বিশ্বের বিখ্যাত যত সেতু

765
0

সেতুর সৌন্দর্য কি পুরোপুরি আমাদের কল্পনায় বন্দি করা সম্ভব? কখনো কখনো তা সম্ভব হয় কারণ তা শহরের একটি ধারা বর্ণনা করে। ছোট ছোট গ্রাম এবং শহরসমূহকে সংযুক্ত করে এবং সময়ের পরিক্রমায় নিজের অস্তিত্বকে আমাদের সামনে জানান দিয়ে থাকে এক একটি সেতু। সবকিছু চাপিয়ে একটি সেতু সেই সকল কারিগরদের স্থপতির প্ৰতীক হয়ে দণ্ডায়মান থাকে যা যে সকল কারিগর তাদের পরিশ্রম দিয়ে এটি তৈরি করেছেন। তাই সেতু কোন ভিউ পয়েন্ট এর অংশ নয়। কারণ সেতু নিজেই একটা সৌন্দর্যের প্রতীক। 

তাই, সেতু সবসময়ই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যেমন করে সহজ তেমনই করে দৃষ্টিনন্দন এক দেখার জায়গা হিসেবে। আর সেজন্যই পর্যটকরা ছুটে যায় পৃথিবীর নানান প্রান্তে থাকা বিভিন্ন সেতু পরিদর্শনে। সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেরা কিছু সেতু নিয়েই আজকের আলোচনা। চলুন তাহলে দেরি না করে শুরু করা যাক। 

গোল্ডেন গেইট ব্রীজ 

সারা পৃথিবীতে যদি সবচেয়ে আকর্ষণীয় কোন সেতু থেকে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে যে নামটি সবার আগে আসবে তা হলো গোল্ডেন গেইট ব্রীজ। সারা বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ফটোগ্রাফার তাদের লেন্স নিয়ে হাজির হয় এই অদ্ভুত সুন্দর সেতুটির সৌন্দর্য নিজের ক্যামেরায় ক্যামেরা বন্দি করে নিতে। সান ফ্র্যান্সিস্কোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি সেতু হলো এই ব্রীজটি। ১৯৩৭ সালের দিকে প্রায় অনেক মানুষ ধারণা করেছিল যে এই সেতুটি নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু যখন লোহার কাঠামো স্থাপন শুরু হলো তখন ধীরে ধীরে সকলে বিশ্বাস করতে লাগলেন যে, এখানে কিছু একটা তৈরি করা সম্ভব হবে। 

গোল্ডেন গেইট ব্রীজ। Image Source: Ventdusud/Getty Images

এই সেতুটি কলম্বিয়া রাজ্যের অসাধারণ সৌন্দর্যের একটি প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও, সারা বিশ্বের বর্তমান সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম এক আশ্চর্য হল এই সেতু। গোল্ডেন গেইট ব্রীজের দুই টাওয়ারের মাঝে একটি ট্রেডমার্ক আছে যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যা এক ধরণের নির্দেশক হিসেবে বিদ্যমান। এটিকে স্থানীয় ভাষায় ‘ইন্টারন্যাশনাল অরেঞ্জ’ বলা হয়। যা সমুদ্র এবং আকাশের মাঝে সংযোগের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। 

টাওয়ার ব্রীজ  

বিশ্বের অন্যান্য বিখ্যাত সেতুর মতোই টাওয়ার ব্রীজও অনিন্দ্য সুন্দর এক স্থাপনা হিসেবে বিবেচ্য। এটি ১৮৯৪ সালে তৈরি করা হয়েছে যা ভিক্টোরিয়ান ব্রিজ এবং নিউ গোথিক এর মাঝে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব বেশ গর্বের সাথে জানান দিচ্ছে সকলের সামনে। এই ব্রিজের মধ্যে একটি ঘড়ি দেওয়া হয়েছে যা লন্ডারিং পার্লামেন্ট, স্কাই-লাইন এবং বিগবেনেও ব্যবহার করা হয়েছে। 

টাওয়ার ব্রীজ। Image Source: mywomo.net

এই সেতু পুরোপুরি পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও, এই সেতুর রয়েছে কনভার্টিবল স্পেস। যা একদিকে জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় আবার যা লন্ডন সিটির দুই প্রান্তের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। তাই এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতি বছর লন্ডন এবং তার বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু পর্যটক ভ্রমণে আসে। 

সিডনি হারবার ব্রীজ 

স্থানীয়দের কাছে এটি ‘কোট হাঙ্গার ‘নামে পরিচিত। সিডনি হারবার ব্রিজটি সারাবিশ্বের স্টিলের তৈরি সবচেয়ে বড় সেতু হিসেবে খ্যাত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ১৯৩২ সালের দিকে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এটি সিডনির সেন্ট্রাল বিজনেস এর সাথে নর্থ স্টোরের সাথে সংযোগের স্বার্থে নির্মাণ করা হয়েছে।

সিডনি হারবার ব্রীজ। Image Source: unsplash.com

এই সেতুটির নির্মাণের কারুকার্যের জন্য সারা বিশ্বব্যাপী নিজের সুখ্যাতি ছড়িয়েছে। তাই, এই সেতুটি প্রতিবছর নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য স্থানীয়দের কাছে বেশ পরিচিত এবং সমাদৃত। কারণ, এখানে বসে নিউ ইয়ারের জমজমাট আসর। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য হাজির হয় এই সেতুতে। 

পন্টি ভেকাচিও 

দ্য পন্টি ভেকাচিও একটি মার্ডেবল ব্রিজ যা অর্ণ নদীর উপর ফ্লোরেন্সে অবস্থিত। এটি ফ্লোরেন্স শহরের একমাত্র সেতু যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও একদম সগৌরবে টিকে আছে বছরের পর বছর ধরে। সেতুটি তার মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন দোকানের জন্য বেশ বিখ্যাত। বেশ কিছু জনপ্রিয় স্টোর বিদ্যমান রয়েছে এই সেতুটিতে।

পন্টি ভেকাচিও। Image Source: italyperfect.com

বিভিন্ন স্বর্ণের, শিল্পের দোকান রয়েছে এই সেতুতে। মূলত এই সেতু অর্থনীতি খাতেও বেশ অবদান রাখতে সক্ষম। যখন কোন দোকানদার তার দোকান এর ভাড়া পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তখন টেবিল বসিয়ে সে দোকানটি নিলামে বিক্রি করে দেয়। আর এই সংস্কৃতি বছরের পর বছর ধরে চলছে এই ব্রীজে। 

দ্য মিলাউয়ো ব্রীজ  

আরেকটি জনপ্রিয় সেতু হচ্ছে দ্য মিলাউয়ো ব্রিজ। এই সেতুটি একটি ক্যাবল স্টয়েড রোড ব্রিজ যা স্পেন্ড ভ্যালির নদীর উপর দক্ষিণ ফ্রান্স এর মিলাউয়ো শহরে অবস্থিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেতু হিসেবেও খ্যাত। দৈর্ঘ্য প্রায় আইফেল টাওয়ার থেকেও বেশি বড় হবে। 

মিলাউয়ো সেতু। Image Source: adobe.stock.com

এটি আইফেল টাওয়ার থেকে প্রায় ৩৪৩ মিটার উঁচু একটি সেতু। এই সেতুতে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার ঘন্টার বেগে যানবাহন পার হতে হয়। কারণ ব্রিজে ট্র্যাফিক কিছুটা স্লো থাকে। কারণ পর্যটকরা ছবি তোলার উদ্দেশ্যে এই সেতুটি ভ্রমণ করে থাকে। কারণ এই সেতুটির অসাধাৰণ সৌন্দর্য পর্যটকরা ক্যামেরা বন্দি করে তাদের সাথে নিয়ে যেতে বার বার ছুটে আসে এখানে। 

দ্য রিয়ালটো ব্রীজ 

ইতালির ভেনিসে দ্য গ্রেট ক্যানেলের মধ্যে যে চারটি ব্রিজ অবস্থিত তার মধ্যে অন্যতম হলো দ্য রিয়ালটো ব্রিজ। ক্যানেলের মধ্যে চলমান সবচেয়ে পুরনো একটি সেতু হলো এই ব্রীজটি। এটি পাথরের তৈরি। এই সেতুটি এন্টোনিও দ্যা পন্টি ডিজাইন করেছেন। সেতুটির মেরামত কাজ শেষে হয় ১৫৯১ সাল।

দ্য রিয়াল্টো ব্রীজ। Image Source: venicetour.com

কিন্তু সেতুটি তৈরি হবার পূর্বে ১৫২৪ সালের দিকে এই স্থানে একটি কাঠের তৈরি ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি নির্মাণের পর আধুনিক আর্কিটেকচারের প্রতীক হিসেবে দণ্ডায়মান হলো এই ব্রীজটি। তাই এই ব্রীজটি সকলের কাছে ভেনিসে অবস্থিত আর্কিটেকচারের প্রতীক হিসেবে দণ্ডায়মান।  

ব্রুকলিন ব্রীজ  

ব্রুকলিন ব্রীজটি ১৮৮৩ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এই সেতু ম্যানহেটেন এবং ব্রুকলিনকে নদীর পশ্চিম দিকের সাথে সংযুক্ত করেছে। একসময় বহু বছর ধরে এটি পুরোপুরি অদৃশ্যমান ছিল। এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্রুকলিন ব্রীজ তাই একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিত যা নিউইয়র্কে অবস্থিত।  

ব্রুকলিন ব্রীজ। Image Source: brittanica.com

১৯৬৪ সালের দিকে এই সেতুটি জাতীয় পর্যটন শিল্প হিসেবে আখ্যা পায়। এই সেতুর মধ্যে সাইক্লিস্টসহ পেডিট্রিয়াসদের চলাচলের জন্য আলাদা পথ রয়েছে। একটি ট্রেল ব্যবহার করা হয়েছিল যা দুর্গম আবহাওয়ার পরিস্থিতিতে নদী পার হওয়ার কষ্টসাধ্য হয় তার জন্য। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার সময় যা কাজে লাগে।  

চার্লস ব্রীজ  

১৩৩৭ সালের দিকে, চার্লস (চতুর্থ) পিটার পার্লারটিকে ১২ তম জুডিথ ক্ষেভেটি ব্রীজ করার জন্য নিযুক্ত করেন। যা ১৩৪২ সালের বন্যায় প্রায় ভেসে গিয়েছিল। নতুন ব্রীজটি ১৯৩০ সালের দিকে পরিপূর্ণ তৈরি করা হয় এবং সেই ব্রীজটিকে চার্লস ব্রীজ নামে পরিচিত। চার্লস ব্রিজটি ৩০টি স্ট্যাচু দিয়ে উভয় পাশে সজ্জিত। যার মধ্যে বেশিরভাগ ১৭০৬ এবং ১৭১৪ সালের দিকে তৈরি। ১৪ শতাব্দীতে প্রথম চার্লস সেতুটি মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। বার্ন-কুইক এর স্ট্যাচু ১৫০৩ সালে নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেই ধংসাবশেষগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। যা অনেকের কাছে চার্লস ব্রীজের রেপ্লিকা হিসেবে পরিচিত। 

চার্লস ব্রীজ। Image Source: timeout.com

পাথরের তৈরি একটি জনপ্রিয় ব্রীজ হিসেবে সর্বদেশে পরিচিত চার্লস ব্রীজ। বর্তমানে প্যারাগুয়ের অন্যতম একটি পর্যটন স্থান হলো চার্লস ব্রীজ। তবে সেতুটি শুধুমাত্র দর্শনার্থীদের জন্য নয়। বরং এই সেতুটি প্যারাগুয়ের আর্টিস্টদের কাছে, স্ট্রিট মিউজিসিয়ানদের কাছে এবং অন্যান্য পারফর্মারদের কাছে বেশ জনপ্রিয় একটি স্থান।  

ইয়ংজি ব্রীজ 

ইয়ংজি ব্রীজটি (এলাকাবাসীর কাছে ওয়াইল্ড এবং রেন ব্রীজ হিসেবে খ্যাত) ১৯১৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতুটি চীনের চেংয়াং, সানজিয়াং, লাইজও এর কাছে অবস্থিত। ঢং বাসীর কাছে একটি জনপ্রিয় ব্রীজ হিসেবে এই সেতু বেশ পরিচিত। এই সেতুটি লিংজি নদীর কাছে নির্মাণ করা হয়েছে। যা পুরোপুরি বাঁশ এবং পাথরের তৈরি।  

ইয়াংজি ব্রীজ। Image Source: wikimedia.com

ইয়ংজি ব্রিজটিতে দুটি প্লাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। একটি ব্রিজের শেষের দিকে, ৩টি অগ্রভাগে, ৩টি পিছনের দিকে, ৫টি প্যাভিলিয়নে, ১৯টি বারান্দায় এবং ৩টি ফ্লোরে। এর উপরের স্ট্রাকচার সম্পূর্ণভাবে বাঁশ এবং পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এই ব্রীজটি সম্পূর্ণভাবে ৬৪.৪ মিটার দীর্ঘ, ৩.৪ মিটার প্রস্থ। এই সেতুটি দুটি ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলকে সংযোগের স্বার্থে বিনির্মাণ করা হয়েছে। 

চ্যাপেল ব্রীজ 

চ্যাপেল ব্রীজটি ২০৪ মিটার দীর্ঘ এবং রেইস নদীকে অতিক্রম করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি ইউরোপে অবস্থিত কাঠের তৈরি সবচেয়ে পুরানো একটি সেতু। যা সুইজারল্যান্ডের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ১৯৩৩ সালে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। 

চ্যাপেল ব্রীজ। Image Source: istock.net

ব্রীজটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল লুক্রেইনকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। ১৭ শতকের ঐতিহ্যকে নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এই সেতুটি। ১৯৩৩ সালের দিকে আগুনে বেশিরভাগ পেইন্টিং ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যা পরবর্তীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।  

 

Feature Image: insider.com
References:

01. www.tripzilla.com.
02. www.touropia.com.
03. www.tourconsel.com.