গিলোটিনঃ ফরাসি বিপ্লবের এক মধ্য-যুগীয় বর্বর অস্ত্র

907
0
প্রাচীন গিলোটিন Photo by stock.adobe.com

১৭৯৪ সালের কথা। ফরাসি বিপ্লবের উত্তাল সময়। জনৈক ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ল্যাভশিয়োর বিপ্লব চলাকালীন মৃত্যুদন্ডের জন্য অভিযুক্ত হন। উত্তাল জনস্রোতের মাঝে উঁচু মঞ্চ সাজিয়ে, শত শত মানুষের উপস্থিতিতে, শিরচ্ছেদের মাধ্যমে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মনিবের কাটা মস্তকের দিকে তাকিয়ে অ্যান্টনির ভৃত্য আশ্চর্য হয়ে যায়। তিনি দেখেন মস্তক ছেদ হবার ১৫ সেকেন্ড পরও তার মনিবের চোখে পলক পড়ছে! তবে কি তিনি বেঁচে ছিলেন?

ফরাসি বিপ্লবের সময় এমনই ১০,০০০ এরও অধিক সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের গিলোটিন নামক যন্ত্রের ধারালো ব্লেডের নিচে শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল। তৎকালীন ফ্রান্সে এই মরণ যন্ত্রটি কেবল রাস্ট্রীয় অনুমোদনই নয় বরং জনগণের নিকটও প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, শিরচ্ছেদ করার মতো লোমহর্ষক প্রক্রিয়াকে ঘিরে জমজমাট আয়োজন হতো। বয়স্ক থেকে শিশু, সবাইই দেখতে আসতো গিলোটিনে শিরচ্ছেদ ‘উপভোগ’ করতে! যা সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, সেই সময় যথেষ্ট উদ্বেগজনক এক সমাজ ব্যবস্থার চর্চা চলছিল।

যদিও গিলোটিনের উদ্ভাবনের অন্যতম কারণ ছিল অপরাধীর সাজা সহজ ও মানবিক করা। এমনকি এই পদক্ষেপ কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছিল তৎকালীন প্রেক্ষাপটে, তা নিয়ে চলছে বছরের পর বছর তর্ক-বিতর্ক। হাজার হাজার কাটা মাথার উপর চলে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা। আসলেই গিলোটিনে মৃত্যু যন্ত্রণা কমে, নাকি তার উল্টো?

প্রায় ১৮৯ বছরের রাজত্বকালে এই মরনাস্ত্র কেড়ে নিয়েছে হাজারো অপরাধী–নিরপরাধীর প্রাণ। মধ্যযুগীয় অনুণ্ণত যন্ত্র থেকে হয়ে উঠেছিল নিখুঁত মৃত্যুদণ্ড যন্ত্র হিসেবে। স্বীকৃতি পেয়েছিল রাজকীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে, সম্মানিত হয়েছিল অপরাধীদের সাজা প্রদানের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে।

ফ্রান্সের সংরক্ষিত গিলোটিন। Photo by bbc.com/news/world

তবুও কেন এত এত গবেষণার পর বিলুপ্তি ঘটে গিলোটিনের! এমন তো নয় যে উন্নত বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় না। এমনকি গিলোটিনের ব্যবহার ১৯ শতকের শেষের দিকেও অব্যাহত ছিল।

তবে কেন বিলুপ্ত হল ফরাসী বিপ্লবের দিনগুলোর মরণ হাতিয়ার গিলোটিনের!

কেমন ছিল গিলোটিন? 

১৭৯০ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় ‘গিলোটিন’ নামক যন্ত্রের উদ্ভব ও নামকরণ করা হলেও ঠিক একই ধরনের যন্ত্রের প্রচলন তৎকালীন ফ্রান্সে ইতোমধ্যেই বিদ্যমান ছিল। মধ্যযুগে জার্মানি এবং ফ্ল্যান্ডার্সে ‘প্ল্যাঙ্ক’ নামক একটি শিরশ্ছেদকারী যন্ত্রের চল ছিল। এছাড়া, ইংরেজদের কাছে ‘হ্যালিফ্যাক্স গিবেট’ নামে পরিচিত একটি স্লাইডিং কুঠার ছিল, যা প্রাচীনকালে একই পদ্ধতিতে অপরাধীদের সাজা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হতো।

ধারনা করা হয়, ফরাসি গিলোটিনের উদ্ভাবন ঘটেছিল ইতালির রেনেসাঁ যুগের ‘মান্নাইয়া’ এবং ‘স্কটিশ মেইডেন’ নামে কুখ্যাত যন্ত্রের আদলে। কথিত আছে, ১৬শ থেকে ১৮শ শতকের মধ্যে প্রায় ১২০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল প্রাচীন যন্ত্রগুলো। তাই বলা যায়, আদিম গিলোটিনগুলো ফরাসি বিপ্লবের সময়ের অনেক আগে থেকেই ফ্রান্সে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যার আধুনিক রূপান্তর ছিল সর্বশেষ গিলোটিন।

ফরাসি বিপ্লবের সময় তৎকালীন শাসক রাজা ষোড়শ লুই গিলোটিনকে সরকারি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের যন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে ১৭৯৩ সালে রাজা লুই ও ঠিক তার ৯ মাস পর রানী ম্যারি অ্যান্তোনেইত গিলোটিনে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ ও বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য শিরচ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে।

রাজা ষোড়শ লুই। Photo by Imagno/Contributor/Getty Images

বিপ্লবে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। এত এত সাজাপ্রাপ্তের দণ্ড কার্যকর সময় সাপেক্ষ ছিল। গিলোটিনে কম সময়ে বেশি সংখ্যক ব্যক্তির শিরচ্ছেদই যে এই যন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তাতে সন্দেহ নেই। যন্ত্রটি ছিল এমন – লম্বা কাঠের কাঠামোর উপরের দিক থেকে একটি ভারী তির্যক ধারালো ব্লেড সরাসরি নেমে এসে সর্বোচ্চ দ্রুত সময়ে অপরাধীর শিরশ্ছেদ করতো।

ডঃ জোসেফ ইগনেস গিলোটিনের নামানুসারে এই যন্ত্রের নামকরণ করা হয়েছিল। পরবর্তিতে যন্ত্রটি ম্যাডাম লে গিলোটিন, লে ডেম, লেডি, লে ভার্ভ, রাশওয়ান ন্যাশনাল, ন্যাশনাল রেজার এবং লুইস সেট নামেও পরিচিতি লাভ করে।

গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

ড. জোসেফ-ইগনেস গিলোটিনের প্রস্তাবে, ফরাসি সরকার অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মানবিক পদক্ষেপ হিসেবে গিলোটিনের ব্যবহার করতে সম্মত হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী ছিলেন। সেই তাড়না থেকেই হয়তো গিলোটিন ব্যবহারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, তলোয়ার এবং কুঠারের চেয়ে গিলোটিন অনেক বেশি মানবিক এবং বাস্তবসম্মত। যেখানে কুঠার বা তলোয়ারের ব্যবহারের ফলে প্রায়ই দেখা যেত সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির শিরচ্ছেদ প্রক্রিয়া অত্যন্ত মর্মান্তিক হতো, মৃত্যু যন্ত্রনা দীর্ঘায়িত হতো। তার উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে এই সময়টাকে কমিয়ে আনা যায় যেন অপরাধীর মৃত্যু যন্ত্রণা কমে আসে। গিলোটিনের সাহায্যে দ্রুত গতিতে ও নির্ভুলভাবে কাজটি করা সম্ভব ছিল বলে তিনি দাবি করেন।

তার তত্ত্বাবধানে ফরাসি ডাক্তার আন্তোইন লুইয়ের ডিজাইন করা ইম্পোজিং মেশিন এবং টোবিয়াস শ্মিড নামে একজন জার্মান হার্পসিকর্ড দ্বারা নির্মিত একটি যন্ত্র ১৭৯২ সালের এপ্রিলে প্রথম সরকারিভাবে অপরাধীর শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে ‘গিলোটিন’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

কথিত আছে যে, স্বয়ং ড. জোসেফ-ইগনেস গিলোটিন নিজেকে ১৭৯০ এর দশকের ‘গিলোটিন হিস্টিরিয়া’ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে তার পরিবার ফরাসি সরকারের কাছে যন্ত্রটির নাম পরিবর্তন করার জন্য আবেদন করেও ব্যর্থ হয়।

ফ্রেঞ্চ গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হচ্ছে photo by commons.wikimedia.org/wiki/

 

গিলোটিনকে ঘিরে তখনকার জনসাধারণের অস্বাভাবিক উন্মাদনা

অপরাধীকে সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়াটি নিছক সাজা প্রদানের প্রক্রিয়াতে সীমাবদ্ধ ছিল না। একটা সময় জনগণের জন্য এই পুরো প্রক্রিয়াটি একটি স্বাভাবিক বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। গিলোটিনের ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া দেখার জন্য দলে দলে লোকজন এসে জমায়েত হতো। এমনকি জানলে অবাক হবেন, মেশিনটিকে অসংখ্য গান, কৌতুক এবং কবিতায় সম্মানিত করা হয়েছিল। যে উদ্যানে সাজা প্রদান করা হতো সেখানে দর্শকদের জন্য স্যুভেনিয়র বিলি করা হতো।

এমনকি ‘ক্যাবারে দে লা গিলোটিন’ নামক কাছাকাছি একটি রেস্তোরাঁ ছিল। যেখানে এই কার্যক্রমের মাঝামাঝি বসে দ্রুত খাওয়ার কাজটিও সেরে নিতো অনেকেই। কিছু লোক দৈনিক এই জমায়েতে আসতো। সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ‘ট্রাইকোটেউস’ নামক একদল অসুস্থ মহিলা। যারা একদম মঞ্চের কাছে বসতো এবং হাতে সেলাইয়ের কাজ করতে করতে পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষন বা উপভোগ করতো! মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে অনেক লোক ব্যঙ্গাত্মক কটূক্তি করতো, অনেকে সিড়ির কাছে গিয়ে নাচতো।

সৌভাগ্যবশত, ১৮ শতকের শেষের দিকে গিলোটিনের প্রতি জনগনের অতি প্রেমে ভাটা পড়ে। তৎকালীন মানবিক অবক্ষয়ের বিষয়টি নজরে আসে অনেকেরই। বিশেষ করে শিশুদের মনে যে ভয়ানক প্রভাব পড়ছিল, বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তা জনসমক্ষে প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়। কম বয়সিদের দ্বারা নানাবিধ অপ্রাসঙ্গিক অপরাধ সংঘটিত হবার মূলে যে গিলোটিন ছিল তাতে কোন সন্দেহ ছিল না।

মধ্যযুগীয় অস্ত্র যখন হিটলারের হাতে

গিলোটিন শুধুমাত্র ফরাসি বিপ্লবীদের জীবন নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং হিটলারের রাজত্বকালে জার্মানিতে নাৎসি গনহত্যায় সমান ভাবে অবদান রাখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলার ১৯৩০ এর দশকে গিলোটিনকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি হিসেবে ঘোষণা করে। সেই সময় হিটলার সমগ্র জার্মানির শহরগুলিতে ২০টি মেশিন স্থাপনার নির্দেশ দেয়। নাৎসি রেকর্ড অনুযায়ী ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৬,৫০০ জনকে গিলোটিনের সাহায্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল বিদ্রোহী যোদ্ধা এবং ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

২০ শতকের শেষ পর্যন্ত গিলোটিন ফ্রান্সের মৃত্যুদণ্ডের রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ১৯৭৭ সালে দোষী সাব্যস্ত খুনি হামিদা জান্দৌবি ছিলেন শেষ ব্যক্তি যার গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ডে কার্যকর করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ হয় ফ্রান্সের রাজধানী কেন্দ্রিক এই শাস্তির প্রচলনের।

Feature Image: stock.adobe
তথ্যসুত্র:
01. 8 Things You May Not Know About the Guillotine.
02. Guillotine.