ভুটান: বজ্র ড্রাগনের শান্তিময় স্বর্গরাজ্য

1079
0

দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের একটি ছোট্ট দেশ ভুটান। ভ্রমণের জন্য অনেক জনপ্রিয় একটি স্থান হিসেবে পরিচিত এই দেশটি। ছোট এই দেশটির আয়তন ৪৬,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। ভুটানের রাজধানী থিম্পু। ভারত ও চীন সরাসরি ভুটানের প্রতিবেশী দেশ। হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাংশে অবস্থিত ভুটান।

উত্তরে চীনের তিব্বত অঞ্চল, পশ্চিমে রয়েছে ভারতের সিকিম ও তিব্বত অঞ্চল আর চীন। পূর্ব ও দক্ষিনাংশেও ভারত। ভুটানের সবচাইতে বড় সীমানা ভারতের সাথে। কারণ প্রায় চারপাশ থেকেই ভারত ঘিরে রেখেছে এই দেশটিকে।  

সংস্কৃত ভাষার শব্দ “ভূ-উত্থান” থেকেই ভুটান শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ হলো উঁচু জমি বা ভূমি। ভুটানিদের মাতৃভাষা জংকা। তারা মাতৃভাষায় নিজের দেশকে বলে ড্রুক ইয়ুল; যার অর্থ বজ্র ড্রাগনের দেশ। ইংলিশে বলা হয় ল্যান্ড অফ পিসফুল থান্ডার ড্রাগনস। যার বাংলা অর্থ করলে আসে – বজ্র ড্রাগনদের শান্তিময় স্বর্গরাজ্য। ভুটানের জাতীয় পতাকায় তাই শোভা পায় ড্রাগন। 

ভুটানের আবহাওয়া ও জলবায়ু বেশ বৈচিত্র্যময়। এর মূল কারণ হচ্ছে ভুটানের উচ্চতা। অঞ্চলভিত্তিক উচ্চতা এই দেশটির আবহাওয়ায় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। ভুটানের দক্ষিণ অঞ্চলে উষ্ণ এবং আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর প্রভাব রয়েছে; যা সারা বছর একই রকম থাকে। এই অঞ্চলের তাপমাত্রা ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫৯- ৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর মধ্যে পরিবর্তিত হতে থাকে। 

ভুটানের আবহাওয়া ও জলবায়ু বৈচিত্র্যের মূল কারণ হচ্ছে ভুটানের উচ্চতা। Image Source: internationalaffairs.org.au

তবে ভুটানের মধ্য অঞ্চল নাতিশীতোষ্ণ। এর পেছনেও কারণ আছে। কারণ, এই অঞ্চলের বনজ সম্পদ। শীত ও গ্রীষ্মে এই অঞ্চলের আবহাওয়ার তারতম্য খুব বেশি হেরফের করে। ভুটানের উত্তরাঞ্চলে হিমালয় থাকায় শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থাকে আর গরমের সময়েও শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। 

একেক দেশের খাবার কিন্তু দেশভেদে একেক রকমের হয়ে থাকে। যেমন বাঙালিদের বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙালি। ঠিক তেমনই ভুটানেরও রয়েছে খাবার-দাবারে নিজস্বতা। ভুটানের খাবারের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ভুটানের খাবারের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা অনেক মশলাযুক্ত খাবার খায়। আর তাদের মসলার মূল অংশ হচ্ছে মরিচ। কারণ, বেশিরভাগ ভুটানি তাদের খাবারে অনেক বেশি ঝাল খেতে পছন্দ করে। 

ভুটানের লোকেরাও ভাত খেতে ভালোবাসে। তাই, তাদের মূল খাবার ভাত। ভাতের সাথে তারা গরু, মুরগি, মাছ, সবজি, ডাল ইত্যাদি খাবারের পদ নিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাদের কয়েকটি জনপ্রিয় খাবারের মধ্য রয়েছে রেড রাইস, মোমো, এমা দাশি, ফাকসা পা, জাশসা মারু ইত্যাদি। স্থানীয় জলবায়ুর উপর নির্ভর করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধান, বকোয়ুট ও বার্লি জাতীয় শস্যও চাষ করা হয়। 

সবুজের মায়ায় ঘেরা ভুটান। Image Source:americanstocknews.com

ইতিহাস ও রাজনীতি

ভুটানের ইতিহাস অন্য সব দেশ থেকে বেশ আলাদা। এই দেশটি একসময়ে অন্য সব দেশ থেকে আলাদা ছিল। এমনকি বিংশ শতাব্দী অবধি বিদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল এই ভূমিতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সাথেও সম্পর্ক উন্নতি হতে থাকে ভুটানের। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সামাজিক এবং প্রশাসনিক সংস্কারের নীতিগুলিরও পরিবর্তন আনে ভুটান। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রকৃতিগতভাবে এই অঞ্চলটি সমৃদ্ধ থাকায় প্রাচীনকাল থেকেই এখানে জনপদের বসবাস ছিল। ৯ম শতকের দিকে অনেক তিব্বতি বৌদ্ধ ভুটানে বসবাস শুরু করে আর তারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করে। ১৬০০ সালের পরে তিব্বত তিন বার ভুটান আক্রমন করে এবং সেই সময়ে তিব্বতি লামা নগাওয়ানা নামগিয়া আক্রমন থেকে ভুটানকে রক্ষা করেন।

এরপর থেকেই ভুটানের সকল জনগণ একত্রিত হয়ে কাজ শুরু করে। এমনকি তিনি বিভিন্ন নীতি ও আইন তৈরি করেন ভুটানের উন্নতির জন্য। এরপর ইতিহাসের পাতায় কাটতে থাকে সময়। উগিয়েন ওয়াংচুক, পরবর্তীতে তিনি আরো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে জোড় দেন।   

প্রথম ভুটান রাজা ও তার পরিবার Image source: holidify.com

উগিয়েন ওয়াংচুক ১৯০৭ সালে ভুটানের রাজা হন। ভুটানে পরম রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল যার সমাপ্তি ঘটে ২০০৮ সালে। ভুটান পরম রাজতন্ত্র থেকে সরে এসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও এর পাশাপাশি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। অন্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা হলেও দেশটির রাজা মূলত এই পথে হাঁটেন। তাই তো ভুটান বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ।

১৯১০ সালে রাজা উগিয়েন ভারত ও ব্রিটিশদের সাথে বিভিন্ন চুক্তি করেন। মূলত তখন থেকেই ভুটানের সাথে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হয় তখন ভুটানকেও স্বাধীন দেশের মর্যাদা দেওয়া হয়। একে একে আসতে থাকে বিভিন্ন রাজার পরিবর্তন। তবে সব রাজাই ছিলেন রাজা উগিয়েন ওয়াংচুক বংশধর। বর্তমানের ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকের পঞ্চম বংশধর। 

ভুটানের বর্তমান রাজা Image Source: officeholidays.com

ভুটানের রাজার উপাধি হচ্ছে ড্রাগন রাজা। ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, তিনি আগে ভুটানের রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন। কয়েকদিন আগেই তিনি বাংলাদেশ সফরে যান। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। 

সংস্কৃতি ও সবুজ প্রকৃতি

ভুটানের প্রধান ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ভুটানিদের কাছে তাদের সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এমনকি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও তারা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় মুল্যায়ন করে। প্রতি বছর টুরিস্টরা আসে ভুটানের সংস্কৃতি আর সবুজের সন্ধানে। 

দেশটির ৭০ শতাংশের বেশির ভাগ অঞ্চলই বনভূমি। ঠিক যেন সবুজের মায়ায় ঘেরা একটি দেশ। ভুটান বিশ্বের একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ। ভুটানের শিক্ষার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। তাদের শিক্ষার অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশ বিদ্যা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি সবুজ দেশের জন্য। 

২০০৯ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে সব দেশ একমত হয় যে, পরিবেশ রক্ষায় তারা কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনবে। তবে অন্যান্য সব দেশকে টপকে ভুটান এটা করে দেখিয়েছে। এই সম্মেলনের পর থেকেই ভুটান তাদের পরিবেশ নিয়ে আরো বেশি কাজ করা শুরু করে। ২০৩০ সালের মধ্যে ভুটান মোট শূণ্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং শূন্য বর্জ্য উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে নিজেকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করছে। 

ভুটান সংস্কৃতির উৎসব। Image Source: hithyoga.com

দর্শনীয় স্থান

ভুটান পর্যটকদের কাছে প্রচণ্ড জনপ্রিয় একটি দেশ। দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই মূলত বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ভুটানের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাদের অর্থনীতির অন্যতম একটি চালিকাশক্তি হচ্ছে পর্যটন শিল্প। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় জমতে থাকে ভুটানে। কারণ এই সময়টাই ভুটান ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়। 

ভ্রমণের জন্য ভুটানের রাজধানী থিম্পু বেশ জনপ্রিয়। থিম্পুতে দেখার মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল তাকিন সংরক্ষিত চিড়িয়াখানা, সিটি ভিউ পয়েন্ট, থিম্পু জং, বুদ্ধ দর্দেনমা স্ট্যাচু, ন্যাশনাল মিউজিয়াম ভুটান ইত্যাদি। থিম্পু ছাড়াও আরো কিছু দর্শনীয় অঞ্চল রয়েছে ভুটানে, যার মধ্য অন্যতম পুনাখা, পারো, চেলে লা পাস এবং বুমথাং।

ভুটানের রাজধানী থিম্পু। Image source:britannica.com

ভুটান দেশটি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মত নয়। কিন্তু তারা তাদের প্রকৃতি দিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে একটি সুন্দর সবুজ বিশ্ব উপহার দেওয়ার আশায়। সবাই যখন শ্রমিক দিয়ে কার্বন ব্যয় করে অর্থ আয়ে ব্যস্ত; তখন ভুটান সবার থেকে আলাদা হয়ে কার্বন নেগেটিভ রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করছে, একাই। তাই, টেকসই উন্নয়নের একটি রোল মডেল হচ্ছে ভুটান। 

Feature Image: Mantosh/Getty Images
তথ্য সুত্রসমূহ:

01. Bhutan.
02. Kingdom of Bhutan.
03. Bhutan Country Profile.
04. Bhutan Carbon Negative Country.
05. History of Bhutan.