সূর্যের আলো কমার সাথে সাথে ঠান্ডা আবহাওয়া বাড়তে থাকে।
তেহরানের অর্থনীতি
ইরান তথা তেহরানের অর্থনীতি তেল ও গ্যাস রপ্তানি নির্ভর। অর্থনীতির প্রায় ৬০ ভাগই কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত। দেশটিতে শিল্পের বিস্তারও রয়েছে। পারমাণবিক চুক্তিতে অংশ নেয়ার বিতর্কের জেরে মাঝে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বর্তমানে তা প্রত্যাহার করায় বিশ্ববাজারে তেহরানের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। লস অ্যাঞ্জলেস, লন্ডন, বেইজিং-এর মতো শহরের সাথে এটি সিস্টার সিটি সম্পর্কে যুক্ত৷
উল্লেখ্য, বিভিন্ন ভৌগলিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ে ভিন্ন দেশের দুটি শহরের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলে তাদের সিস্টার সিটি বলে।
তেহরানের পর্যটন
পর্যটনশিল্পেও তেহরানের বিচরণ রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত স্থাপনা, ভাস্কর্যের দিক থেকে তেহরানের অবস্থান উপরের সারিতেই। শহরের উত্তরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মিলাদ টাওয়ার। দেশের সর্বোচ্চ উঁচু এই টিভি টাওয়ারটি বিশ্বের ৬ষ্ঠ উঁচু টাওয়ার।
৪৩৫ মিটার লম্বা এই টাওয়ার নির্মাণে সময় লেগেছে ১১ বছর। একে বোর্জে মিলাদও বলা হয়। বর্তমানে এটি ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন্ড এন্ড কনভেনশন সেন্টার অফ তেহরান’-এর অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তেহরানে আজাদী টাওয়ার নামে আরও একটি নান্দনিক ভবন লক্ষণীয়। টাওয়ার অফ তেহরান নামেও এটি পরিচিত। রাজ বংশের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ১৯৭১ সালে এটি নির্মাণ করেন মোহাম্মদ রেজা শাহ। উল্লেখ্য, মিলাদ টাওয়ারের পরিকল্পনাও রেজা শাহ করেছিলেন।
শুধু টাওয়ারই নয়, রাজধানী তেহরানের ফেরদৌসি স্কয়ারে গেলে দেখা পাওয়া যাবে মহাকবির ভাস্কর্য। শহরের লালেহ পার্কে গেলে দেখা মিলবে ওমর খৈয়াম, আল বিরুনি-র মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য। গুলিস্তান প্যালেস তথা কাজা রাজাদের বাসভবনও অন্যতম দর্শনীয় স্থান। চলমান বছরেই তেহরানে ইসলামি বিশ্বের প্রথম পর্যটন প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
আরব বিশ্বের সাপেক্ষে তেহরান ও সৌদি-ইরান যুদ্ধ
আরববিশ্বে বেশ ভালোই প্রভাব রয়েছে তেহরান তথা ইরানের। শিয়াপন্থী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুন্নিপন্থী দেশগুলোও। ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম বিশ্বে মোড়ল হিসেবে সৌদি এগিয়ে থাকলেও ১৯৭৯-এর শিল্প বিপ্লবের পর নেতৃত্বে এগিয়ে আসে তেহরানও। এরই প্রেক্ষিতে জেদ্দার সাথে সম্পর্কেও শীতলতা আসে। প্রধান কারণ হিসেবে যদিও শিয়া-সুন্নি বিভেদ দেখানো হয়েছিল
ইসলাম ধর্মের এই দুই মতের দল এক হতে পারে না। এটাই কারণ বলা হলেও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই যে মূল কারণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত ইরান পার্সি জাতি। আর পারস্য-আরব দ্বন্দ্ব তো জাতিগতভাবেই চলে আসছে। তবে সম্প্রতি দুই দেশকেই মীমাংসার দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। বাগদাদে জেদ্দা-তেহরান শীর্ষক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পরিবেশ দূষণ-তেহরানের অন্যতম প্রধান শত্রু
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছাড়াও জৌলুশে ভরপুর তেহরানের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশ দূষণমাত্রা। একসময়ের নান্দনিক বাগানযুক্ত তেহরান এখন বসবাসযোগ্য দেশের তালিকায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সরকারি তথ্যমতে, সর্বশেষ ইরানি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরে মাত্র ২ দিন তেহরানের বাতাস পরিষ্কার ছিল যেখানে ১১১ দিন অনিরাপদ হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল।
কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে প্রায় ২ বছর পর স্কুল খুললেও বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের বের না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ভূমিকম্প ও বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইরানের রাজধানী স্থানান্তরের প্রস্তাবও উঠেছে যদিও তা এখনও অনুমোদন পায়নি।
তবে তেহরানকে বাসযোগ্য করতে বর্তমানে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শহরে সবুজায়ন বাড়ানো হচ্ছে। গত ছয় বছরে আট শতাধিক গ্রিন পার্ক এবং প্রধান মহাসড়কগুলোতে ২৬টি গ্রিন করিডোর করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধেও কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যানযট নিরসনেও ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
সরকারি পরিবহনে উদ্বুদ্ধকরণ, নির্দিষ্ট এলাকায় সকাল থেকে দুপুর অবধি বেসরকারি যান চলাচল বন্ধ, এছাড়া যত্রতত্র পার্কিং-এর ফলে যেন বাতাস দূষিত না হয় সেজন্যও নেয়া হয়েছে পার্কিং পলিসি। সব সমস্যা মিটিয়ে তেহরান আবার ফিরুক তার গৌরবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Four Changes Made Tehran More Liveable City. 02. Tehran. 03. Iran's capital Tehran Enveloped by Pollutants Due to Strong Wind. 04. Tehran Iran Mehrdad Mzadeh.