ইউনাইডেট ন্যাশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন এর তথ্য মতে বিশ্বের সেরা পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে এক নাম্বারে আছে ফ্রান্স। প্রতি বছর প্রায় ৮১ মিলিয়ন বিদেশী পর্যটক এই চমৎকার জায়গায় আসে ঘুরতে। প্যারিস, লিওন, বোরডেক্স, টউলউজসহ নানান শহরের আছে প্রায় ৩৭টি বিশ্ব পর্যটন কেন্দ্র।
কেবলমাত্র দর্শনীয় স্থান নয়, চমৎকার আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাসাদ, ঐতিহাসিক জাদুঘর, পার্ক, বাগান, সমুদ্রতীরসহ নানা স্থাপনার জন্য দর্শকপ্রিয় ফ্র্যান্সের সেরা কিছু স্থাপনা নিয়েই আজকের আয়োজন।
প্যারিসের হৃদয়, বাসিলিকা অফ স্যাকরাকা (Basilica of Sacred Heart of Paris)
স্বপ্নের শহর প্যারিসে স্থাপত্যের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো রোমান ক্যাথলিক চার্চ বাসিলিকা অফ স্যাকরেড হার্ট অফ প্যারিস। মন্টমার্টে হিলের একদম উচ্চতম বিন্দুতে অবস্থিত একটি চার্চ এটি। এই পবিত্র চার্চটি স্বয়ং যীশু খ্রিষ্টের পবিত্র হৃদয়ের নিদর্শন, তাকেই উৎসর্গ করে গেছেন। ফ্রান্স এর আর্কিটেক্ট পল এবাদি এর নকশা তৈরি করেন। ১৮৭৫ সাল থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে এটি তৈরি করা হয়েছিল।
ট্রাভারটাইন পাথর, এক বিশেষ ধরনের চুন গরম করে এটির নির্মান কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই মিশ্রন খুব ধীরে ধীরে ক্যালিসাইট নির্গত করে, যা পুরো পাথরের রঙ সাদা রাখতে সাহায্য করে। এই ক্যাথিড্রালে রয়েছে বিশালাকার ধ্যান কক্ষ, যার মধ্যে একটা সুদৃশ্য ফোয়ারা রয়েছে। এই চার্চের উপরর যে গম্বুজ রয়েছে, তার ছাদ থেকে পুরো প্যারিস শহরের এক নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করতে পারবেন।
পন্ট দ্যু গার্ড ব্রীজ (Pont Du Gard Bridge, Nime)
রোমান রাজ্যের ইতিহাস তো আজকের নয়, সেই কোন আদিকাল থেকে সগৌরবে রোমান ইতিহাস আমাদের মুগ্ধ করে আসছে। সাথে আছে তাদের স্থাপত্যকলা, ইতিহাস আর ঐতিহ্য। সেই ইতিহাসের এক নিদর্শন এই পন্টু দ্য গার্ড ব্রীজটি। গার্ডন নদীর উপরে নির্মিত এই পন্টু দ্য গার্ড ব্রীজের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিলোমিটার। ৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ব্রীজের নির্মান কাজ চলে। ৬০ সালের দিকে ব্যবহারের জন্য খুলে দেয়া হয়। সেই সময়ে ফ্রান্সের উজিস থেকে নিম শহরে পানি বহনের কাজে এই ব্রীজটি ব্যবহার করা হতো।
হলদে চুনাপাথর, ক্যালসিয়াম, ব্রীজ ব্লক দিয়ে তৈরি এই ব্রীজের আছে তিন স্তরের খিলান। যার উচ্চতা প্রায় ৪৮.৮ মিটার। আনুমানিক ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত এই ব্রীজ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০,০০০০ ঘন মিটার পানি পরিবহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি টোল ব্রীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফ্রান্সের অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম এই ব্রীজ এখনও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
আর্ক ডি ট্রিয়ম্ফ ( Arc De Triomphe, Paris)
ভালোবাসার শহর প্যারিস, এই শহরের মধ্যে অন্যতম সেরা আর জনপ্রিয় সৌধ হলো আর্ক ডি ট্রিয়ম্ফ। ১৮০৬ সালে নেপোলিয়ানের নির্দেশে এই স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সাথে যারা দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
১৮৩৬ সালে এটির উদ্বোধন করা হয়। নেপোলিয়ানের পতনের পর এর কাজে বহুবার বিঘ্ন ঘটেছে। এর একদিকে রয়েছে বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়াম। এটির উচ্চতা ৫১ মিটার এবং প্রস্থ ৪৫ মিটার। ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকের সময়কার সকল যুদ্ধের নাম, নেপোলিয়ান যে সকল যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন সেই সকল যুদ্ধের নাম এই সৌধের সাদা পাথরে খোদাই করা আছে।
অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই সৌধের এক অংশে রয়েছে নাম না জানা এক শহীদের কবর। শোনা যায় তিনি ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক।
ভার্ডোন জর্জ গিরিখাত (Verdon Gorge Canyon, Alpes De Haute Province)
ইউরোপের অন্যতম গভীর গিরিখাত হল ভার্ডেন জর্জ গিরিখাত। যা ফ্রান্সের দক্ষিনপূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। এই গিরিখাতের দৈর্ঘ্য ২৫ কিলোমিটার আর খাদের উচ্চতা প্রায় ৭০০ মিটার। ভার্ডন নদীর সবুজাভ রঙ আর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এটি বিখ্যাত। এই সবুজ রঙের কারণ খনিজ পাথর আর হিমবাহের প্রভাব।
প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এই অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করতে আসে এখানে। হাইকিং, প্যারাগ্লাইডিং, ক্লাইম্বিংসহ নানা ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে ভ্রমণপিয়াসীরা তাদের ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখেন।
চ্যাম্বোর্ড ক্যাসেল (Chateau De Chambord, Loir et Cher)
ফ্রান্সের স্থাপত্য শিল্প নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। লরে ভ্যালির এক অসম্পূর্ণ দূর্গ এবার আমাদের আলোচনার বিষয়। এই বিশালাকার প্রাসাদটি পুরোটায় ঘিরে রয়েছে জাতীয় উদ্যান। রাজা প্রথম ফ্রাঙ্কস এর জন্য এই প্রাসাদ নির্মান করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্ব পর্যটন শিল্পের এক অংশ এই বিপুলাকার চ্যাম্বোর্ড প্রাসাদ।
দুঃক্ষজনক ব্যাপার হলো, ১৫১৯ থেকে শুরু করে সুদীর্ঘ ২৮ বছর ধরে এর নির্মানকাজ চললেও এই দূর্গ সম্পূর্ণ হয়নি আজো। ফরাসী বিদ্রোহের সময় এটির নির্মান কাজ ব্যহত হয়। বর্তমানে ৪০০টিরও অধিক কক্ষ, ৮০টি সিড়ি, ২৮০টি ফায়ারপ্লেস, অনেকগুলো চিমনী আর টাওয়ার-জানালা রয়েছে এই প্রাসাদে। এই প্রাসাদে ফ্রান্স আর ইতালিয়ান সভ্যতা আর সংস্কৃতির মিশেল রয়েছে।
সেইন্ট মিশেল (Saint Michel, Normandy)
ইউরোপ ঠিক কোন বিষয়ে নিজেদের আর বাকী মহাদেশ বা ইতিহাস থেকে নিজেদের পিছিয়ে রেখেছে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। হোক সংস্কৃতি বা হোক ধর্মীয় স্থাপনা ইউরোপ সবার থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে। নরম্যান্ডি দ্বীপে অবস্থিত এই আলোচ্য স্থানটি ধর্মীয় স্থাপনা শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন।
প্রতি বছর ৩ মিলিয়নেরও বেশি এখানে ঘুরতে আসে। দ্বীপের তীর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরত্বে এই পবিত্র আর বিশ্ব পর্যটনের কেন্দ্র। মঠ, গীর্জা এই সেইন্ট মিশেলের একদম উপরের ভাগে রয়েছে। নিচের সেকশনে আছে হলরুম, বাসস্থান, স্টোররুম। মজার ব্যাপার হল একদম উপরে পৌছতে আপনাকে পার হতে হবে ৯০০ ধাপের সিঁড়ি। এখানে আসা দর্শনার্থীদের এই চার্চের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে; বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে।
ল্যুভর জাদুঘর (The Louvre, Paris)
ল্যুভর মিউজিয়াম, নাম শুনলেই কেমন যেন এক রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। মনে হয় কত রহস্য, কত ইতিহাস, কত গোপন কথা আগলে বসে আছে এই জাদুঘর। পৃথিবীর অন্যতম সেরা আর বৃহৎ এই জাদুঘর। মিশরের এন্টিক বস্তু, মণি মাণিক্য, বিখ্যাত ব্যক্তিদের আঁকা চিত্র, ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে সব কিছুর দেখা পাবেন। সব মিলিয়ে প্রদর্শিত বস্তুর সংখ্যা কম কম করেও ৩৫,০০০ হবে। এই জাদুঘরের বিশেষত্ব হলো, বিখ্যাত বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা চিত্র কর্ম। যা দেখার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই জাদুঘরে আসে আর ধীরে ধীরে এই জাদুঘর হয়ে উঠল শিল্পঅনুরাগীদের তীর্থস্থান।
১৭৬৩ সালের আগ পর্যন্ত এটি লুভ্যর প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বারোক শৈলীর নিদর্শন এই প্রাসাদ নেপোলিয়ানের হাত ধরে হয়ে ওঠে চিত্রকর্মের তীর্থস্থান। উনি ছাড়াও ফ্রান্সের সকল রাজ পরিবারের সদস্যরা এই জাদুঘর সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই জাদুঘরের প্রধান আটটি বিভাগের মধ্যে আছে পশ্চিমা এন্টিক্স, মিশরীয় এন্টিক্স, গ্রীক এবং রোমানিয়া এন্টিক্স সহ আরো নানা দেশের এন্টিক বস্তু। এছাড়া ইসলামিক ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কিছু নিদর্শন, বিখ্যাত সব ভাষ্কর্য, নানা শিল্পীর আঁকা বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম এখানে সাজিয়ে রাখা রয়েছে। এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ হল লুভ্যর পিরামিড। এটির স্থপতি ছিলেন আই এম পেই।
ভার্সাই দূর্গ (Palace of Versailles, IIe de France Region)
ভার্সাই দূর্গ বা ভার্সাই প্রাসাদ নামে পরিচিত এই প্যালেস ১৬২৪ সালে হন্টিং লজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন রাজা অষ্টম লুই। পরে রাজা নবম লুই উত্তরাধিকার সুত্রে এই প্রাসাদের মালিকানা লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনিই এটিকে দেশের সবচেয়ে বড় প্রাসাদে রূপান্তরিত করেন। প্রায় ২ হাজার একরের বাগান, ৭০০ কক্ষ, ২১৫৩টি জানালা, ৬৮টি সিঁড়ি নিয়ে এই দৈতাকার প্রাসাদ সগৌরবে বহন করছে ইতিহাস। প্রায় ২০,০০০০ রকমের গাছের দেখা মিলবে সেই বাগানে, ফ্রেন্স স্টাইলের এই বাগানে ২ লাখের বেশি ফুলের গাছ রয়েছে। সাথে পাবেন সুদৃশ্য ৫০টি ঝরনার দেখা।
একসময় অনেক বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এই প্রাসাদ। পদমর্যাদার ভিত্তিতে এই প্রাসাদে রয়েছে নানা আকারের রুমের ব্যবস্থা, নানা সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা। বর্তমানে পর্যটকদের পদচারনায় মুখর হয়ে ওঠে এই প্রাসাদ। অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল, এই প্রাসাদের হল অফ মিররস, দিনের বেলায় আলোর প্রতিফলনে অন্য এক অনুভূতি দেবে আপনাকে।
ডিজনিল্যান্ড (Disneyland, Paris)
ডিজনিল্যান্ড প্যারিসের এমন একটি জায়গা যেখানে যাবার স্বপ্ন দেখে না এমন কেউ নেই। ১৯৯২ সালে ডিজনিল্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট রিসোর্ট চালু হয়। প্যারিসের মধ্যমনি হিসেবে ৪৮০০ একর জায়গা দখল করে আছে এই জায়গাটি। এতে রয়েছে ২টা থিম পার্ক, রিসোর্ট, শপিং এন্ড এন্টারটেইনমেন্ট সেকশন। এখানে গেলে বারবার ফিরে যেতে চাইবেন। ২০১৪ সালের এক সমীক্ষা অনুসারে ২৭৫ মিলিয়ন মানুষ ঘুরে দেখেছে এই স্বপ্নভূমি।
৫৭টি রাইড, ৬২টি দোকান, ৫৮০০ হোটেল রুম, ৫৫৪৬৩ কর্মী রয়েছে ৫০০ বিভাগে। পাইরেটস অফ ক্যারাবিয়ান রাইড এই ল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাইড। হলিউডের বিখ্যাত মুভি ‘পাইরেটস অফ ক্যারাবিয়ান’ মুভি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও আছে দ্য স্মল ওয়ার্ল্ড, স্পেস মাউন্টেন, বিগ থান্ডার, লেজার ব্লাস্ট, বাজ লাইট ইয়ার লেজার শো ডিজনিল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ২০০২ সালে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও পার্ক মুভি ভিত্তিক নানা রাইডের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
আইফেল টাওয়ার (Eiffel Tower, Paris)
আইফেল টাওয়ার, প্যারিসের পরিচয় বহন করা এক নান্দনিক স্থাপত্য। যা ১৮৮৯ সালে স্থাপিত হয়। প্রায় ৪১ বছর এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ার ছিল। ৩২০ মিটার এই টাওয়ারের কাজ মাত্র ২ বছরে শেষ হয়। ১৮৮৭ সালে শুরু হওয়া এই সুউচ্চ টাওয়ারের নামকরণ করা হয় স্থপতি গুস্টাভি আইফেল এর নামানুসারে। তিনি ছিলেন এই নির্মাণ কাজের প্রধান স্থপতি।
১০,০০০ টন আয়রন এই আইফেল টাওয়ারের নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়। আইফেল টাওয়ারের জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে অনেক দেশে এর অনুকরন করে একই রকম টাওয়ার নির্মান করা হয়। প্রতি ৭ বছর পর পর এটি রঙ করা হয়। রঙ করার কারণ হল এর রক্ষণাবেক্ষণ করা। মাত্র ২ তলা পর্যন্ত সাধারন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। লিফট বা সিড়ি ব্যবহার করা হয় ওঠা নামার জন্য।
প্যারিস বা ফ্রান্সের দর্শনীয় স্থানের সংখ্যা এক লেখায় জানানো সম্ভব না, যেমন এক দিনে এক একটি স্থানও ঘুরে দেখাও বেশ কঠিন। পরবর্তীতে আবারও হাজির হবো আরো নতুন কোন চেনা জায়গার অচেনা গল্প নিয়ে।
Source: