আনান আর আনিতা দুই ভাইবোন। মা নেই ওদের। বাপ খাম্বাং ফোনাসা দূরের গ্রামে কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। আনিতা ঘরেই থাকে। আনান বাপের সাথে ক্ষেতে যায় মাঝেমধ্যে। জোর করেই যায়। ওকে ক্ষেতে নিয়ে যেতে মন সায় দেয় না ফোনাসার।
ভালো ফলন নেই এই এলাকার মাটিতে। এমনিতেই চাষবাস করে হতাশ মুখে বাড়ি ফেরে নিয়মিত। তার ওপর ছেলেটাকেও এই হতাশায় পেয়ে বসুক, ফোনাসা তা চায় না। তার চেয়ে বরং পড়াশোনা করুক আনান। রাতে খাবার নিয়ে বসে কখনো সখনো বোঝায় এসব ছেলেকে। এই গ্রামের মাটি কৃষিবান্ধব নয়। এই মাটি বিস্ফোরকের আস্তানা। যুক্তরাষ্ট্র কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করলেও অকাতরে বোমা ফেলেছে এদিকটায়। আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার কথা এসব।
এসব কথা শুনে আনানের চোখ বড় হয়ে যায় বিস্ময়ে। এত গভীরের কথা তেমন কিছুই জানে না সে। শুধু বুঝতে পারে ওদের এই বান নাপিয়া গ্রামটাতে এখনো মাঝে মাঝে মানুষ মারা যায় বোমার আঘাতে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ
মায়ানমার, চিন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডের মধ্যমণি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যখানে অবস্থান লাওস নামের পর্বতবেষ্টিত দেশটির। বান নাপিয়া এই দেশেরই একটি গ্রাম। ১৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা এবং ১০৫ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমারেখা বরাবর লাওসের জিয়াং খোয়াং প্রদেশে অবস্থিত গ্রামটি। লাও ভাষায় ‘বান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে গ্রাম। সেই বিচারে গ্রামের নাম কেবল নাপিয়া বললেও চলে। তবে স্থানীয়ভাবে বান নাপিয়া হিসেবেই লাওশিয়ান জনগণ গ্রামটির পরিচয় দেয়।
বান নাপিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ এমনিতে সবুজে ঘেরা। পাহাড়ি উপত্যকার দুপাশে কাঠের ছোটো ছোটো ঘর। এসব কুঁড়েঘরের সামনে যেসব ফুলের টব, সেগুলো দেখে যে কারো মাথা ঘুরে উঠতে পারে। সেগুলো একাধিক বোমার খোলস জোড়া দিয়ে তৈরি। শুধু কি ফুলের টব? চুলা,পাতিল, কড়াই এমনকি চামচ পর্যন্ত অমন বোমার অবশিষ্টাংশ ভাটায় প্রক্রিয়াজাত করে বানানো হয় এই গ্রামে।
ফুলের টব সাজিয়ে সাজিয়ে বাড়ির যে বাগান করে লাওশিয়ানরা, তার পেছনে দেখা যায় চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করছে কেউ কেউ। এমন জমি আছে টানা তিরিশ কিলোমিটার জুড়ে। গ্রামে একটা মঠ আছে। এর চারপাশের যে অনুচ্চ সীমানা প্রাচীর, সেটিও মিসাইলের তৈরি। অর্থাৎ, উপাসনালয়ে পর্যন্ত সেই বোমাবাজির চিহ্ন।
ইতিহাস কী বলে
১৯৫৫ সালের শেষদিক থেকে ১৯৭৫ সালের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই দশক ধরে দুশো সত্তর মিলিয়নেরও বেশি গুচ্ছবোমা বান নাপিয়া গ্রামের মাটিতে ফেলেছে আমেরিকা। এর এক-তৃতীয়াংশ বোমাই সেই সময় বিস্ফোরিত হয়নি বলে ধারণা করা হয়। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে এসে এখনো এই গ্রামের লোকেরা বোমার আঘাতে পঙ্গু হচ্ছে এমনকি মারাও যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, এগুলো সেই সময়কার অবিস্ফোরিত বোমা।
ষাট এবং সত্তরের দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অজস্র বোমা নিক্ষেপ করেছে পৃথিবীর এই অংশে। ফলশ্রুতিতে, লাওস পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বোমা-আক্রান্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। ব্যাপারটা কী ভীতিকর, তাই না? শরীরের লোম খাড়া হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
বিশেষ করে ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশক সময়কালের মধ্যে লাওসের নিভৃত পাহাড়ে ঘেরা সবুজ গ্রাম বান নাপিয়ায় বোমাবর্ষণ হয়েছে বেশি। পরিসংখ্যানের বিবেচনায় প্রতি আট মিনিটে একটি করে বোমা ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ বহর। এইভাবে প্রতিদিন। প্রতিদিন বোমা ফেলেছে ওরা। নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরের কথা অজানা থাকার কথা নয় কারো। তখনকার তিন চার দিনের তাণ্ডবলীলার চিহ্ন আজো জাপানের জনসাধারণকে বয়ে বেড়াতে হয়। তাহলে ভেবে দেখেন, এক দশক ধরে বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া লাওসের অজগ্রামের সরল মানুষগুলোর মধ্যে কেমন আতঙ্ক বিরাজ করতে পারে?
যুদ্ধকালীন সময় থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ দশকে পঁচিশ হাজারের বেশি মানুষ এসব অবিস্ফোরিত বোমার আঘাতে হতাহত হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু। নিয়তির নির্মমতম পরিহাসকেও এই সত্য হার মানায়।
লোকপেশাগত পরিবেশ
অবিস্ফোরিত বোমা সংগ্রহ করে ঘরগেরস্তের জিনিসপাতি বানানোর এখানকার লোকপেশা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বান নাপিয়া গ্রামের ঐতিহ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে তা গ্রামের লোকের অর্থনৈতিক অবস্থা সেভাবে ফেরাতে পারেনি।
ফলে এটাও সত্য যে, এইসব পরিত্যক্ত বোমা গ্রাম তথা সমগ্র লাওসেরই মানুষের আর্থিক দৈন্যদশার জন্য দায়ী। জীবনের সংশয় নিয়ে কেউ উপার্জনের সন্ধান করতে যাবে না—তাই তো স্বাভাবিক। এক-দুঘর তাঁতি দেখা যায় গ্রামটিতে। চরকার তাঁত। আমাদের দেশের আদি মঙ্গোলিয়ান বংশোদ্ভূত অধিবাসীরা পার্বত্য এলাকায় যেমন চরকায় সুতো কেটে কাপড় বোনে, ঠিক তেমনি।
স্বাভাবিক ধরণের জীবিকা, যেমন– চাষবাস, ঘরগেরস্থালির সহায়ক পরিবেশ ফিরে পেতে আরও ঠিক কত বছরের অপেক্ষা বান নাপিয়াবাসী তা জানে না। তবে এই অপেক্ষাকে কাজে লাগাতেও তারা পেরেছে। শুধু যে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, তা নয়। অলঙ্কারও বানায় তারা। এর মধ্যে আছে হাতে পরার ব্রেসলেট, কানের রিং ইত্যাদি।
বলাবাহুল্য, এসবই পরিত্যক্ত বোমা প্রক্রিয়াজাত করে বানানো। অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে চামচ শিল্পটাই বেশি নজরে আসে। ‘চামচ গ্রাম’ নামে পরিচিতি তৈরি হয়েছে বান নাপিয়ার। এই গ্রামের অধিবাসীরা পুরুষানুক্রমিকভাবে চামচ বানাবার ব্যাপারটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে আসছে।
আগুনের দিন শেষ হবে একদিন
যুদ্ধকেন্দ্রিক পর্যটন স্পট হিসেবে লাওসের বান নাপিয়া গ্রামের নাম উল্লেখযোগ্য। চামচ শিল্পকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্প অল্প পরিসরে হলেও তৈরি হয়েছে। তবে একথা সত্য—পাশের দেশ ভিয়েতনামের মতো পর্যটক এখনও আকৃষ্ট করতে পারেনি লাওস। মাটির রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর গায়ে চামচ শিল্পীর নাম-ঠিকানা লেখা।
যে প্রক্রিয়ায় তারা এইসব পরিত্যাক্ত বোমা সংগ্রহ করে ক্ষুদ্র শিল্পে কাজে লাগিয়ে আয় করছে, তা বেশ ধীর এবং সময়সাপেক্ষ। অভিজ্ঞরা জানান, এভাবে বান নাপিয়া তথা লাওসের শঙ্কামুক্ত হতে একশো বছর লেগে যেতে পারে।
প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুঃসংবাদ। সবই পাঁচ দশক আগের বোমাঘটিত। এতকিছু ঘটে গেছে, ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত পাহাড়ের শান্ত সৌম্য সরল মানুষগুলোর জীবনে। অথচ ওদের জীবন জীবনের নিয়মে ঠিকই চলে যাচ্ছে।
ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের নৈপুণ্যে নিজেদের প্রতিদিনের দুঃখ ভুলে ওরা ঠিকই পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে জীবনের অদ্ভুত জটিলতা। কেউ ওদের দেখতে গেলে হাসিমুখে বসতে দিচ্ছে। আপ্যায়নও করছে। আর দিন গুনছে হয়তো কোনো সুন্দর আগামির।
Feature Image: Photo by Mark Watson/Highlux Photo. References: 01. LAOS: LIVING WITH UNEXPLODED BOMBS, 40 YEARS ON. 02. Turning Bombs Into Bracelets, as Laos Villagers Wait For Safe Land. 03. Turning bombs into spoons – relics of the secret US war in Laos. 04. Spoon Village.