অ্যাংকর ভাট উত্তর-পশ্চিম কম্বোডিয়ার শহর সিম রিপে অবস্থিত একটি বিশাল বৌদ্ধ মন্দির কমপ্লেক্স। মূলত দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে খেমার সাম্রাজের রাজ্য মন্দির এবং রাজধানী হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। খেমার ভাষায় অ্যাংকার শব্দের অর্থ “রাজধানীর শহর।” অন্যদিকে ভাট শব্দের অর্থ “মন্দির।”
চারশত একরের বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, অ্যাংকার ভাটকে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় স্মৃতিস্তম্ভ বলা হয়। প্রথমদিকে এটি হিন্দু মন্দির হিসেবে নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে এটি বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মে অ্যাংকর ভাটের গুরুত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি স্থানটিকে ঘিরে কিংবদন্তিও বেড়েছে। পর্তুগিজ সন্ন্যাসী অ্যান্তনিও দ্য ম্যাডেলেনা বলেন,
অ্যাংকর ভাট একটি অসাধারণ স্থাপনা।
ইতিহাস
অ্যাংকার ভাট খেমার সাম্রাজের রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মনের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। যার শাসনকাল ১১১৩ থেকে ১১৫০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। মূলত রাজ্য মন্দির ও রাজধানী হিসেবে নির্মাণ করা হলেও কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, সম্রাট এই স্থানটিকে তার সমাধি এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মন্দির হিসেবে তৈরি করেছিলেন।
আবার অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, এটি হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সম্মানে নির্মিত হয়েছিল। এসব নিয়ে অনেক মতবাদ রয়েছে। নির্মাণকালে এই ধর্মীয় স্থাপত্যের নাম অন্য কিছু ছিল; কিন্তু সমসাময়িক কোন শিলালিপিতে এই মন্দিরের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। সম্রাট দ্বিতীয় সূর্যবর্মনের মৃত্যুর ফলে এর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে দেয়ালের কিছু কারুকাজ অসমাপ্ত থেকে যায়।
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে খেমারদের চিরাচরিত শত্রু চামদের হাতে পরাজিত হয়। এরপর নতুন সম্রাট সপ্তম জয়বর্মনের আগমন ঘটে। তিনি নতুন রাজধানী অ্যাংকর থমে এবং রাজ্য মন্দির বেয়নে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে অ্যাংকর ভাট ধীরে ধীরে হিন্দু উপসনালয় কেন্দ্র থেকে বৌদ্ধ উপসনালয়ে পরিণত হয়। অনেক হিন্দু ভাস্কর্য বৌদ্ধ শিল্প দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
আধুনিক নাম ‘অ্যাংকর ভাট’ ষোড়শ শতকের পর থেকে শুরু হয়। ‘আন্তোনিও দা মাগদালেনা’ হলেন একজন পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারক। তিনি ১৫৮৬ সালের দিকে এই মন্দির এলাকা পরিদর্শন এবং বলেছিলেন যে,
এমন অসাধারণ নির্মাণ ভাষায় বর্ণনা করা অনেক কঠিন।
বিশেষ করে টাওয়ার, দেয়ালের সাজসজ্জা এবং সমস্ত পরিমার্জন যা মানুষের দ্বারা সম্ভাব্য সেরা স্থাপত্য। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে স্থাপত্যটি সেই সময় পুরোপুরিভাবে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
১৮৬০ সালের দিকে, ফরাসি ধর্ম প্রচারক ফাদার চার্লস-এমিল বুইলভাক্সের সহায়তায়, ফরাসি প্রকৃতিবিদ এবং অভিযাত্রী ‘হেনরি মাউইট’ মন্দিরটি আবার পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তার ভ্রমণ কাহিনির মাধ্যমে পাশ্চাত্যে এই মন্দিরের কথা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বর্ণনা করেন যে, গ্রীস বা রোম আমাদের কাছে যা রেখে তার চেয়েও মহান শিল্প এই অ্যাংকর ভাট।
উনবিংশ শতাব্দীতে, ফরাসিরা কম্বোডিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলের ওপর তাদের ঔপনিবেশিক স্থাপন করে। যার ফলে ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন যে, অ্যাংকার ভাট তাদের দ্বারা আংশিকভাবে সংস্কার হয়েছিল। কম্বোডিয়ায় ১৯৫২ সালে ফরাসি শাসন ভেঙে যায়, কিন্তু তারা অ্যাংকার ভাট পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।
১৯৭০ এর দশকে, খেমার রুজদের হাতে কম্বোডিয়ার শাসন ক্ষমতা চলে যায় এবং গৃহযুদ্ধের কারণে প্রচেষ্টাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় মন্দিরের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। মন্দিরে সম্মুখভাগে বুলেটের গর্তগুলো এখনও বিদ্যমান।
স্থাপত্য নিদর্শন
অ্যাংকার ভাট মন্দির নির্মাণের জন্য পাহাড়ি মন্দির ধাঁচ ও গ্যালারি মন্দির ধাঁচ দুই ধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১,১৫০ মিটার এবং প্রস্থে ১,৪০০ মিটার। এর চারদিক বিশাল পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। যা ৬২০ ফুট চওড়া এবং তিন মাইলেরও বেশি লম্বা।।
মূল মন্দির দেখতে মেরু পর্বতের মতো। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে পরিখাটি পৃথিবীর চারপাশের সমুদ্রের সাথে সাদৃশপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তাছাড়া পরিখাটি অ্যাংকার ভাটকে বিভিন্ন বহিশত্রুর হাত থেকে রক্ষাও করেছিল।
খেমার স্থাপত্যের অন্যতম ভিত্তি হলো পিরামিড। যার এককেন্দ্রিক গ্যালারি রয়েছে। যা অ্যাংকার ভাটের নকশায় স্পষ্ট। প্রতিটি সোপান একটি আচ্ছাদিত গ্যালারি দ্বারা ঘেরা। প্রতিটি কোণে টাওয়ার এবং মন্দিরের মাঝখানে প্রায় ৭০ ফুট উঁচু টাওয়ার রয়েছে। তাছাড়াও মন্দিরের চারকোণে চারটি টাওয়ার রয়েছে।
টাওয়ারগুলোতে পদ্মের কুঁড়ির মতো খোদাই নকশা রয়েছে। অ্যাংকার ভাট তৈরি করতে পাঁচ থেকে দশ মিলিয়নের মতো বেলেপাথরের খন্ডের প্রয়োজন হয়েছিল। সমগ্র অ্যাংকার শহরটিতে মিশরীয় পিরামিডের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল।
তাছাড়া, মন্দিরটি স্থাপত্যের সাথে একীভূত এবং খ্যাতির অত্যতম কারণ হলো অ্যাংকার ভাটের ব্যাপক সাজসজ্জা। যা মূলত বেইজ-রিলিফ রুপ নেয়। বাইরের গ্যালারির ভিতরের দেয়ালগুলোতে প্রধানত হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারতের চিত্রিত ফলক রয়েছে। এগুলো দেখে ঐতিহাসিক হিহাম, পাথর খোদাইয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ রৈখিক বিন্যাস বলে অভিহিত করেছেন।
অ্যাংকার ভাট অপ্সরা এবং দেবতার চিত্রে সজ্জিত। বর্তমানে গবেষণায় ১৭৯৬টিরও বেশি দেবতার চিত্র পাওয়া গেছে। এই মন্দিরের স্থাপতিরা ‘স্তম্ভ এবং দেয়ালে অলংকারণ হিসেবে ছোট অপ্সরা চিত্র নিযুক্ত করেছিলেন।’ তাছাড়া, মন্দির প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বৃহত্তর অপ্সরার চিত্রও রয়েছে।
বর্তমান অবস্থা
কম্বোডিয়ার অন্যান্য প্রাচীন মন্দিরগুলোর মতো, অ্যাংকার ভাট অতিরিক্ত বনভূমি, ভূমিকম্প এবং যুদ্ধের ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে কম্বোডিয়ান সরকার অ্যাংকার ভাটের ব্যাপক সংস্কার করে। ১৯৯২ সালের দিকে, অ্যাংকার ভাটকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা ভুক্ত হওয়ার ফলে পর্যটকদের কাছে ঐতিহাসিক এই মন্দিরের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়।
২০০৪ সালের সমীক্ষা মতে, কম্বোডিয়াতে মোট পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি। যার বেশিরভাগই অ্যাংকার ভাটে যাওয়ার পরিকল্পনা করতেন। পর্যটক শিল্পের আয়ের ৪০% মন্দিরের রক্ষাণাবেক্ষণে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তাছাড়া মন্দিরের কারুকার্যকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে অ্যাংকার ভাট কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীকে পরিনত হয়েছে। সারা বিশ্বে এটিই একমাত্র মন্দির যা দেশের পতাকায় প্রদর্শিত হয়েছে।
Feature Image: masterclass.com
References:
01. The Angkor Wat.
02. Angkor Wat.
03. The Cambodia-famous-temple-Angkor-wat.
04. The Angkor-wat History.
05. Angkor-wat-temple-guide.