পৃথিবীর ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক কিছু পর্যটন স্থান

753
0

ভ্রমণপ্রিয় মানুষের সংখ্যা গুণে শেষ করবার মতো নয়। খাড়া পথ বেয়ে কিংবা উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে তারা ঠিকই পৌঁছে যায় নিজেদের গন্তব্যে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলো সাক্ষাৎ মৃত্যু বয়ে আনতে পারে। সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন কিছু দর্শনীয় স্থান আছে, যেখানে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তবেই পা রাখতে হয়। কিন্তু কেন? আর এত ভয়ঙ্কর হলে মানুষ কেন সেখানে যায়? কোন অমোঘ আকর্ষণ নাকি কোন মৃত্যুর হাতছানি? আজকের আয়োজনে থাকছে বিশ্বের শুধু ভয়ংকরই নয় বরং বিপদজনক কিছু পর্যটন স্থানের নাম। 

১. নরকের দরজা

কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? দুনিয়ার বুকেই আছে এক নরকের দরজা। তুর্কিমেনিস্থানের কারাকুম মরুভূমিতে দেখা মিলবে এই নরকের দরজার। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জ্বলছে এই বিশাল অগ্নিকুণ্ড। তার আগে কিন্তু এই আগুনের দেখা মেলেনি। কিন্তু কে জ্বালালো সেই অগ্নিকূপ? কেন জ্বালালো? কোন অতিমানবীয় কিছু? নাহ, ব্যাপারটা মোটেও তেমন কিছু নয়। ১৯৭১ সালে একদল জিওলজিস্ট একটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেন। স্থাপন করা হয় ক্যাম্প। মহাসমারোহে খনন কাজ শুরু করলে দেখা যায়, সেই ক্ষেত্র থেকে এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হচ্ছে। ভুলে সেই গ্যাসে ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন। আর এইটাই ছিল তাদের মস্ত ভুল। যে ভুলে খুলে যায় নরকের দরজা, যা আজও বন্ধ হয়নি। 

কারাকুম মরুভূমিতে অবস্থিত গোলাকার এই দরজার ব্যাস ৬৯ মিটার ও গর্ত ৩০ মিটার দীর্ঘ। বিশালাকার এই কূপ ৫০ বছর ধরে জ্বলছে, কিন্তু আজও একইরকম আছে। তুর্কেমেনিস্তান দেশটি খুব একটা জনবহুল কিংবা পরিচিত দেশ না। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড দর্শকদের আকর্ষণ করেই চলেছে। যদিও এই মৃত্যুকূপের কাছাকাছি যেতেও অনেক নিয়ম মানতে হয়। কারণ এর চারপাশে আগুনের তাপ ছড়াতে থাকে প্রতিনিয়ত। কেউ কেউ বলেছেন, এই কূপের কাছে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র বলে মনে হয়, মনে হয় অন্য জগতে আছি। তাই, এটিকে ডোর টু হেল বা নরকের দরজা কিংবা গেইটস অফ হেল নামেও ডাকা হয়ে থাকে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই অগ্নিকুণ্ড তাতে কিছু মনে করে না। আপন মনে সে জ্বলছে তো জ্বলছেই। 

নরকের দরজা। Image Source: alamy.com

২.  ব্রাজিলের সর্পদ্বীপ

স্বর্ণদ্বীপ না, সর্পদ্বীপ। পৃথিবীর বিপদজনক কিছু পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল এই সর্পদ্বীপ। ব্রাজিলের এই ছোট্ট দ্বীপটির আয়তন প্রায় ২০ মাইল। ব্রাজিল সরকার এই দ্বীপটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এই দ্বীপে হাজার রকমের সাপের দেখা মেলে। পৃথিবীর অন্যতম বিষধর সাপ, গোল্ডেন ল্যান্সড এর অভয়ারাণ্য এই দ্বীপটি। এছাড়াও আছে হরেক রকমের, হরেক প্রজাতির সাপ। যদিও এই দ্বীপে তেমন কেউ বাস আগেও করেনি, তবু ১৯২০ সালের দিকে কিছু মানুষ থাকতো। তাদের কাজ ছিল লাইট হাউজের আলো জ্বালানো। সর্বশেষ যে পরিবার ছিল, তারা সপরিবারে সাপের কামড়ে মারা যান। এরপর থেকে বসবাসের জন্য সেখানে কেউ যাননি।

১৯২০ সালে লাইট হাউজ অটোমেটড হয়ে যায়, যার ফলে সেখানে আর কারো থাকার প্রয়োজন পড়ে না। এই দ্বীপে সাপের দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি যে এমন প্রচলিত বাক্য আছে – সাথে ডাক্তার না নিয়ে যেন কেউ সেই দ্বীপে না যায়। প্রতি স্কয়ারফিটে একটা করে সাপের দেখা মিলবে। এই দ্বীপ মানুষের জীবন রক্ষার্থে কাজে লাগছে। অবাক হলেন? অবাক হবার মত কিছু নাই, এটাই সত্যি। এই সাপের বিষ থেকে তৈরি হবে ক্যান্সার, হৃদরোগসহ নানান ধরনের ওষুধ।  

ব্রাজিলের সর্পদ্বীপ। Image Source: ayupp.com

৩. এল কামিনেতো ডেল রে

পৃথিবীর বিপদজনক পর্যটন স্থানের তালিকায় চলুন এবারে ঘুরে আসি এল কামিনেতো ডেল রে নিয়ে। এই ডেল রে হলো স্পেনের মালাগা অঞ্চলের এক ভয়াবহ মৃত্যুপথ। মাটি থেকে প্রায় ৩০০ ফুট উপরে নির্মিত এক রাস্তা বা সড়ক। গাইতেনজিও আর এল জিও জলপ্রপাত সংস্কার কাজের সময় তৈরি করা হয় এই পথ। এই পথ তখন কাঁচামাল আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। এই পথের অন্য নাম ‘কিংস পাথ ওয়ে।’ ১৯২১ সালে অষ্টম কিং এলফেন্সো এই পথ খুলে দেন বলে এই নামে ঢাকা হয়। কিছুদিন এই পথ বন্ধ ছিল, কারণ চলাচল করতে গিয়ে মারা যায় বেশ কিছু দর্শক।

তবে সংস্কার করে এই পথ আবার সবার জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। বর্তমানের পথটা আগের দুটোর মতো অত ভয়াবহ হয়তো নয়। কিন্তু জানেন তো, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। হ্যাঁ, জায়গাটা অসম্ভব সুন্দরও বটে। ২৫ মাইল দীর্ঘ এই পথ পেরোতে আপনাকে ৪৫ ডিগ্রী খাঁড়া পথ বেয়ে চলা লাগবে। যদিও রাস্তা তৈরি করা আছে কিছু, তবুও বিপদ কি আর বলে কয়ে আসে? অতি সাবধানে এই রাস্তা পার হতে পারলেই আপনি অদ্ভুত সুন্দর কিছু সময় উপভোগ করতে পারবেন।  

এল কামিনেতো ডেল রে। Image Source: wellcomeinnnerja.com

৪. মাদিদি উদ্যান, বলিভিয়া 

এটা তো সবাইই জানে যে, বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর বন আমাজন জঙ্গল। অনেক বিষাক্ত সাপ-পোকা, আর মাকড়ের বাস সেখানে। আমাজনের মতো ভয়ঙ্কর কি কিছু আছে? এমন প্রশ্ন থেকেই বিশ্বের ভয়ংকর পর্যটন স্থানের মধ্যে চতুর্থ স্থান নিয়েছে বলিভিয়ার মাদিদি উদ্যান। এর সৌন্দর্যে দেখলে যে কেউ পাগল হয়ে যাবে। কি অদ্ভুত সবুজ বন আর নীলচে আকাশ। ভ্রমণপিয়াসী থেকে শুরু করে সব বয়েসের মানুষ দেখে পাগল হয়ে যাবে। তবে আছে মৃত্যু ঝুঁকি। 

কারণ সৌন্দর্যের বাইরে যা আপনাকে পাগল হতে, পঙ্গু হতে কিংবা পটল তুলতে সাহায্য করবে তা হল এখানকার বিষাক্ত উদ্ভিদ ও প্রাণী। প্রায় ৫০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৩৭০ প্রজাতির প্রাণী, আর ৮৯০ প্রজাতি পাখির বাস এখানটাতে। যদিও সেখানে অনেকে ঘুরতে যায়। তবে সবাইই যায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে। 

মাদিদি উদ্যান। Image Source: worldatlas.com

৫. ডানাকিল মরুভূমি 

মরুভূমিতে তাপমাত্রা কত হবে, বলতে পারবেন? আচ্ছা থাক! একে তাপমাত্রা অনেক বেশি, এমন মরুর বুকে যদি লাভার হ্রদ থাকে তাহলে কেমন হবে? শুনেছেন কি এমন কিছু? ইথিওপিয়ায় আছে এমন এক স্থান। এলিয়েনের এলাকা বলে অভিহিত করা এই মরুভূমিকে। কিছু কিছু আর্টিকেলে এটিকে ‘ডানাকিল ডিপ্রেশন‘ও বলা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৫০ ডিগ্রীর কাছাকাছি থাকে এই স্থানের তাপমাত্রা সবসময়। সায়েন্স ফিকশন মুভি কিংবা বই এর বর্ণনাতে এলিয়েনদের শহরের যেমন বর্ননা দেয়া রয়েছে, ঠিক সেরকম দেখতে এই মরু অঞ্চল।

সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৪০০ ফুট উঁচুতে এর অবস্থান। অনেক টুরিস্টদের মতে, এটা নাকি অন্য দুনিয়ার কোন এক স্থান যেটা ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছে। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কাছাকাছি সমুদ্রের জলের রঙ অদ্ভুত ধরনের। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। যেন অন্য এক দুনিয়া। তবে যতই ভয়ঙ্কর হোক, এ ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূত যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে বাধ্য আপনি।   

ডানাকিলের বিষণ্ণ সৌন্দর্য। Image Source: Eric Lafforgue / Art in All of Us / Corbis via Getty
Feature Image: Death Road by traveltriangle.com