ইসলামিক ক্যালেন্ডারের নবম মাস হলো রমজান। পুরো এক মাস ভোর রাতে সেহরি খাওয়া থেকে শুরু করে সারাদিন রোজা রেখে পরিবার পরিজন, আত্মীয়, বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যায় ইফতার করা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত মুসলিমরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় যেন এক সুতোয় বাঁধা থাকে।
সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও ইউরোপের কিছু দেশে মুসলিমদের একটি বড় সংখ্যা অবস্থান করছে। বলকান অঞ্চলের পাঁচটি দেশে মুসলমানদের সর্বাধিক অংশ রয়েছে। কসোভো, আলবেনিয়া এবং বসনিয়ায় মুসলিমদের অবস্থান সর্বোচ্চ। এছাড়া, পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এবং বেলজিয়ামে মুসলমানদের সর্বাধিক অংশ রয়েছে।
রমজানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো ইফতার। সারাদিন রোজা রেখে বিভিন্ন ধরনের খাবার দিয়ে ইফতার শুরু হয়। স্থান, সময় আর নিয়ম বিশেষে এর তারতম্য হয় বৈকি। তবে, পানি অথবা ফলের রস, খেজুর, বিভিন্ন ফল এবং স্থানভেদে বিখ্যাত মজাদার খাবার দিয়ে ইফতারের প্রস্তুতি চলে বিভিন্ন দেশে। আজ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের ইফতার আয়োজন নিয়ে আলোচনা হবে।
ফ্রান্স
ফ্রান্সে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম রয়েছে। এদের মধ্যে আছে ফরাসি নাগরিক এবং বিদেশি (উত্তর আফ্রিকান, আফ্রিকান, তুর্কি এবং এশিয়ান)। সাধারণত, ইফতারের মাঝে থাকে ফ্রান্সের বিখ্যাত খাবার, জুস এবং ডেজার্ট।
রোজাদারদের অনেকেই বাড়িতে ইফতার তৈরি করার সময় পান না বলে প্রায়ই রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে ইফতার সারেন রোজাদাররা। ফলে প্যারিসের বেশ কিছু লেবানিজ রেস্টুরেন্ট ইফতার পরিবেশন করে বেশ জাঁকজমকভাবেই। তাছাড়া, মুসলিম মালিকানাধীন অনেক প্যারিসিয়ান ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁতে রোজাদাররা জড়ো হয় স্যুপ এবং কুসকুস দিয়ে তাদের রোজা ভাঙতে। একইসাথে পুদিনা চা খেতে খেতে আরবি গান শুনে একটু বিনোদনও নেয় সারাদিনের ধকল শেষে।
কিছু সুপারমার্কেট রমজানের পণ্য যেমন আলজেরিয়ান “চোরবা” স্যুপ এবং মরক্কোর “হারিরা”, খেজুর, বাদাম এবং শুকনো ফল, মিষ্টি এবং পেস্ট্রির একটি পৃথক অংশ রাখে।
আলবেনিয়া
আলবেনিয়াতে নানা ধরনের ঐতিহাসিক রীতিনীতি মেনে রমজান মাস পালিত হয়। যেমন, রোজার শুরুতে এবং শেষে একটি ঐতিহ্যবাহী গান গাওয়া হয়। এছাড়া রয়েছে বিখ্যাত কিছু ইফতার আয়োজন।
যেমন – ‘বাইরেক’ এটি মাংস, পালং শাক বা দই দিয়ে তৈরি একটি মচমচে পেস্ট্রি পাই। যা গরম বা ঠান্ডা যে কোন অবস্থাতেই খাওয়া যায়। এরপর রয়েছে ‘পেস্টিক’ যেটা পাস্তা, দুধ, পনির, ডিম এবং মাখন দিয়ে তৈরি করা হয়।
আরো আছে জ্যাম, ক্রিম সস বা পনিরে ভরা একটি মিষ্টি, সুস্বাদু রুটি যা ‘পেটুল্লা’ নামে জনপ্রিয় এবং সাথে আছে রসুন-মিশ্রিত বেগুনের একটি খাবার যা ‘ইমাম বেইলাদি’ নামে পরিচিত।
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা
মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত ইউরোপের বসনিয়ায় দেশীয় ঐতিহ্য এবং নিয়ম অনুযায়ী পালন করা হয় পবিত্র রমজান মাস। ইফতার বা রোজা ভাঙতে তারা বেছে নিয়েছে ঐতিহাসিক হলুদ দুর্গ যা বসনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। সেখান থেকে আযান এবং কামান (খাওয়া শুরু করার সংকেত) পুরো শহর জুড়ে শোনা যায়।
বসনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত খাবার ‘সোমুন’ নামক পেস্ট্রি। যা কেউ কোনভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না। এটি গোলাকার, মশলাদার এবং এর সাথে থাকে কিছু কালোজিরা। সোমুন বেক করার সময় চারদিকে যে চমৎকার গন্ধ ছড়ায়, তার জন্য বছরজুড়ে সবাই অপেক্ষা করে।
তারপর আছে ‘টোপা’ নামের একটি খাবার যা পনির, মাখন, ডিম এবং সোমুনের মতো কিছু অতিরিক্ত দুধ থেকে তৈরি উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। এটি ইফতারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে পরিণত হয়েছে। সোমুনের টুকরো টোপায় ডুবিয়ে খাওয়া হলো ঐতিহাসিক রীতি।
বসনিয়ার ইফতার টেবিলে সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু খাবারের মধ্যে আরও রয়েছে পিটা রুটি, বাঁধাকপির পুর ভরা টার্কি, সালাদ, কাবাব, মাংস বা আলু দিয়ে তৈরি পাই, পনির এবং পালং শাক।
ইফতার এবং তারাবির নামাজের পর, কফি শপগুলো শহরের মানুষ এবং বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের জন্য তাদের দরজা খুলে দেয়। বসনিয়ানদের আলাদা করার প্রধান জিনিসগুলোর মধ্যে একটি হল এদের কফি প্রীতি। অটোমানদের সময় থেকে তারা কফির সাথে পরিচিত, যা এখন জাতীয় পানীয়তে পরিণত। এমনকি প্রতিটি পরিবারের কাছে কফি ভাঙার এবং তৈরির ম্যানুয়াল কপার ডিভাইসও রয়েছে।
উত্তর মেসিডোনিয়া
উত্তর মেসিডোনিয়ার মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। তবে, রমজান এখনও সরকার এবং অমুসলিম জনসংখ্যা উভয়ের দ্বারা একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় উৎসব হিসাবে বিবেচিত হয়। মুসলিম পরিবারগুলো রমজানের বাইরে সাধারণত পরিবেশন করা হয় না এমন খাবার, যেমন বাকলাভা, পাচা, খেজুর, দই এবং সোমুন রুটি পরিবেশন করে ইফতারে।
স্পেন, বার্সেলোনা
রমজান মাসে রাভালের বার্সেলোনা পাড়া অনেকটাই বদলে যায়। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসতেই নান, সমুচা, খেজুর এবং মরক্কোর মিষ্টির ব্যাগ নিয়ে পুরুষরা রাস্তায়, রেস্তোরাঁতে ঘুরে বেড়ায়। মসজিদে একত্রে ইফতার করা ছাড়াও, বার্সেলোনার মুসলিম অভিবাসীদের আনন্দ লাভ এবং সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধির আরও একটি প্রধান উপাদান হল খাবার। যা দেশ থেকে দূরে তাদের দেশের স্পর্শ দেয়।
রমজানের সময় মরক্কোর বেকারিগুলো ‘চেবাকিয়া’ (তিল এবং মধুতে তৈরি গোলাপের আকৃতির মিষ্টি) আর উত্তর আফ্রিকান রেস্তোরাঁগুলো ঐতিহ্যগত ইফতার মেনু প্রদান করে।
সময়ের সাথে রমজানের অনেক ঐতিহ্যই বিশেষ করে ইফতার আয়োজন পরিবর্তিত হয়েছে। কারণ, রমজান বিভিন্ন সংস্কৃতিকেও প্রতিফলিত করে যা এক ধরনের বিবর্তন। নিজ দেশে থেকে দূরে থেকে অথবা সংখ্যালঘু হিসেবে থাকলেও, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের রমজান পালন এবং ইফতার আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির সাথে আদর্শ এবং সংস্কৃতির আদান প্রদান ঘটে। একইসাথে, সরকার এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে ইফতার আয়োজন, তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রীতি ও সৌহার্দ্য তৈরি করে।
তথ্যবহুল পোস্ট। জানলাম