তিব্বত: এক নিষিদ্ধ দেশের ইতিহাস

702
1

পৃথিবীতে কত দেশই তো আছে, কত দেশ নিজেদের রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। এমনও কিছু দেশ আছে যাদের অদ্ভুত কিছু কারণের জন্য তারা বিখ্যাত হয়ে পৃথিবীর বুকে চিরকাল রাজ করছে এবং করবে। তেমনই এক অদ্ভুত দেশের নাম তিব্বত। এই দেশটি মূলত নিষিদ্ধ দেশ নামেই পরিচিত। তবে কেন নিষিদ্ধ তার পেছনে রয়েছে হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস। চলুন জেনে নেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পেছনে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস।

তিব্বত দেশটি মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। তিব্বত অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। এই দেশটিকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর ছাদ। কেননা এর উচ্চতা প্রায় ১৬,০০০ ফুট। চীনের অতি প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই দেশটি বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। এই দেশটিতে ভারত এবং চীনের মতোই দুটি অতি প্রাচীন সভ্যতার বিস্তার ঘটে।

তিব্বত চীনের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে অবস্থান করে আসছে। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে যে, ১৯১২ সাল নাগাদ চীনের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তিব্বতকে একটি স্বাধীন দেশ বা রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়। তিব্বতের রাজধানী লাসা। লাসা নামের অর্থ দেবতাদের ভূমি। তবে তিব্বতের বর্তমান পরিচয় চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। আর যার কারণে তিব্বতীয়দের ভাষা চীনা ভাষা। এর আয়তন সম্পর্কে ধারণা করা যায় যে, এটি প্রায় ১২,২৮,৪০০ বর্গ কিলোমিটার।

যদিও এই দেশকে সবাই বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃতির দেশ হিসেবেই জেনে থাকেন, কিন্তু শুধুমাত্র তিব্বতীয় সংস্কৃতি নয়; বরং মঙ্গোল ও মাঞ্চু জাতীর সংস্কৃতিতেও এরা বেশ এগিয়ে। তিব্বতীয়দের সাম্রাজ্য নিয়ে হাজার হাজার ইতিহাসের কথা চলে আসলেও এর বেশ কিছু ইতিহাস বেশ আলোচিত।

Tibet map
এনিমেটেড ম্যাপে তিব্বত। Image Source: besopkentibetan.com

যে কারণে তিব্বত একটি নিষিদ্ধ দেশ 

এত এত ইতিহাস কিংবা সংস্কৃতির মাঝেও এই দেশটি নিষিদ্ধ দেশ হিসেবেই পরিচিত। রহস্যের বেড়াজালে ঘেরা এই তিব্বত দেশটি এক অদ্ভুত কারণেই নিষিদ্ধ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে রাজ করে চলেছে। তবে এই দেশটির সম্পূর্ণ অংশই নিষিদ্ধ নয়, কেবলমাত্র দেশটির রাজধানী লাসাকেই নিষিদ্ধ বলা হয়ে থাকে।

তবে বিশ্বের সবাই পুরো তিব্বতকেই নিষিদ্ধ বলে জেনে এসেছে। এদেশের লোকজনেরা নিজেদের নিষিদ্ধ দেশের নাগরিক হিসেবে বেশ গর্ববোধও করে থাকেন। এই দেশটি অন্যান্য দেশ থেকে অনেক বেশি শান্তিপ্রিয়। হিমালয়ের বরফে ঢাকা তিব্বতের নাগরিকেরা নিজেদের দেশ সম্পর্কে বাইরের কোন জগতে বলতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করেন না। এরা সাধারণত রহস্যের বেড়াজালে থাকতেই বেশি পছন্দ করে থাকেন। আর তাই প্রায় শত শত বছর ধরেই আড়ালে থেকে গেছে এই দেশের নাম, দেশটির অন্যান্য ইতিহাস।

যেহেতু এটি চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, তাই এটিকে কোন নির্দিষ্ট করে আলাদা দেশ হিসেবেও কখনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এখানকার লোকজন, সংস্কৃতি সব কিছুই অন্য দেশ থেকে বেশ আলাদা। রোমাঞ্চকর এই দেশটির নাগরিকদের জীবনও তাই অনেক বেশি রোমাঞ্চকর এবং এদের জীবনযাত্রা বেশ ভিন্ন।

যদিও এটি চীনেরই একটি অংশ, তবুও এটা অনেকেই মানতে নারাজ। আর এই কারণেই ১৯৬৯ সাল নাগাদ তিব্বতিরা দালাইলামা নামক এক ব্যক্তি যিনি এদেশের ধর্মগুরু হিসেবে পরিচিত তার নেতৃত্বে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। যদিও সেটা আন্দোলন হিসেবেই চালানো হয়। আর তাদের এই আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। এতকিছুর পরে তিব্বত নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে মূলত এর প্রাকৃতিক পরিবেশ, এদের জীবনযাত্রা ইত্যাদি প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।

তিব্বতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চিত্র। Image Source: theguardian.com

এছাড়া, এদেশের নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে আরও একটি সূক্ষ্ম কারণ খতিয়ে দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, তিব্বত বছরের প্রায় ৮ মাস বরফে ঢাকা থাকে। যার কারণে এটি ধীরে ধীরে দুর্গম স্থান বলেই বিবেচিত হচ্ছে। এই দেশটি আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উঁচু স্থানে অবস্থিত, আর এত উচ্চতার কারণে এখানে নিঃশ্বাস নেয়াও বেশ কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই দেশের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৬ হাজার ফুট উপরে! প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং এই উচ্চতার জন্যে এই দেশে বসবাস করা বেশ কষ্টের।

বিভিন্ন কারণে এদেশে পর্যটকরা প্রবেশ করতে পারেন না। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ খারাপ এবং এদেশের আবহাওয়াও তেমন সুবিধার না। ঠাণ্ডার কারণে প্রায় সারা বছরই এটি বরফে ঢাকা থাকে, আর তাই পর্যটকেরা এলেও সুবিধা করে উঠতে পারেন না। আর তাই অন্যান্য দেশে পর্যটকদের ভীর থাকলেও এখানে পর্যটকেরা আসতে তেমন আগ্রহ দেখায় না।

এই সকল কারণে এদেশে এক সময় ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। যদিও ১৯৮০ সালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্তের পরপরই বিশ্বের অনেকেরই এই দেশ সম্পর্কে আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। তিব্বতের অদ্ভুত এই ব্যাপারগুলোই যেন অন্যান্য দেশের নাগরিকদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। তবে এক সময় পর্যটকসহ সাংবাদিক পর্যন্ত প্রবেশে বেশ কড়াভাবেই নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর নিষিদ্ধ দেশের জনপ্রিয়তা যেন আরও বাড়তেই থাকলো!

তিব্বতের রাজধানী লাসায় দীর্ঘদিন বাইরের নাগরিকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল, যার কারণে বিশ্বে এদেশের ইতিহাস বা পুরো রাজ্যটিই রহস্যের আড়ালে থেকে যায়। কি আছে লাসা কিংবা তিব্বতে তা জানার জন্য মানুষ দিন দিন কৌতূহলী হয়ে উঠে। লাসা শহরে ‘পোতালা’ নামক এক বিশাল প্রাসাদ আছে, যা বাইরের নাগরিকেরা প্রথম দেখার সুযোগ পান ১৯০৪ সালে। এই প্রাসাদটি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে এর ছবি এবং এর টুকটাক ইতিহাস সম্পর্কে কিছু লেখা ছাপানো হয় আমেরিকার এক বিখ্যাত পত্রিকায়।

Tibet famous building
লাসার পোতালা প্রাসাদ। Image Source: brittanica.com

তিব্বতকে নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে। তিব্বতে কারো মৃত্যু হলে তাকে তার মৃত্যুর সাথে সাথেই সৎকার করা হয় না! তিব্বতীয়রা আত্মায় প্রবল বিশ্বাসী। তাদের ধারণা মতে, মানুষের আত্মা মরে যাওয়ার পরেও এই জগতে বিচরণ করতে থাকে। আর তাই যে পর্যন্ত তাদের আত্মা জগৎ ত্যাগ না করে সে পর্যন্ত তারা সেই মৃতের সৎকার সম্পন্ন করেন না! আর ততক্ষণ সেই মরদেহ তাদের বাসাতেই অবস্থান করে।

তাদের মধ্যে এটিও প্রচলিত আছে যে, তাদের প্রধান দালাইলামা এক অলৌকিক ধ্যানে তাদের নতুন দালাই লামার ছবি আঁকতে পারেন। আর এরপরই শুরু হয় তিব্বতের প্রতিটি ঘরে গিয়ে সেই নতুন দালাই লামা অর্থাৎ নতুন শিশুকে খুঁজে বের করার প্রথা।

এছাড়া, এদের কেউ মারা গেলে এরা সাধারণত আত্মার সৎকার হিসেবে এক ভিন্ন পূজা করে থাকেন। তাদের ধারণা, সেই মৃত ব্যক্তিটি মরে যাওয়ার পর যে কোনো রূপে যে কারো উপর ভর করতে পারে। আর এখান থেকেই বোঝা যায়, তিব্বতীয়রা সংস্কৃতি বা কুসংস্কারের দিক থেকে বেশ বিশ্বাসী।

Tibet people
তিব্বতের ধর্মযাজক ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের ছবি। Image Source: ANI Photo

তবে তাদের এই অদ্ভুত সংস্কৃতি বা তাদের পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদি ছাড়িয়ে গেছে তাদের একটা ইতিহাসেই আর সেটা হচ্ছে নিষিদ্ধ দেশ! এই চমৎকার হিমালয়ের দেশে কার না ঘুরে বেড়াতে মন চাইবে? তবে এত সুন্দর, মনোরম দেশটি আজো পরিচিত এক নিষিদ্ধ দেশ হিসেবেই!

Feature Image: Xinhua/globaltimes.cn
References:

01. the History of Tibet of China.  
02. Tibet, autonomous region, China.

1 COMMENT

  1. তিব্ব্ত প্রাকিতিক দিক হতে অপরুপ এবং অনন্য। নিসিদ্ধ বলে প্রচার পাওয়ার দিকটা মুলত প্রকাশ পায় বিভিন্ন বই এবং গল্পের কারনে। তিব্বতএখনো হয়তো গ্লোবালাইজেশনের পুরোপুরি স্বদব্যাবহার করেনি বা সাচ্ছন্দ্য বোধ করেনা। নিজেদের গুটিয়ে রাখতেই বোধহয় তারা বেশি পছন্দ করে। তাদের পর্যটন সেক্টর সয়ংসম্পুর্ন নয় এবং ঝুকিপুর্ন হওয়ার কারনে হয়তো টুরিস্ট যাতায়াত নিসিদ্ধ্য ছিলো, এবং এই সুযোগটাই পস্চিমা বিশ্ব কাজে লাগিয়ে একের পর এক গল্প কাহীনি এবং রহস্য তৈরি করে তুলেছেন যার কারনে সরাব মনে টার্মটা গেছে গেছে। “নিষিদ্ধ্য তিব্বত”। এর পুরোটাই নিজস্ব মতামত।

    লেখিকা সাবলিল ভাষায় ভালোভাবেই নিষিদ্ধ্য তিব্বতের নিষিদ্ধ্য হবার ঘটনা তুলে ধরেছেন। সাধুবাদ তাকে।