পারস্পারিক চুক্তি বা সমঝোতার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু এর মধ্যে কিছু চুক্তি আছে যেগুলো শান্তির পরিবর্তে পরবর্তীতে নিয়ে এসেছে অশান্তির বার্তা। যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। ভার্সাই চুক্তি এমনই একটি চুক্তি। যা যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাহ্যিকভাবে এই চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও প্রখ্যাত ঐতিহাসিকগণের মতে এই চুক্তিই খুলে দিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বার।
পেছনের ইতিহাস
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ১০ মাস পূর্বে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ১৪ দফা প্রস্তাবনা তুলেন। যা ‘ফোরটিন পয়েন্ট‘ হিসেবে পরিচিত। ১৪ দফার মধ্যে ৮টি দফাই ছিল রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক সম্পর্কিত। জার্মানির কাছে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সকল মিত্রপক্ষের ক্ষতিপূরণ দাবি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দফা ছিল।
আরো বেশ কিছু দফা ছিল; যেমন – ইতালির সীমানা পুনর্নিধারণ, সকল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও স্বাধীনতা রাজ্যসীমা নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিপুঞ্জ গঠন করা, তুরস্কের সমস্যাগুলোর সমাধান এবং স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে উড্রো উইলসনের সেই ভাষণ শান্তির বাণী হিসেবে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেন,
পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই লাভের খাতিরে একে অন্যের অংশীদার, এবং আমাদের দিক দিয়ে এটা বলা যায় যে, সেই পর্যন্ত আমাদের সাথে ন্যায়বিচার করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা অন্যদের সাথে ন্যায়বিচার করবো।
ভার্সাই চুক্তির সূত্রপাত
১১ নভেম্বর, ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। কেন এরকম ভয়াবহ একটি যুদ্ধের সূত্রপাত হলো তা সম্পর্কে ১৯১৯ সালে ১৮ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসের মিরর’স হল নামক জায়গায় একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। ঐতিহাসিক সেই সম্মেলনে যোগদান করেন ৩২টি মিত্রদেশের কূটনৈতিকরা। এই সম্মেলনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে কোন পরাজিত দেশের প্রতিনিধিকে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। সেই হিসেবে জার্মানিকেও এই আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। জার্মানিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে দায়ী করা হয় এবং জার্মানির উপর জোরপূর্বক কিছু বিষয় শাস্তি হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়।
২৮ জুন, ১৯১৯ সালে স্বাক্ষর করা হয় ভার্সাই চুক্তির। তৎকালীন ‘বিগ ফোর‘ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ইতালি; এছাড়াও ছিল জাপান, যারা ভার্সাই সন্ধির নামে জার্মানির উপর শুরু করে অসহনীয় নির্যাতন। চারদিন শান্তি আলোচনার পর ২১ জানুয়ারি সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো। এদিকে ভার্সাই চুক্তির সন্ধিগুলো আগেই নির্ধারণ করা হয়ে গেছে।
এখন শুধু শর্তগুলো জার্মানিকে জানিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা বাকি ছিল। প্যারিস শান্তি সম্মেলনের পর জার্মানির সাথে আলোচনা ও সন্ধি স্থাপনের লক্ষ্যে ভার্সাই রাজপ্রাসাদে একটি বৈঠকের আহ্বান করা হয়। প্যারিস থেকে ভার্সাইয়ের দূরত্ব ছিল মাত্র ২২ কিলোমিটার। ১৬৬০ সালে নির্মিত ভার্সাই রাজপ্রাসাদ ছিল ফ্রান্সের রাজার আবাসস্থল।
ভার্সাই চুক্তিটি ২৪০ পাতার ছিল। এছাড়াও পুরো সন্ধিকে ৪৪০টি আলাদা আর্টিকেলে ভাগ করা হয়েছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে একদম বিধ্বস্ত করে দেয়ার চেষ্টা চালানো হয়। যাতে জার্মানি পুনরায় আর উঠে না দাঁড়াতে পারে এবং পরবর্তীতে নতুনভাবে কোনো বিশ্বযুদ্ধ শুরু না করতে পারে।
এছাড়াও, ফ্রান্স এই চুক্তিতে সমর্থন দেয়ার কারন হচ্ছে, ফ্রান্সের দুইটি সমৃদ্ধ নগর আলসাস এবং লরেন জার্মানি দখল করে নিয়েছিল। ফ্রান্স তারই প্রতিশোধ নিতে এই চুক্তিতে সমর্থন করে।
ক্ষতিগ্রস্ত জার্মানি পরলো আরও ক্ষতির মুখে
ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে তিন ভাবে জার্মানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। ভৌগলিক, সামরিক এবং আর্থিক। দেশের ২৫০০০ স্কয়ার মাইল নিয়ে নেয়া হয়েছিল। যা সামগ্রিক অঞ্চলের ১৩ ভাগ ছিল এবং মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ।
ভৌগলিকভাবে যে সকল ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল-
- আলসাস-লরেন অঞ্চল দখল নিয়েছিল ফ্রান্স।
- ইউপেন এবং মালমেডি নিয়েছিল বেলজিয়াম।
- উত্তর স্লেসউইগ নিয়েছিল ডেনমার্ক।
- হলস্টিন কেড়ে নিয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়া।
- ওয়েস্ট প্রুসিয়া, পোসেন এবং আপার সিলেসিয়া নিয়েছিল পোল্যান্ড।
সামরিকভাবে যে সকল ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল-
- জার্মানি যাতে আর যুদ্ধ না করতে পারে সেজন্য ১ লক্ষের বেশি সেনা রাখতে পারবেনা।
- ১৬ হাজার টনের উপর যত যুদ্ধ জাহাজ ছিল সব নিয়ে নেয়া হয়েছিল।
- বিমান বাহিনী তৈরি করার উপর নিষেধাজ্ঞা তো ছিলই!
- রাইনল্যান্ডের ৫০ কিমি পূর্ব এবং পশ্চিমে কোন সৈন্য কিংবা অস্ত্র রাখা যাবে না।
এছাড়াও ১৫ বছরের মধ্যে জার্মানি ক্ষতিপুরণ দিতে সক্ষম হলে আলোচিত ভৌগলিক অঞ্চলগুলো ফিরিয়ে দেয়া হবে। তবে এখানে আরও একটি শর্ত আরোপ করা হয় সেটি হলো – এই অঞ্চলগুলোতে গণভোট নেয়া হবে। যদি গণভোটে অধিকাংশের মতামত জার্মানির পক্ষে যায়, তবেই জার্মানি এই অঞ্চলগুলো ফিরে পাবে।
আর্থিকভাবে যে সকল ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল-
ভার্সাই চুক্তির আর্টিকেল নামার ২৩১ অনুযায়ী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত ধরনের ক্ষতি হয়েছে তা জার্মানি মেনে নিয়েছিল একরকম বাধ্য হয়েই। সেই অনুযায়ী ৫ বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। এবং একটি রেপুরেশন কমিশন বসানো হয়েছিল যেটি কতটুকু ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে বা হবে তার হিসাব নিবে। জার্মানি এই ক্ষতিপূরণ নগদ টাকায় কিংবা কয়লা, কাঠ এবং অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ দিয়ে শোধ করতে পারবে।
বিরূপ প্রভাব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া দেশগুলো ছিল- জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়া। তাদের সরকার দিন যত যাচ্ছিল বিরূপ আচরণ করা শুরু করেছিল। ক্ষমতাসীন দল গণতন্ত্র বজায় রাখত জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার সাথে, অপরদিকে হাঙ্গেরি এবং বুলগেরিয়ার সাথে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা শুরু করল। এছাড়াও, এসকল দেশের জনগণ দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে লাগলো।
জার্মানি মূলত এরকম ক্ষতি মেনে নিতে পারছিল না। এর ফলেই পর্বরতীতে হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীর আবির্ভাব ঘটে। ইতোমধ্যে, জার্মানিতে হাইপার ইনফ্লেশন শুরু হয়। ১৯২৯ সালে শুরু হয় গ্রেট ডিপ্রেশন; যা জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা আরও অস্থিতিশীল করে দেয়। ভার্সাই চুক্তি পুনরায় রিভিশন দেয়া হয় ১৯২০ সালের শেষ এবং ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে। এবং হিটলার ঘোষণা দেয় যে কোন প্রকার চুক্তি মেনে নেয়া হবে না। কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না। এতেই সূত্রপাত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। বীজ বপন করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, যা বপন করেছিল হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনী।