ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই অবৈধভাবে সৃষ্ট রাষ্ট্রটি যে শুধুমাত্র এই কর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় তাও জানা দরকার। যুগের পর যুগ তারা নানা কুখ্যাত অপারেশনে লিপ্ত ছিল। আজকের আয়োজনে ইজরায়েলের কিছু কুখ্যাত কর্মের দৃষ্টান্ত সম্পর্কে জানানো হবে।
মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স
গুপ্তহত্যার মতো নৃশংস বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হলে যেসব নাম মাথায় আসবে তাদের মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবে মোসাদ, ইসরায়েল-এর প্রধান এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, ইসরায়েল-এর আরো দুটি গোয়েন্দা সংস্থা আছে; শিন বেত (ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থা) আর আমান (ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা)।
আমান আর শিন বেত-এর কাজ মোটামুটি ইসরায়েল-এর ভূখন্ডের ভেতরে সেনা আর পুলিশি কাজে গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ আর পৃথক পৃথক কর্মকাণ্ডের মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করা হলেও মোসাদ কিন্তু ঠিক তার যোজন যোজন দূরের একটা সংস্থা। কাজের দিক থেকে তাদের সবার একই বৈশিষ্ট্য থাকলেও মোসাদের কর্মক্ষেত্র বেশিরভাগ সময়ই থাকে ইসরায়েলের ত্রিসীমার বাইরে।
হত্যা আর গোপন নথি জোগাড়যন্ত্রে মোসাদ চোস্ত হলেও এসব খবর বিশ্ব তখনই জানে যখন তাদের এসব কার্যক্রম অনিচ্ছাকৃত ভাবে ধরা পড়ে যায় অথবা মোসাদ তাদের শত্রু সংগঠনগুলোর জ্ঞাতার্থে ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মনস্থির করে। ১৯৪৯ এর ডিসেম্বরে ভূমধ্যসাগরীয় হিমেল হাওয়ায় যখন আরব দেশগুলো একটা নতুন প্রতিবেশীর অযাচিত আগমনে ফুসছিল, তখন ইসরায়েলের বেন গুরিওন একটা নতুন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করে, যেটার প্রধান কাজ হবে দেশের সীমানার বাইরে ইন্টেলিজেন্স অপারেশন (অভিযান) করা। পরে এই সংস্থার নাম দেয়া হয় ‘ইন্সটিটিউট ফর ইন্টেলিজেন্স এন্ড স্পেশাল অপারেশনস।’
এখন অবশ্য আমরা একে চিনি শুধু ‘ইন্সটিটিউট’ বা এর হিব্রু প্রতিশব্দ ‘মোসাদ’ নামেই। এটি তাদের জন্য একটি সাফল্য ছিল যারা বিশ্বাস করেছিল যে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনীতির পরিবর্তে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সম্প্রদায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। এবার জেনে আসা যাক কিছু কুকীর্তি যেগুলোর জন্যে ইসরায়েল গোটা বিশ্বের কাছে কালিমাময় এক পোস্টার।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার
এই তো বিগত বছরেই ইসরায়েল নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা ছাড়াও আরো একটি কারণে গোটা পৃথিবীর শ্যেনদৃষ্টিতে চলে আসে, পেগাসাস স্পাইয়ের মাধ্যমে। ইসরায়েলি NSO কোম্পানিটির এই গুপ্তচরবৃত্তির সফটওয়্যারটির বানিজ্যিকিকরণের প্রতি ছিল মোসাদের তৎকালীন হর্তাকর্তাদের বিশেষ নজর।
প্রায়ই তাদের দেখা যেত কোম্পানিটির হেডকোয়ার্টারে বিদেশী সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে আসা যাওয়া করতে- এমনটিই দাবি করেন কোম্পানিটির কিছু কর্মী। সৌদি, এঙ্গোলাসহ অনেক দেশেই ইসরায়েলিরা তাদের দেশীয় এই স্পাইওয়্যারটি বিক্রি করতে সক্ষম হয়।
এমনকি এও ধারণা করা হয় যে, ইসরায়েল যেসব মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সাথে সুবিধাজনক কূটনৈতিক সম্পর্কে আগ্রহী ছিল, তাদেরকে উপঢৌকন হিসেবে এই পেগাসাস পরিবেশন করা হচ্ছিল।
ফাদি আল-বাতাশ হত্যাকাণ্ড
২০১৮ সালে ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী ডঃ ফাদি আল বাতাশ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে খুন হন দুইজন আততায়ীর হাতে। মধ্য এপ্রিলের এক শনিবার সকালে ফাদিকে পরপর ১০টি গুলিতে ঝাঁজরা করে দেয় সেই দুইজন হত্যাকারী। ফাদি মালয়েশিয়াতে এক বেসরকারি বিস্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তবে তার আগে তিনি ছিলেন গাজার এনার্জি অথরিটির একজন কর্মকর্তা।
মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ গোটা ঘটনাটিকেই একটা জঙ্গি কার্যক্রম হিসেবে গণ্য করে এবং তৎক্ষণাৎ তদন্ত শুরু করে। ফাদির পরিবার জানায় মৃত্যুর আগে তিনি তুরষ্কে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন একটি কনফারেন্সে অংশ নেবার জন্য। তার পরিবারের দাবি যে তাকে হত্যার পেছনে দায়ী একমাত্র ইসরায়েল আর মোসাদ। কারণ তিনি হামাস এর সদস্য ছিলেন।
১৯৮০’র ইরাকি বিজ্ঞানী হত্যাযজ্ঞ
১৯৮০ সালে ইসরায়েল বেশ কজন ইরাকি বিজ্ঞানীদের গুপ্তহত্যা করে মোসাদের কিদন ইউনিটের দ্বারা। এদের মধ্যে ছিলেন মিসরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ইয়াহিয়া আল মাশাদ যিনি ইরাকি নিউক্লিয়ার প্রোজেক্টের কাজে নিয়োজিত ছিলেন যা সাদ্দাম হোসেনের হাত ধরেই শুরু হয়। একটা সরকারি সফরেই তিনি প্যারিসে অবস্থান করছিলেন, যেখানে তার হোটেল কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
১৩ই জুনে আল মাশাদকে হত্যা করা হলেও মোসাদ তার সহকর্মী ইরাকী-কুর্দি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আবদাল রাহমান রাসুলকে হত্যা করে ডিসেম্বরে, প্যারিসেই গুলি করে। ময়নাতদন্তে পাওয়া যায় এক চাঞ্চল্যকর তথ্য, তার রক্তে ছিল এক অজানা ভাইরাস। রাসুল ছিলেন একই নিউক্লিয়ার প্রোজেক্টে কর্মরত।
ইরাকি পরমাণু বিজ্ঞানী সালমান রশিদ আল-লামীকে ১৯৮১ এর জুনে জেনেভাতে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। তার মরদেহ বিভৎসভাবে ফুলে ছিল যার থেকে পরে সুইস ময়নাতদন্তকারীরা একই অজানা ভাইরাসের হদিস পান।
ইরানী নিউক্লিয়ার সাইটে মোসাদের হয়ে ওলন্দাজ গুপ্তচরের কীর্তি
২০০৭ সালে মূলত সিআইএ এবং মোসাদের অনুরোধেই ওলন্দাজ গোয়েন্দা সংস্থা এআইভিডি এক ইরানি ইঞ্জিনিয়ারকে ইরানি নিউক্লিয়ার সাইটে প্রেরণ করে সাধারণ বিজ্ঞানী হিসেবে। সেই ইরানি ইঞ্জিনিয়ার ইসরায়েলী এবং যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা বানানো Stuxnet ভাইরাস ইরানের নাতাঞ্জে অবস্থিত ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট ফ্যাসিলিটিতে প্রতিস্থাপন করে।
এই Stuxnet ভাইরাসটিকে শুধু প্রতিস্থাপন করেই সেই গুপ্তচর ক্ষান্ত হয়নি, বরং নাতাঞ্জের সেই সাইটের গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং কেন্দ্রীয় সিস্টেমের আদ্যোপান্ত জোগাড় করে সে তার ত্রাতা AIVD, CIA আর মোসাদকে প্রেরণ করে।
Stuxnet এর কাজ ছিল ইরানি নিউক্লিয়ার সাইটের সকল সিস্টেমের বৃত্তান্ত জেনে নিয়ে সেন্ট্রিফিউজগুলোর প্রসেসের গতি বাড়িয়ে দিয়ে সমৃদ্ধকরণে বাঁধাগ্রস্থ করা। এই গোটা অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অলিম্পিক গেমস’ কারণ অলিম্পিক গেমসের পাঁচ রিং এর মতোই এই অভিযানে জড়িত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, জার্মানি, নেদারল্যান্ড আর ফ্রান্স অথবা যুক্তরাজ্য।
ভাইরাসটি শেষ পর্যন্ত নাটাঞ্জের বাইরে এবং সারা বিশ্বে অন্যান্য সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে এটি শেষ পর্যন্ত সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিলক্ষিত হয়, যারা ২০১০ সালে এটির অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল। ভাইরাসটি প্রকাশ্যে আসার পরে ইরান নাতাঞ্জে বেশ কয়েকজন কর্মীকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে বলে জানা গেছে। দুটি গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, সেখানে মৃত্যু হয়েছে তবে সেই ওলন্দাজ গুপ্তচর অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা তা জানা যায়নি।
ইরান অবশেষে ২০১৫ সালে বিশ্ব শক্তির সাথে যৌথ ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা (JCPOA) স্বাক্ষর করে, তারা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির অস্ত্র-সক্ষম দিকগুলি ভেঙে দিতে সম্মত হয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে।
আরো কিছু কুখ্যাত কর্মসমূহ
মোসাদের সবচেয়ে সুপরিচিত কৃতিত্বের মধ্যে একটি হলো নাৎসি যুদ্ধাপরাধী অ্যাডলফ আইকম্যানকে ধরা, যাকে শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলে বিচার করা হয়েছিল এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
অন্যগুলোর মধ্যে আরো একটি হলো বাগদাদে যুদ্ধরত ইরাকি কুর্দি বিদ্রোহীদের জন্য সাহায্যের আয়োজন করা, সেই সাথে একজন ইরাকি পাইলট যে তার মিগ-২১ ইসরায়েলে উড্ডয়ন করেছিল তার দেশত্যাগে সাহায্য করা।
এলি কোহেন, কুখ্যাত গুপ্তচর যিনি সিরিয়ার সরকারে অনুপ্রবেশ করেছিলেন, সামরিক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের সময় গোলান মালভূমি দখলে ইসরাইলকে সহায়তা করেছিল।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ২০২১ সালের মে মাসে হঠাৎ বোমাবর্ষণের সময় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বোমা হামলায় গাজা শহরের চারটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে এবং এমনকি যুদ্ধাপরাধও হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। হামলার ফলে আশেপাশের বাড়িগুলিও ধ্বংস হয়ে যায়, তার সাথে সাথে আশেপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
ইসরায়েলি সৈন্যরা ১১ মে থেকে ১৫ মে এর মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণআল-রিমাল এলাকাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। প্রতিটি বোমা হামলাতেই, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ভাড়াটিয়াদের আসন্ন হামলার আগাম সতর্কবাণী দিয়েছিল তার সাথে সহায় সম্বল নিয়ে কোনমতে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ।
তিনটি ভবনই সঙ্গে সঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং চতুর্থ আরেকটি ভবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি সামরিক উদ্দেশ্যে টাওয়ারগুলি ব্যবহার করছিল, তবে এই অভিযোগগুলি সমর্থন করার জন্য কোনও প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি।
এ তো গেল দৃষ্টিগোচরে আসা কিছু কুখ্যত কর্মসমূহ। যুগের পর যুগ ইসরায়েল তার গুপ্ত বাহিনীর মাধ্যমে কুখ্যাত নানা অপারেশন করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও যে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে তা নিশ্চিতভাবেই অনুমান করা যায়।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Israel's quiet annexation of the Golan Heights. 02. WORLD Israel hits Gaza with airstrikes. 03. The truth about Mossad. 04. Private Israeli spyware used to hack cellphones of journalists, activists worldwide. 05. Palestinian engineer 'killed by Mossad' in Malaysia, says family.