গোটা পৃথিবীতে যে কয়েকটি ধনী পরিবার রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রথসচাইল্ড পরিবার। রথসচাইল্ড ব্যাংকিং ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাধর এক ইহুদি পরিবার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থের সমর্থক শব্দ ছিল এই রথসচাইল্ড পরিবার।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য পরিবার হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে রহস্যময় পরিবারের খেতাবও জুটেছে তাদের কপালে। মুদ্রা বিনিময়কারী এই পরিবার কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলো? এই পরিবারের ইতিহাস নিয়েই আজকের আলোচনা।
রথসচাইল্ড পরিবারের পথপ্রদর্শক
রথসচাইল্ড পরিবারের ব্যাকিং জগতে গোড়াপত্তন শুরু হয় মায়ার আমসেল রথসচাইল্ডের হাত ধরে। মায়ার আমসেল রথসচাইল্ড ১৭৪৪ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটের জুডেনগাসে এক ইহুদি পরিবারে জন্ম নেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৮১২ সালে। ৮ জন সন্তানসহ ৩০ জন পরিবারের সদস্য নিয়ে বসবাস করতেন মায়ার রথসচাইল্ডের বাবা আমসেল মোসেস রথসচাইল্ড।
মায়ার খুব ছোট একটি শহরে তার পরিবারের সাথে বসবাস করতেন। যেখানে ইহুদিদের উপর বেশ কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ইহুদিরা রবিবার রাত্রে বাসা থেকে বের হতে পারতো না। এমনকি খ্রিষ্টানদের ছুটির দিনও তারা রাস্তায় বের হতে পারতো না। এছাড়াও, ২ জনের বেশি দলবদ্ধভাবে ঘোরাফেরা নিষেধ ছিল। পাবলিক কফি শপ, বাগানে ঘোরাফেরাতেও নিষেধাজ্ঞা ছিল।
খুব ছোটবেলায় মায়ার ব্যবসায়িক কাজকর্ম শেখা শুরু করেন। তার বাবা আমসেল মোসেস রথসচাইল্ড পেশায় একজন মুদ্রা সরবারহকারী ও সিল্কের ব্যবসায়ী ছিলেন। মায়ারের প্রধান কাজগুলির মধ্যে ফ্রাঙ্কফুর্টের আধা-বার্ষিক বাণিজ্য মেলার মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা বাছাই করা একটি কাজ ছিল, যা ক্রেতা ও বিক্রেতাদের আকৃষ্ট করেছিল।
মায়ার রথসচাইল্ডের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখনই তার বাবা-মা গুটিবসন্ত হয়ে মারা যান। ১৩ বছর বয়সে তিনি হ্যানওভারে চলে যান এবং বিখ্যাত সাইমন ওলফ ওপ্পেনহেইমার নামক তৎকালীন একটি ব্যাংকিং ফার্মে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করেন এবং খুব অল্প সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরের খুঁটিনাটি রপ্ত করে নেন।
ব্যাংকিং সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন
পরবর্তীতে ১৭৬৩ সালে, ১৯ বছর বয়সে মায়ার পুনরায় ফ্রাঙ্কফুটে ফিরে আসেন এবং ভাইদের ব্যবসায় যোগদান করেন। মায়ার বিরল মুদ্রার ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন এবং হেসের ক্রাউন প্রিন্স উইলহেলমের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন, যিনি মায়ারের বাবার কাছ থেকেও মুদ্রা কিনতেন। এটি ছিল মায়ারের ক্যারিয়ারে অন্যতম একটি টার্নিং পয়েন্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সম্পর্কও ছিল বটে।
প্রিন্স উইলহেলমের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে অভিজাতদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং অন্যান্য আর্থিক সার্ভিস দেয়ার সুযোগও বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, তিনি মুদ্রার ব্যবসাকে একটি নিয়মের মধ্যে আনেন এবং মুদ্রার মানের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে সবার আগে খবর পেতেন। তার এই উথানের জন্যই তিনি নবম উইলহেম, হেসে-কেসের ল্যান্ডগ্রেভ উপাধি গ্রহণ করেন।
১৭৭০ সালে, মায়ার একজন মানি চেঞ্জার এবং কোর্ট ফ্যাক্টরের মেয়ে গুটল শ্যানপারকে বিয়ে করেন। এই দম্পতি দশ সন্তানের জন্ম দেন। তাদের পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে ছিল।
রথসচাইল্ড সাম্রাজ্যের বিস্তার
ফরাসি বিপ্লবের সময় রথসচাইল্ডের ব্যাংকিং সাম্রাজ্যে বিস্তার গড়ে উঠে। মায়ার রথসচাইল্ড অনুধাবন করতে পারেন যে তার পুর্বপুরুষেরা যা যা সম্পদ আহরণ করেছিল তা ধরে রাখতে পারেনি। তাই তিনি একটি সুদূর প্রসারি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
মায়ার সেই সময় মার্চেন্ট ব্যাংক খোলার জন্য তার বড় ছেলেকে জার্মানিতে নিজের কাছে রেখে দেন এবং বাকি চার সন্তানকে তার ৬০ হাজার পাউন্ড দিয়ে তারই ইউরোপীয় নেটওয়ার্কের অন্যান্য জায়গায় পাঠিয়ে দেন। জেমস রথসচাইল্ড প্যারিসে, সোলমান রথসচাইল্ড ভিয়েনায়, কার্ল ইতালির ন্যাপ্লসে এবং সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত এবং কর্মঠ ছেলে নাথানকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন।
ইনভেস্টপেডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, নাথান ছিল মায়ার রথসচাইল্ডের চতুর্থ ছেলে। তিনি লন্ডনে টেক্সটাইল ব্যবসা শুরু করেন। এরপর লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার কেনাবেচা শুরু করেন। ইতোমধ্যে এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সনস লিমিটেড নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাংকের মাধ্যমে সেই সময় যুদ্ধে সরকারকে অর্থায়ন করা হতো। ১৮১১ সালে নেপোলিয়নের সঙ্গে যখন ইংল্যান্ডের যুদ্ধ হয়, দারুণ চতুরতার পরিচয় দেন নাথান।
১৭৯০ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপের অবস্থার অবনতি হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ক্ষমতায় আসেন। ইউরোপ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সকল যুদ্ধেই রথসচাইল্ডদের সম্পৃক্ততা ছিল। তারা যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ করতো। দুই পক্ষকেই আর্থিকভাবে সহায়তা করতো নাথান রথসচাইল্ড। তারা যুদ্ধের আগে যত পারতো স্বর্ণ কিনে রাখত। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হত, যুদ্ধের পর তত বেশি দামে বিক্রি করতো।
ওয়াটার লু যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে খবর আসে, নেপোলিয়ন হেরে গিয়েছেন যা রাজা মোটেও বিশ্বাস করেননি। তবে এই খবর কাজে লাগান নাথান রথসচাইল্ড কারন তার ক্যাল্কুলেশন অনুযায়ী বন্ডের মূল্য ২ বছর পর অনেকগুনে বৃদ্ধি পাবে। তাই প্লান অনুযায়ী তিনি তার সব বন্ড বিক্রি করে দেন এবং গুজব ছড়ান যে, ইংল্যান্ডের অবস্থা খুবই খারাপ, সরকারের বন্ড মূল্যহীন হয়ে যাবে। সবাই হুড়মুড় করে তখন বন্ড বিক্রি শুরু করে।
একদিনে ধসে পড়ে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ। নাথান নিজের এজেন্ট নিয়োগ করে সব বন্ড পুনরায় কম দামে সংগ্রহ করে নেন। যুদ্ধে জিতেছে ইংল্যান্ড—এটা জানার আগেই ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় নাথানের ব্যাংক এবং পরবর্তীতে ১ বছর বন্ডের মূল্য ৪০% বৃদ্ধি পায়, ২ বছর পর আরও বেশিগুনে বেড়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই যুদ্ধে ধার করা অর্থ ২০০ বছর ধরে রথসচাইল্ড পরিবারকে পরিশোধ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। এককালের মুদ্রা বিনিময়কারী পরিবারটি মুদ্রা সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করল। ইউরোপ থেকে মার্কিন মুল্লুক এমনকি ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে রথসচাইল্ড কার্টেল গড়ে উঠে।
১৮২৪ সালে, নাথান রথসচাইল্ড এবং মোসেস মন্টেফিওর অ্যালায়েন্স অ্যাসিউরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে আরএসএ গ্রুপের অংশ। একই বছরে, পর্তুগাল থেকে ব্রাজিল আলাদা হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। এইদিকে স্বাধীনতা লাভের পরেও পর্তুগালের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে ব্রাজিলের, কারণ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে তারা তখনই ব্রাজিলের পক্ষে সম্মতি দিবে যখন তাদের সাথে পর্তুগালের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে।
এই মুহুর্তে নাথান রথসচাইল্ড ১৮২৫ সালে ঋণ সহায়তা দিলেন ব্রাজিলকে এবং এভাবেই তাদের স্বাধীনতা পর্তুগাল হতে সুরক্ষিত করতে সক্ষম হলেন। শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণের চুক্তির টাকাই নয় বরং রেলপথ এবং দেশের কাঠামো পুনর্গঠনেও সেই সময় এই অর্থ ব্যাপক সাহায্য করে।
এন এম রথসচাইল্ড এবং তার পুত্রগণ এখনো তাদের কার্যকালাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে, ১.৮৭ বিলিয়ন পাউণ্ড রাজস্ব এবং ৭৬ বিলিয়ন ইউরো ব্যবস্থাপনার অধীনে সম্পদ ছিল। ১৮৩৫ সালে, নাথান স্পেনের পারদ খনিগুলো দখল করে নেন। এছাড়াও, রাসায়নিক উপাদানের উপর বিশ্বে একচেটিয়া অধিকার লাভ করেন, যা সোনা ও রুপা পরিশোধনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এখন কেমন আছে রথসচাইল্ড পরিবার
রথসচাইল্ড পরিবারের জৌলুশ যুদ্ধ, রাজনীতি এবং পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গত ১০০ বছরে কমিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন কারণে নেপলস, অস্ট্রিয়া ও ভিয়েনায় বন্ধ হয়ে যায় রথসচাইল্ড ব্যাংকের শাখা। বর্তমানে এই পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি ডলার।
Feature Photo: rothschildfoundation.eu References: 01. Rothschild family. 02. A History of the Rothschild Family. 03. The Rothschild Family. 04. History-Rothschild.