ডেনমার্ক: সুখী মানুষের দেশ

1767
0

স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ‘সুখী মানুষ’ নামে একটা গল্প ছিল, যার লেখক ছিলেন মমতাজ উদ্দীন আহমদ৷ কৈশোরকালের সেই গল্পটি পড়ার পর কমবেশি সবারই মনে হয় যে আদৌ কি সুখী মানুষ হওয়া সম্ভব এতো নাগরিক সমস্যার ভীড়ে? সুখ কি তবে অধরাই থাকে সব মানুষের কাছে? দুনিয়ার কোন মুল্লুকে গেলে কি একটু সুখ পাওয়া যাবে? সুখ কোথায় আছে? সুখী মানুষের দেখা পাওয়া যাবে কোন দেশে?

সুখ ব্যাপারটা অনেকের কাছেই আপেক্ষিক৷ শতভাগ সুখী কেউ না হলেও আজকে এমন এক দেশের কথা জানবো যে দেশের মানুষ সুখী মানুষ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত৷ ২০১৭ সালে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ নির্বাচিত হওয়া ডেনমার্কের কথাই বলছিলাম৷

প্রতি বছরই এই তালিকা প্রকাশ করা হয়৷ ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্সের জরিপে বিশ্বের ১৫৫টি দেশের মধ্যে ২০১৭ সালে ডেনমার্ক ছিল এক নম্বরে৷ মোট ৬টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এই তালিকা করা হয়ে থাকে; জিডিপি লেভেল, জীবনের প্রত্যাশা, ডোনেশান, সামাজিক সহযোগিতা, স্বাধীনতা এবং দুর্নীতি৷ এই জরিপে বরাবরই ডেনমার্ক প্রথম সারিতে থাকে৷

ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন। Image Source: pixabay.com

বাইরে যাবেন? দরজা তো তালাতে লাগাতে হবে৷ কিংবা কফি খেতে যাবেন? ছোট্টো বাবুকে কে দেখবে সেই চিন্তা যদি মনে না থাকে তাহলে বলা যায় আপনার দৈনন্দিন জীবনের স্ট্রেস বেশ অনেকটাই কমে গেল৷ ডেনমার্কে বাস করলে আপনাকে এসব ব্যাপার নিয়ে ভাবতেই হবে না৷ দরজা খোলা রেখে চলে গেলেও ফিরে এসে দেখবেন বাসায় সবকিছু ঠিকঠাক আছে, ঘুমে থাকা আপনার ছোটো বাচ্চাটিও ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে৷

ডেনমার্কে লাইফ সেইফ, যেখানে সবার কাছ থেকেই সততা আশা করা যায়৷ সুখী জাতি হওয়া খুব বেশি কঠিন নয় যখন আপনি আপনার আশেপাশের সবাইকে বিশ্বাস করতে পারবেন৷ ড্যানিশ কালচারে বিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু৷ এখানে দেখা যায় ছোটো বাচ্চারা একাই ট্রাভেল করছে, লোকজন দিন কিংবা রাত যে কোনো সময়েই নির্ভয়ে বাইরে যেতে পারে ঘুরতে, নারীরাও রাস্তাঘাটে চলাফেরা করছে নিশ্চিন্ত মনে৷ প্রায় ৭৯% ড্যানিশ মনে করেন তারা তাদের সাথে পরিচিত হওয়া বেশিরভাগ মানুষকে বিশ্বাস করেন এবং সবাইকেই বিশ্বাস করা উচিত৷

সবচেয়ে সুখী হওয়া সত্ত্বেও ড্যানিশ লোকজন সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ইনকাম ট্যাক্স দেন৷ যাদের বাৎসরিক আয় ৪৩,০০০ মার্কিন ডলার তারা ৪৫% ইনকাম ট্যাক্স ও বার্ষিক ৬৭,০০০ মার্কিন ডলারের বেশি আয় যাদের তারা ৫২% ইনকাম ট্যাক্স দেন৷ এর বিনিময়ে তারা ফ্রিতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা পাচ্ছেন৷ এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী মাসে ৯০০ মার্ডকিন লার করে বৃত্তি পায়৷ জরিপ বলছে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ডেনিস সানন্দে ট্যাক্স দেন৷

ডেনমার্কের জাতীয় পতাকা। Image Source: pixabay.com

বেশিরভাগ পণ্যে প্রায় ২৫%-এর মতো ভ্যাট দিতে হয় এখানে৷ কিন্তু তারপরেও বেশিরভাগ লোকজন স্বাচ্ছ্বন্দ্যে এই ট্যাক্স দেন ,কারন তারা দেখতে পাচ্ছেন তাদের সরকার বিনিময়ে কেমন সার্ভিস দিচ্ছে৷ ঝকঝকে রাস্তাঘাট, ঝামেলাহীন মিউনিসিপ্যালিটি সার্ভিস, হেলথ ইন্স্যুরেন্সসহ সব ধরণের সরকারি সেবার মানই সন্তোষজনক৷

স্বাস্থ্যসেবা কিংবা উচ্চশিক্ষা এই দুটো নিয়ে ডেনমার্কে কাউকে চিন্তায় রাত পার করতে হয় না, অভাবের তাড়নায় কাউকে আত্মহত্যা করতে হয় না, কিংবা চিকিৎসার অভাবে কেউ রাস্তাঘাটে মারা যায় না৷ বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি ফ্রি৷ বয়স্করা পেনশন পান, সেই সাথে চাইল্ডকেয়ারেও আছে সরকারি ভর্তুকি৷

ডেনমার্কে রয়েছে ২ বছরের বেকার ভাতা৷ বেকারত্বের দায় নিয়ে কাউকে ডিপ্রেশনে থাকতে হয় না৷ এমনকি আপনার হুট করে জব চলে গেলেও খুব হতাশ হওয়ার কিছু নেই৷ নতুন ক্যারিয়ার শুরু করার উৎসাহও পাবেন৷ Felxicurity model নামে এখানে সিস্টেম আছে যাতে কর্মচারীরা সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করেন৷ তার মানে কিন্তু এই না যে আপনি অফিস আওয়ারে বিনা প্রয়োজনে ফেসবুকিং করবেন কিংবা অনর্থক সময় নষ্ট করবেন৷ ডেনমার্কে বেশিরভাগ এমপ্লয়িই সৎ ও দায়িত্ববান। তাই বসকে সর্বক্ষণ চিন্তায় থাকতে হয় না যে সব কাজ ঠিকভাবে হলো কিনা, কেউ ফাঁকি দিলো কিনা৷

ডেনমার্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য চোখজুড়ায়। Image Source: pixabay.com

ডেনিসদের বেতন নির্ধারিত হয় যোগ্যতার ভিত্তিতে৷ পদোন্নতির জন্য আপনাকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হবে না অথবা নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে এমন কিছু করতে হবে না যা দ্বারা প্রমাণ হয় আপনি প্রমোশনের যোগ্য কিংবা আপনার বেতন বাড়ানো উচিত৷ আপনি যতটুকুর যোগ্য ঠিক ততটুকুই পাবেন৷ মানে এখানে রাতদিন এক করে বসকে ইম্প্রেস করার কোনো ঝামেলাই নেই৷

ডেনমার্কে খুব ভালো জব করাই সবকিছু না, ভালো জব করাকেই জীবনের লক্ষ্য ধরা হয় না৷ এখানে কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবন ব্যালেন্সড৷ প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৩৩ ঘন্টা ফুল টাইম জব করে এখানের কর্মজীবীরা৷ সাথে আছে আকর্ষণীয় হলিডে ফান্ড৷ প্যারেন্টাল লিভের ক্ষেত্রেও ডেনিসদের রয়েছে সবচেয়ে উদার কিছু নীতি৷ বাবা কিংবা মায়েরা ৫২ সপ্তাহেরও বেশি সময় প্যারেন্টাল লিভ কাটাতে পারবেন, সেই সাথে রয়েছে ৩২ সপ্তাহের মনিটারি সাপোর্ট৷ প্রডাক্টিভিটি কিংবা পারফরমেন্সের ভিত্তিতে ইউএস, জার্মানি কিংবা জাপানের চেয়েও উচ্চ অবস্থানে আছে ডেনমার্ক৷

ডেনিসদের কালচারে একটা অলিখিত নিয়ম আছে যাকে বলা হয় Jante’s Law (জেনতেই’জ ল) বা Janteloven (জেনতেলোভেন) যার মানে হলো নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করার জন্য আপনাকে কোনো প্রকার অভিনয় করতে হবে না, অন্যদের চেয়ে নিজেকে ভালো প্রমাণের চেষ্টা করতে হবে না৷ অর্থাৎ আপনি যেমন, আপনি তেমনই সুন্দর৷ কেউ কারো থেকে বেটার না এবং ডেনমার্কে সবাইকে সমান চোখেই দেখা হয়৷ আশেপাশের কেউ কোনো কিছু নিয়ে আপনাকে কথা শুনাবে না; বরং প্রতিটা ভালো কাজে উৎসাহ দিবে৷ আপনার ব্যার্থতায় কেউ হাসবে না, ব্যঙ্গ করবে না৷

Janteloven/Jantes Law শব্দ ও কন্সেপ্টটি ১৯৩০-এর দশকে জনপ্রিয় একটি স্যাটাইরিকাল নোভেল থেকে নেওয়া৷ ডেনমার্কে Hygge নামে একটা কন্সেপ্ট প্রচলিত আছে যার উচ্চারণ ইংরেজি Hoo-ga বা বাংলায় হো-গা৷ শুনতে খানিকটা অদ্ভুত এই শব্দটির সঠিক অনুবাদ এখনো করা যায়নি৷ তবে এর মানে হলো জীবনের ছোটো ছোটো আনন্দগুলোকে উপভোগের জন্য প্রতিদিন ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করা, নিজেকে ভালো রাখার জন্য অন্যসব কিছু থেকে একটু ব্রেক দেওয়া৷ Hygge (হো-গা) সচরাচর পরিবার ও বন্ধুদের সাথে উদযাপন করা হলেও আপনি একাও করতে পারেন কোন একটা ভাল বই মুভি কিংবা টিভি সিরিজের সাথে৷

Hygge by Meik Wiking. Image Source: unsplash.com

ড্যানিশ উইন্টারের সময় Hygge করা হয় ইনডোরে৷ গরমের সময় এটি সাধারণত সামার হাউজ কিংবা বাসা থেকে দূরে কোথাও করা হয়৷ সেখানে বাগানে লাঞ্চ কিংবা ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয় সাথে থাকে স্থানীয়ভাবে চাষ করা সুস্বাদু স্ট্রবেরী৷ গবেষণায় দেখা যায় হ্যাপিনেস এবং এম্পাওয়ারমেন্টের মাঝে একটা স্ট্রং রিলেশনশিপ আছে৷ ডেনিসরা নিজেদের জীবনের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে৷ তাদেরকে কখনোই বদ্ধ খাঁচায় আটকে রাখা যায় না, যা তাদের সুখী হওয়ার অন্যতম একটি কারন৷ কারন যখন আপনি আপনার ইচ্ছামতো কোনো কাজ করতে পারবেন তখন অবশ্যই নিজেকে সুখী মনে হবে৷

এখানে বিকেল সাড়ে ৫টার পর এবং উইকেন্ডে কাজ করলে লোকে পাগল ভাবে৷ কারন দিনরাত শুধু কাজ করে যাওয়াই জীবনের মূল লক্ষ্য না৷ এই সময়টা ডেনিসরা তাদের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে কাটায় যা তাদের সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে তুলেছে৷ স্ট্যাবল গভর্নমেন্ট এবং ক্রমাগত দুর্নীতি ও অপরাধের নিম্নসূচক ডেইন্সের মানসিক চাপ কমিয়ে সুখী হতে সাহায্য করেছে৷

যদিও Hygge ড্যানিশ কালচার থেকে এসেছে তবে এটা এখন বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠেছে৷ অ্যামাজন Hygge নিয়ে লেখা প্রায় ৯০০-এর মত বই বিক্রি করেছে, ইন্সটাগ্রামে Hygge হ্যাশট্যাগ দিয়ে প্রায় ৩ মিলিয়ন পোস্ট হয়েছে৷ অক্টোবর ২০১৬ এর শুরুর দিকে গুগলে Hygge এর সার্চ সংখ্যা বেড়ে যায়৷

Hygge এর সিমিলার কন্সেপ্ট আছে অন্যান্য স্ক্যান্ডানাভিয়ান দেশেও৷ নরওয়েজিয়ানদের Koselig, সুইডিশদের Mysig, ডাচদের Gezenlligheid এবং জার্মানদের Gemutlichkeit; ড্যানিশদের Hygge এর মতোই৷

যখন জীবনের মৌলিক চাহিদার পাশাপাশি অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও সহজলভ্য হয়ে যাবে, চারপাশের স্ট্রেস কমে যাবে,তখন সুখী অনুভব করা খুব একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়৷ আর ড্যানিশরা এজন্যই অন্যদের চেয়ে বেশি সুখী৷

 

Feature Image: studyindenmark.com 
References:  
01. http://scandification.com. 
02. http://scandification.com. 
03. http://independent.co.uk. 
04. http://livescience.com. 
05. http://all-luxury-apartments.com.