ইস্তাম্বুলের অনন্য নিদর্শন সুলতান আহমেদ মসজিদ

761
0

কৃষ্ণ সাগরের পাড়ে বসফরাস নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ইসলামী আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক শহর ইস্তাম্বুল। যা বর্তমান তুরস্কের রাজধানী। মজার বিষয় হচ্ছে, এটি পৃথিবীর একমাত্র শহর যা দুটি মহাদেশের অংশ। সাত পাহাড়ের শহর নামে পরিচিত ইস্তাম্বুলে মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নীল আভায় পরিপূর্ণ অসম্ভব সুন্দর এক মসজিদ। যার প্রকৃত নাম সুলতান আহমেদ মসজিদ। কালের বিবর্তনে এর বহিরাবরণের নীল রঙের কারণে এটি ব্লু মসজিদ নামেও পরিচিত। 

বিখ্যাত এই নীল মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান আহমেদ। সুলতান আহমেদ মাত্র ১৩ বছর বয়সে  তুরস্কের সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ সালের শেষ পর্যন্ত মসজিদটির নির্মাণ কাজ চলেছে এবং ১৬১৭ সালের দিকে সুলতান মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়।অটোমান সাম্রাজ্য এবং হ্যাবসবার্গ রাজতন্ত্রের মধ্যে পনের বছরের যুদ্ধ শেষে, সুলতান আহমেদ অনুভব করেছিলেন যে সাম্রাজ্যের প্রতি জনগণের আস্থা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। 

তিনি তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করার এবং জনগণের মনোবল বাড়ানোর উপায় খুঁজছিলেন। যার কারনে উসমানীয় শক্তিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য ইস্তাম্বুলে একটি বড় মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও তার পূর্বসূরিরা তাদের মসজিদের জন্য যুদ্ধের গনীমতের অর্থ দিয়েছিল। মূলত অটোম্যান সাম্রাজ্যের নিদর্শন হিসেবে এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তখন। তবে তার পরিকল্পনায় শুধুমাত্র একটি অপূর্ণতা ছিল। আর তা হলো মসজিদটির নির্মাণকাজ অনেক ব্যয়বহুল। 

সুলতান আহমেদ মসজিদের নীলনকশা। Image Source: Columbia University

আহমেদ প্রথমেই সরকারী কোষাগার থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। কারণ তিনি যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করতে পারেননি। এভাবে সুলতানের যুদ্ধের লুটের পরিবর্তে সরকারী কোষাগার থেকে অর্থ প্রদান করা মুসলিম আইনবিদদের ক্ষোভের কারণ হয়েছিল। মূলত সুলতান চেয়েছিলেন তিনি এমন একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন যা ইস্তাম্বুলের অন্যতম মসজিদ আয়া সোফিয়ার সৌন্দর্যকেও ছাপিয়ে যাবে। আর সেজন্যই মসজিদটি আয়া সোফিয়ার কাছাকাছি নির্মাণ করা হয়। প্রকৌশলী সেদেফকার মেহমেদ আগা এই মসজিদের নকশা করেন; তিনি ছিলেন মহান স্থপতি সিনান এর ছাত্র। 

৪০০ বছর পূর্বে তৈরি এই মসজিদটি এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। আজও পৃথিবীর সুন্দরতম মসজিদের তালিকায় স্বমহিমায় তালিকাভুক্ত আছে নীল মসজিদ খ্যাত সুলতান আহমেদ মসজিদ। শুধু মুসলমানরা নয়, এই মসজিদ দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার ও নানান ধর্মের মানুষ ছুটে আসছে তুরস্কে। যার কারণে এটি তুরস্কের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সময় অন্য ধর্মালম্বীদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। 

মসজিদে প্রবেশের পূর্বে দর্শনার্থীদের কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। যেমন দর্শনার্থীকে কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে আর যদি দর্শনার্থী নারী হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে মাথায় ওড়না বা স্কার্ফ রাখা আবশ্যক। যদি কোন মেয়ের সাথে ওড়না বা স্কার্ফ না থাকে তবে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাদের ওড়না বা স্কার্ফ সরবরাহ করে থাকে। মসজিদে প্রবেশের পূর্বে অবশ্যই জুতা খুলে প্রবেশ করতে হবে। মসজিদে যে অংশে নামাজ আদায় করা হয় সেখানে যারা নামায আদায় করবে কেবল তারাই প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া, মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 

নীল রঙের টাইলসের কারণেই মসজিদের ভিতর এমন নীলচে আলো ছড়িয়ে থাকে। Image Source: Özgür Gezer

সুলতানের নির্দেশে তুর্কির ঐতিহ্যবাহী কারুকাজে হাতের নকশায় ২০ হাজার জৌলসপূর্ণ নীল রংয়ের টাইলস দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই মসজিদের ভেতরকার দেয়াল। এর গম্বুজও নীল টাইলস দিয়ে আবৃত। টাইলসগুলোর রং ও সৌন্দর্য মসজিদটিতে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। মসজিদের ভেতরে ঢুকলে মনে হবে সমুদ্রের নীল জলরাশি এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মূলত এই কারণে মূল নামের পরিবর্তে ব্লু বা নীল মসজিদ নামে সবার কাছে খ্যাতি পেয়েছে এই মসজিদ। ইসলামিক ক্যালিগ্রাফির নিপুণ উপস্থাপনা পুরো মসজিদকে জড়িয়ে রেখেছে শুদ্ধ পবিত্রতায়। ছোট ছোট তেল বাতির মৃদু আলো মসজিদের গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। 

মসজিদের প্রধান গম্বুজের উচ্চতা ৪৩ মিটার। মসজিদের চারকোণায় ৪টি ও পেছনে আরো দুটিসহ ৬টি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। মিনারগুলো দূর থেকে দেখতে পেন্সিলের মতো লাগে। প্রধান চারটি মিনারের প্রতিটি স্তর বিশিষ্ট দূরত্বে তিনটি করে ব্যালকনি ও অন্য ২টিতে রয়েছে দুটি ব্যালকনি। সুউচ্চ ৬টি মিনারের প্রতিটি মিনার ৬৪ মিটার লম্বা। সুলতান আহমেদ মসজিদে ২৩.৫  মিটার উচ্চতার ৮টি মধ্যম আকৃতির গম্বুজ রয়েছে। ভেতরের পিলারগুলোতে ঐতিহ্যগত নকশা ও গ্যালারি অঞ্চলের দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন ফল ও ফুলের চিত্র অঙ্কন করা রয়েছে। 

সুন্দর এই নিদর্শনে অত্যন্ত মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল ভিতরের সামগ্রিক কাজে। নীলের ভিতর সবুজ, সাদা ও মেরুন রংয়ের কাজ করা ছাদের প্রতিটি অংশ চোখ জুড়িয়ে দেয়। এছাড়া, অত্যন্ত নিপুণভাবে ২০০টি জানালা স্থাপন করা হয়েছে যেগুলো দিয়ে প্রাকৃতিক আলো মসজিদের ভেতর ঢুকতে পারে। জানালার পাল্লায় ব্যবহার করা হয়েছে ১৭ শতকের স্বচ্ছ রঙ মিশ্রিত কাঁচ। অবশ্য পরবর্তীকালে এই সুন্দর জানালাগুলোর সংস্কার করা হয়েছে। 

কাছ থেকে মসজিদের গম্বুজগুলো দেখতে এমনই। Image Source: Dani/dreamtime.com

প্রতিটি মাধ্যমিক গম্বুজে চৌদ্দটি করে জানালা এবং কেন্দ্রীয় গম্বুজে ২৮টি জানালা রয়েছে। ভেতরের দেয়ালগুলোর উপরিভাগে পাহাড়ি কারুকাজ ও নকশাচিত্রের পাশাপাশি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ক্যালিগ্রাফিও রয়েছে। ক্যালিগ্রাফিগুলো তৈরি করেছেন তৎকালীন সেরা ক্যালিগ্রাফার সাঈদ কাসিম গুবার। এছাড়া, মসজিদের মেঝেতে উন্নত মানের দামী কার্পেট বিছানো রয়েছে। যা নিয়মিত পরিবর্তন করা হয়। কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি, স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি যেমন এই মসজিদটির সৌন্দর্যের উৎস তেমনি একে বিশেষত্ব দান করেছে এর বাইরের পরিবেশও। 

১৯৩৪ সালে আয়া সোফিয়া মসজিদটি মিউজিয়ামে রূপান্তরের পর ইস্তাম্বুলের প্রধান মসজিদে পরিণত হয় সুলতান আহমেদ মসজিদ। প্রায় ১০ হাজার মুসল্লী একসাথে এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। আশেপাশের চত্বরসহ ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে বড় কমপ্লেক্সও বলা হয় এই মসজিদকে। ২৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২১৩ ফুট বিশিষ্ট সুবিস্তৃত মসজিদ কমপ্লেক্সের আওতায় রয়েছে একটি মাদ্রাসা, হলরুম ও সুলতান আহমদ এর কবর। দেয়ালঘেরা সুপরিসর আঙিনায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ফোয়ারা। এগুলোতে মুসল্লিরা অজু করেন। আঙিনার মাঝের ডান দিকে কয়েকটি মার্বেলের সিঁড়ি রয়েছে। মূল আঙিনায় ওঠার জন্য এগুলো ব্যবহৃত হয়। আঙিনায় ব্যবহৃত মার্বেল পাথরগুলো আনা হয়েছিল মর্মরা সাগরের একটি দ্বীপ থেকে। 

প্রতি বৃহস্পতিবার মসজিদের আঙিনা থেকে বসফরাস প্রণালী স্বচ্ছ পানিতে সূর্যাস্ত দেখার জন্য প্রচুর লোক সমাগম হয়। আর রাতের বেলায় বাতির আলো যখন মসজিদের গম্বুজ ও মিনারগুলোর উপর পড়ে তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়; যা দেখার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত পর্যটকরা ভিড় করে। চোখ জুড়ানো স্থাপত্যশৈলী, চমৎকার আবহাওয়া ও মসজিদ সংলগ্ন পার্কে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে নীল মসজিদের আঙিনা সবসময় লোকে-লোকারণ্য থাকে। 

রাতের বেলা নিজের ভিন্ন এক সৌন্দর্য প্রকাশ করে সুলতান আহমেদ মসজিদ। Image Source: wallpapersafari.com

পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তুরস্ক সফরের সময় ২০০৬ সালের ৩০শে নভেম্বর নীল মসজিদ পরিদর্শনে যান। ইতিহাসে এটি ছিল মুসলিমদের উপাসনালয়ে দ্বিতীয় পোপ সফর। সেখানে তিনি দুই মিনিট নীরবে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করেন। তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ইস্তাম্বুলের মুফতি মোস্তফা চাগরিসি এবং মসজিদের ইমাম এমরুল্লাহ। নীল মসজিদটি ১৯৮৫ সালে ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক এলাকা নামে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক এই নীল মসজিদ প্রতিবছর লাখ লাখ সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। 

 

Feature Image: The Istanbul Insider
তথ্যসূত্র:

01. A Brief History of the Blue Mosque in Istanbul.
02. Blue Mosque.