গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯২৭-২০১৪) একজন কলম্বিয়ান লেখক, যিনি বর্ণনামূলক জাদু বাস্তব ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এবং লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে সমাদৃত করায় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন তার বিশ্বখ্যাত উপন্যাস “One Hundred Years of Solitude ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড” এর জন্যে।
জাদুবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরণের আখ্যানমূলক কথাসাহিত্য, যেখানে চমৎকার সব উপাদানগুলো সাধারণ জীবনের এক বাস্তব চিত্রতে ফুটিয়ে তোলে। ভূত আমাদের মাঝেই হাওয়ায় ভেসে চলাচল করে – ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য কিংবা হাস্যকর মনে হলেও জাদুবাস্তবতায় এই ব্যাপারটাকে গদ্যশৈলীর মাধ্যমে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তুলা হয়।
যেমন গার্সিয়া মার্কেজ বলেন তার কল্পিত মাকোন্দো শহরে পাপের ফল হিসেবে শুয়োরের লেজযুক্ত মানুষের জন্ম হয়; কিংবা একটানা চার বছর এগার মাস দুই দিন ধরে অঝোর ধারায় ঝরে পড়ে বৃষ্টি; অথবা যে জগতে অনিদ্রা রোগ হচ্ছে সবার নিত্যদিনের সঙ্গী।
জীবনযাপন
গ্যাব্রিয়েল হোসে দে লা কনকর্ডিয়া গার্সিয়া মার্কেজের জন্ম ক্যারিবিয়ান উপকূলের নিকটবর্তী কলম্বিয়ার আরাকাতাকা শহরে মার্চ মাসের ৬ তারিখ ১৯২৭ সালে। গার্সিয়া মার্কেজ, গাবো নামেই বিশেষভাবে পরিচিত এই লেখক ছিলেন ১২ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। বাবা ছিলেন ডাকবিভাগের কেরানি, কখনো টেলিগ্রাফ অপারেটর, কখনো ভ্রমণপ্রেমী এক ফার্মাসিস্ট। যখন গাবোর বয়স ৮ বছর, তখন তার পরিবার অন্যত্র চলে যায় যেন তার বাবা নতুন কোন জায়গায় একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারে।
তবে ভগ্নপ্রায় এক বাড়িতে গাবোকে রেখে যাওয়া হয় তার দাদা-দাদীর সঙ্গে। তার দাদা নিকোলাস মার্কেজ মেসিয়া, থাউজ্যান্ড ডেইস ওয়ার বা হাজার দিনের যুদ্ধের অন্যতম সক্রিয় কর্মী এবং একজন কর্নেল ছিলেন। আর তার দাদী জাদুতে বিশ্বাস করতেন আগে থেকেই। তিনিই তার নাতির মাথার মধ্যে যত পৌরাণিক, লৌকিক গল্প, ভূতের গপ্পো কিংবা অবিশ্বাস্য অথচ উপভোগ্য এমন সব গল্প দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে দ্য আটলান্টিকে প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন যে – তিনি সর্বদাই আপাদমস্তক একজন লেখক ছিলেন। তা অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায় তার রচনা বিশ্লেষণ করলেই – তার শৈশবের সকল স্মৃতি কিংবা উপাদানই কোনো না কোনোভাবে তার রচনায় মিশে গেছে কোনো না কোনো চরিত্রের সঙ্গে। ইতিহাস, রহস্য এবং রাজনীতির এমন মিশেল দেখে চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা তার রচনাকে সার্ভেন্টেসের ডন কুইকসোট এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
লেখালেখির শুরু
জেসুইট কলেজ থেকে পড়াশুনা চুকিয়ে ১৯৪৬ সালে গার্সিয়া মার্কেজ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বোগোটোতে আইন বিভাগে ভর্তি হন। দুনিয়ার আর ৮/১০ জন পাঠকের মতোই ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস গল্পটা গাবোকেও দারুণভাবে আন্দোলিত করে। আর সেই সময় অসাম্প্রদায়িক ধারায় পরিচালিত ম্যাগাজিন “এলএক্সপেক্তেদর” এর সম্পাদক এক মতামতে লিখেছিলেন যে কলম্বিয়াতে কোন প্রতিভাবান তরুণ লেখক নেই। এই কথার জবাবে গার্সিয়া মার্কেজ তার একগুচ্ছ ছোট গল্প পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সম্পাদকের ঠিকানায়। সম্পাদক তা প্রকাশও করে ফেললেন।
কলম্বিয়া থেকে নির্বাসন
১৯৫৪ সালে গার্সিয়া মার্কেজ একজন সংবাদকর্মী হিসেবে দারুণ একটি খবর ছড়িয়ে দেন পুরো দেশ জুড়ে। নৌবাহিনীর বিধ্বস্ত আর ধ্বংসকারী এক জাহাজে একজন নাবিকের বেঁচে থাকার করুণ কাহিনী ছিল সেটা। এমন অবস্থার কারণ হিসেবে ঝড়কে দর্শানো হলেও নাবিক চোরাচালানকে দায়ী করে। শুরুতে ধারাবাহিক কিস্তিতে প্রকাশ পেলেও পরের বছরই তা বই আকারে প্রকাশ পায়।
১৯৫৫ সালে “The Story of a Shipwrecked Sailor দ্য স্টোরি অফ অ্যা শিপর্যাকড সেইলর” নামে প্রকাশ পায়। নৌবাহিনীর একটি জাহাজ অতিরিক্ত চোরাচালানি পণ্যের ভারে ডুবে গিয়েছিল আর সেই সংবাদটাকেই গল্পে রূপ দিয়েছিলেন গাবো। গল্পের প্রধান চরিত্র ছিল স্বয়ং জাহাজের বেঁচে যাওয়া এক নাবিক ভ্যালেসকো।
বইটা সেই সময় তেমন কোনো সম্পাদক বা সাহিত্যিকদের নজর কাড়তে পারেনি। তবে মার্কেজ পরিণত হন কলম্বিয়ান সরকারের চক্ষুশূলে। যেজন্য মার্কেজকে কলম্বিয়া ছেড়ে ইউরোপে চলে যেতে হয়েছিল। ওখানেই তিনি সংবাদ, ম্যাগাজিনের জন্য প্রতিবেদন আর ছোট গল্প লেখা শুরু করেন।
বিবাহ ও পরিবার
১৯৫৮ সালে মার্সিডিজ বার্চো পার্দোকে বিয়ে করেন গার্সিয়া। তাদের দুই সন্তান। ১৯৫৯ সালে জন্ম নেয়া রড্রিগো যিনি বর্তমানে আমেরিকার টিভি ও সিনেমার পরিচালক; আর অন্যজন ১৯৬২ সালে মেক্সিকোতে জন্ম নেয়া গঞ্জালো যিনি বর্তমানে একজন গ্রাফিক ডিজাইনার।
রাজনৈতিক সক্রিয়তা
নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত মার্কেজ আজীবনই এক সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বন্ধুবর ছিলেন। হাভানায় লা প্রেনসার হয়ে লিখেছেন তিনি এবং সদস্যপদ ছাড়াই কলম্বিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছেন সর্বদা।
নিঃসঙ্গতার একশো বছর (১৯৬৭)
নিঃসঙ্গতার একশো বছর লেখার পেছনেও রয়েছে আরেক গল্প। আঠারো বছর বয়সেই এরকম এক উপন্যাস লেখার ইচ্ছা পোষণ করেন গাবো। মূলত, তাঁর নানা বাড়ির এলাকা এবং এর আশেপাশের আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকেই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি উপন্যাসে। কিন্তু কোনোভাবেই লিখতে পারছিলেন না, যা তিনি লিখতে চাচ্ছিলেন। এরপর তিনি নিজেকে স্থির করেন সঠিক সময়ের অপেক্ষায়। শুরু হলো তাঁর প্রতীক্ষার পালা।
অনেক বছর পর, মেক্সিকো সিটি আকাপুলকো যাওয়ার পথে গার্সিয়া মার্কেজ তার বিখ্যাত রচনাকর্মের ধারণাটি পেয়েছিলেন। এই পাণ্ডুলিপি লিখতে তিনি ১৮ মাস সময় নিয়েছিলেন; সেই সময় তার পরিবার ১২ হাজার ডলারের ঋণে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবে শেষমেশ তিনি এই পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করেন যা প্রায় ১৩০০ পৃষ্ঠা ছিল। প্রথম স্প্যানিশ সংস্করণটা এক সপ্তাহেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর পরবর্তী ৩০ বছরে এটি ৩০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয় এবং অনূদিত হয় ৩০ এর অধিক ভাষায়।
তার নিজের শহর আরাকাতাকার উপর ভিত্তি করে একটা কল্পিত শহর মাকোন্দো সৃষ্টি করেছিলেন তিনি এই রচনায়। আর এই গল্পের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এবং তার স্ত্রী উরসুলার এই শহরের গোড়াপত্তন এবং তাদের পরবর্তী পাঁচ প্রজন্মকে কেন্দ্র করে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া চরিত্রটি আসলে তার আপন দাদাজানের উপর ভিত্তি করে গড়া।
গল্পের উপাদানগুলি চমৎকার, যেমন – অনিদ্রার মহামারী, ভূতেরাও বৃদ্ধ হয়ে যায়, একজন যাজক যিনি এক গ্লাস গরম চকলেট খেয়ে আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করেন, এমন একজন মহিলা যিনি ধোপাখানার কাজ করতে করতে স্বর্গপানে চলে গেছেন এবং চার বছর এগার সপ্তাহ এবং দুইদিন ব্যাপী একটানা বৃষ্টি।
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস
১৯৭৫ সালে স্বৈরাচারী শাসক অগাস্টিন পিনোশে চিলির ক্ষমতায় আসে এবং মার্কেজ তখন প্রতীজ্ঞা করেছিলেন যে, পিনোশে ক্ষমতাচ্যুত হবার আগ অবধি তিনি আর কোন উপন্যাস লিখবেন না। পিনোশে ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন এবং মার্কেজ বুঝতে পারে যে তিনি আসলে না লিখে সমালোচনার সুযোগ থেকে রেহাই দিচ্ছে।
পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে তার বাল্যকালের এক বন্ধুর হত্যার ভয়াবহ বিবরণ দিয়ে তিনি “Chronicle of a Death Foretold ক্রনিকলস অফ অ্যা ডেথ ফোরটোল্ড” প্রকাশ করেন। প্রধান চরিত্রকে শহরের মাঝে কুপিয়ে হত্যা করা হয়; এমনকি শহরটা আগে থেকেই জানতো এমন কিছু একটা হবে। কিন্তু কেউ তা থামায়নি, কেউ প্রতিবাদ করেনি।
আর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় “Love in the time of Cholera লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা।” এটি ছিল একটি রোমান্টিক উপাখ্যান। যেখানে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে একে অপরের কাছ থেকে দূরে আছেন। কলেরা শব্দটাকে মূলত এখানে একইসঙ্গে ব্যাধি এবং ক্রোধ হিসেবে দেখানো হয়েছে; যার চূড়ান্ত পরিণতি যুদ্ধের দিকেই মানুষকে ধাবিত করে।
২০০৪ সালে তাঁর শেষ উপন্যাস প্রকাশিত হয় “Memories of my Melancholy Whores মেমোরিস অফ মাই মেলাঞ্চোলি হোরস” নামে। যেখানে এক ব্যক্তি তার জীবনের ৯১ তম জন্মদিনে পতিতালয়ের সদ্য কিশোরীকে ভোগের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে নিজের বাসায়। কিন্তু চাঁদের আলোয় কিশোরী চেহারা দেখে প্রেমে পড়ে যায় সে।
চিরবিদায়
১৯৯৯ সালে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লিম্ফোমাস ক্যানসার ধরা পড়ে। তাও লেখালেখি চালিয়ে যান তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এবং ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ মেক্সিকো সিটিতে মারা যান তিনি।
সাহিত্যকর্ম
- ১৯৪৭: “আইস অফ অ্যা ব্লু ডগ Eyes of a Blue Dog.”
- ১৯৫৫: “লিফস্টর্ম Leafstorm,” এক ডাক্তারের লাশকে দ্রুত দাফন করতে চাচ্ছে তাঁর পরিবার; কেননা যার অতীত ইতিহাস পুরো শহরকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
- ১৯৫৮: “নো ওয়ান রাইটস টু কর্ণেল No One Writes to the Colonel,” একজন সামরিক কর্মকর্তা তাঁর পেনশনের টাকা পাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়।
- ১৯৬২: “ইন ইভিল আওয়ার In Evil Hour,” ১৯৪০ ও ৫০ এর দশকের কলম্বিয়ার বিক্ষুব্ধ সময়গুলোকে নিয়ে লেখা।
- ১৯৬৭: “ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড One Hundred Years of Solitude.”
- ১৯৭০: “দ্য স্টোরি অফ শিপর্যাকড সেইলর The Story of a Shipwrecked Sailor,” নৌবাহিনীর চোরাচালানের স্ক্যান্ডাল।
- ১৯৭৫: “অটাম অফ পেট্রিয়ার্ক Autumn of the Patriarch”, এক সামরিক শাসকের দুই দশকের স্বৈরাচারী শাসন।
- ১৯৮১: “ক্রনিকল অফ অ্যা ডেথ ফোরটোল্ড Chronicle of a Death Foretold.”
- ১৯৮৬: “লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা Love in the Time of Cholera.”
- ১৯৮৯: “দ্য জেনারেল ইন দ্য ল্যাবিরিন্থ The General in the Labyrinth.”
- ১৯৯৪: “লাভ অ্যান্ড আদার ডিমন্স Love and Other Demons.”
- ১৯৯৬: “নিউজ অফ অ্যা কিডন্যাপিং News of a Kidnapping.”
- ২০০৪: “মেমোরিস অফ মাই মেলেঞ্চোলি হোরস Memories of My Melancholy Whores.”
Feature Image:
তথ্যসূত্রসমূহ: