ভার্সাই প্রাসাদ, ফরাসী রাজপরিবারের সাবেক আবাসস্থল এবং সরকারের কেন্দ্রভূমি; যা বর্তমানে দেশটির একটি জাতীয় নিদর্শন। এটি ফ্রান্সের উত্তর দিকে ইলে-ডি-ফ্রান্স অঞ্চলের অন্তর্গত ভার্সাই এলাকাতে অবস্থিত। যা প্যারিসের দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০ মাইল (১৬ কিলোমিটার) দূরে। এই ভবনের স্থাপত্যিক নিদর্শন এবং রাজনৈতিক ইতিহাস ফরাসীদের উপর দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। উল্লেখ্য, ভার্সাই বন্দোবস্ত এই রাজকীয় প্রাসাদের পাশেই সম্পন্ন হয়েছিল। তবে রাজকীয় ক্ষমতায় যাবার আগে শহরটি কেবল একটি গ্রাম্য বাজারের মতোই ছিল। ফরাসী বিপ্লবের সময় থেকেই ধীরে ধীরে এই শহর বৃহত্তম নগর কেন্দ্রের একটি হয়ে উঠে।
ফ্রান্সের রাজা-মহারাজারা এই জায়গার প্রতি এতটা উৎসুক হবার পেছনের কারণ ছিল এই মাটির উর্বরতা। লুই ত্রয়োদশ, যিনি এখানটাতে ১৬০১-১৬৪৩ অবধি ছিলেন, জমি কিনে একটা দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন; এবং বের হয়ে পড়েছিলেন শিকারে। সেই সময়টাতে ভার্সাইয়ের আশেপাশে চাষাবাদ তেমন একটা করা হতো না। ফলে বণ্য প্রাণীদের আনাগোনা ছিল ব্যাপক। তাই শিকার করার একটি আদর্শ স্থান ছিল এই ভার্সাই। আর সেই সুবাদেই ত্রয়োদশ লুই দূর্গ নির্মাণে উৎসুক হয়েছিলেন।
ঠিক দূর্গ বলা উচিত হবে না। মোটের উপর শিকারে বের হয়ে অস্থায়ী তাবুর বদলে তিনি ছোটখাটো একটা লজ নির্মাণ করেছিলেন। কেবলমাত্র রাজা এবং তার অনুগামীদের থাকার ব্যবস্থা বলা চলে আর কি! পরবর্তীতে তার উত্তরসূরি, রাজা চতুর্দশ লুই, যিনি সান কিং নামেও পরিচিত কেননা সূর্য ছিল তার প্রতীকচিহ্ন। কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং এই ভার্সাইকে ফ্রান্সের সরকারের আসন দেয়। ১৬৮২ সালে ভার্সাই প্রাসাদকে সরকারী আবাসস্থল এবং ফ্রান্স আদালতের সরকারী বাসভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ত্রয়োদশ লুইয়ের নির্মিত সাধারণ একটা লজকে রাজকীয় এক প্রাসাদে পরিণত করেছিলেন চতুর্দশ লুই।
ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে নামীদামী সব স্থপতি, ডিজাইনার এবং কারিগরদের নিয়ে আসেন তিনি এই ভার্সাইতে। নির্মাণ করান এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। দুটি আলাদা ভবন যুক্ত করেন মূলভবনের সঙ্গে, প্রায় দুই হাজার কক্ষ, বিস্তৃত উদ্যান, ঝর্ণা, ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা, রোমান শৈলীর স্নানাগার এবং একটি লিফট সংযোজন করান তিনি। সেই সময়টায় যখন তার প্রজারা কেবল একটা খুপরি ঘরে জীবনযাপন করতো, তখন লুই হল অফ মিরর তৈরির জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছেন; আর তাই এই বারোক শৈলীর নান্দনিকতা আজো কেমন জাজ্বল্যমান।
প্রাসাদের পূর্বদিকে প্লেস ডি’আর্মস, একটি বিস্তৃত প্লাজা যা মূলত ভার্সাইতে আসা নিত্যদিনের হাজার হাজার পর্যটকদের থাকার বিশেষ করে গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা দেয়। প্লেস ডি’আর্মসের কেন্দ্রে, অ্যাভিনিউ ডি প্যারিসের মুখে, চতুর্দশ লুইয়ের অশ্বারোহী একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি স্থাপিত। মূলত মূর্তিটি কোর্ট অব হনারের চূড়ায় ছিল পূর্বে; ২০০৯ সালে সংস্কার করার সময় এটিকে স্থানান্তরিত করা হয়। পশ্চিম দিকে গেট অব হনার, সোনায় মুড়ানো একটি লোহার গেট এবং পাথরের একটি কার্নিশ যা প্রাসাদ কমপ্লেক্সের সঙ্গে মূল প্রবেশদ্বারকে চিহ্নিত করে। ঠিক এর পেছনেই কোর্ট অব হনারের বর্ধিত স্থান, যা উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মিনিস্টার উইং দিয়ে ঘেরা; এই ভবনগুলো ১৬৮০ এর দশকে নির্মিত, রাজার সেক্রেটারি অফ স্টেটসের জন্য।
পূর্বে যেখানটায় রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মূর্তিটি স্থাপিত ছিল সেখানেই রয়্যাল গেট, মূলত সোনার পাতা দিয়ে সজ্জিত দরজা, যা রয়্যাল কোর্ট আর কোর্ট অব হনারকে আলাদা করে দিয়েছে। বর্তমান রয়্যাল গেটটি মূলত একটি রেপ্লিকা মাত্র; কেননা, ১৬৮০ সালে নির্মিত মূল গেটটি ফরাসী বিপ্লবের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও রয়্যাল গেটটির আধুনিক সংস্করণ নিয়ে অনেক বাকবিতণ্ডা আছে; কিন্তু পর্যটকদের নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করার জন্য এর অবদান অনস্বীকার্য।
রয়্যাল কোর্টের পাশ ঘেরা দক্ষিণ দিকে ডুফুর প্যাভিলিয়ন আর উত্তরে গ্যাব্রিয়েল প্যাভিলিয়ন। এই দুটো জায়গাই দর্শকদের অভ্যর্থনা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ব্যাপকভাবে পুনঃনির্মান করা হয়েছে। রয়্যাল কোর্টের পরেই মার্বেল কোর্ট; মূলত বারান্দার মতো প্রশস্ত জায়গাটুকুর পুরো জমিনটা জুড়ে সাদা আর কালো মার্বেল টাইলস থাকার কারণেই এমন নামকরণ। বেশ কয়েকটি আবক্ষ মূর্তি যা মার্বেল দ্বারা নির্মিত; রোমান দেবদেবতা এবং সম্রাটদের প্রতিকৃতি, যা কোর্টের সম্মুখভাগটাকে দারুণভাবে সজ্জিত করে রেখেছে এবং প্রাসাদ কমপ্লেক্সের কেন্দ্রীয় ভবনগুলো এগুলোর চারপাশ থেকেই উত্থিত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ভবনের নিচতলা সম্পূর্ণভাবে রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত। ডোফেন, ডাউফিন এবং রাজা চতুর্দশ লুইয়ের কন্যার ব্যক্তিগত কক্ষও রয়েছে এখানটাতে। উল্লেখ্য, ফ্রান্সের রাজপরিবারের রাজার উত্তরসূরি বা সিংহাসনের দাবীদার অথবা রাজপুত্রকে ডোফেন এবং রাজবধুকে ডাউফিন বলে সম্বোধন করা হয়। ফরাসী রাজপরিবারের শেষ রাণী, ম্যারি-অ্যান্টয়েনেটের ব্যক্তিগত কামরাও আছে সংরক্ষিত এখানে। তাছাড়া, রক্ষীদের ক্যাপ্টেনের কামরাও আছে এখানটাতে।
প্রথম তলায় রাজা এবং রাণীর জন্য অতিশয় দারুণ দুটি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া, অতিথি এবং আদালতের সদস্যদের বিনোদনের সুব্যবস্থায় সেলুন বা বৈঠকখানা রয়েছে বেশ কয়েকটি। বুল’স আই সেলুন, স্বতন্ত্র ডিম্বাকৃতির জানালার জন্যই এমন নামকরণ, মূলত সাক্ষাতের কক্ষ যেখানে সবাই রাজার অপেক্ষা করতো। এখান থেকে সোজা চলে যাওয়া যায় শয়নকক্ষে যেখানে রাজা চতুর্দশ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। পরবর্তীতে ১৭২২ থেকে ১৭৩৮ সালে পঞ্চদশ লুই এটি দখল করে নেয়।
সম্ভবত এই প্রাসাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় কক্ষ হচ্ছে হল অফ মিরর; যা ১৬৭৮ থেকে ১৬৮৯ সালের মধ্যে নির্মিত। গ্যালারিটি প্রায় ২৩০ ফুট (৭০ মিটার) পর্যন্ত প্রসারিত। ১৭টি বিশাল জানালার বিপরীতে ১৭টি প্রশস্ত তোরণযুক্ত আয়না দেয়াতে এর সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে অবর্ণনীয়। প্রতিটি খিলানে রয়েছে কাঁচের ঝাড়বাতি, পুরো সিলিং শোভা পাচ্ছে রঙিন চিত্রকর্ম, যেখানে লে ব্রুন নামক শিল্পী রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বের শুরুর দিকে গৌরবময় ৩০টি চিত্র তুলে ধরেছেন। সোনায় মুড়ানো মূর্তি এবং মার্বেলের দেয়ালে দেয়া কারূশিল্পের কারুকাজ সত্যিই চোখধাঁধানো। এই হলটি একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে একপাশে রয়েছে সেলুন অফ পিস এবং সমানভাগে অন্যপাশে সেলুন অফ ওয়ার।
উত্তর শাখায় প্রাসাদের চ্যাপেলটি স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। এই চ্যাপেলের কাজ শুরু হয়েছিল ১৬৯৯ সালে। ১৭১০ সালে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নিত্যদিনের প্রার্থণা ছাড়াও রাজকীয় বিবাহ এবং ব্যাপ্টিজমের কারণে ব্যবহার হতো এই চ্যাপেলটি। উত্তর শাখাতেও গ্যালারী, সেলুন এবং থাকার কক্ষ রয়েছে। উত্তর শাখার একদম শেষপ্রান্তে অপেরা রয়্যাল; যা রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের সময়ে নির্মিত। ষোড়শ লুইয়ের বিবাহের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল এটি। ১৮৭৫ সালে তৃতীয় বারের মতো প্রজাতন্ত্র ঘোষণার আগ অবধি রয়্যাল অপেরা হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতো।
দক্ষিণ শাখাকে সংক্ষেপে “দ্য প্রিন্সেস উইং” নামেও ডাকা হয়। এই অংশটি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। আর নীচের তলাতেই রয়েছে হল অব কংগ্রেস; যেখানে ১৮৭৬ থেকে ১৮৭৯ অবধি চেম্বার অফ ডেপুটিরা মিটিং করতো। দ্বিতীয় তলার বেশিরভাগ অংশজুড়েই ব্যাটেল গ্যালারী। রাজা প্রথম ক্লোভিসের সময়কাল থেকে নেপোলিয়ন অবধি ফ্রান্সের সামরিক ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া যাবে এখানে। অসংখ্য চিত্রকর্ম এবং রুমজুড়ে থাকা মহান সেনাপতিদের আবক্ষ মূর্তি, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সব যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিবে নিমেষেই।
ভার্সাই প্রাসাদ অনিন্দ্য সুন্দর হবার পেছনে এর বাগানগুলোরও অবদান কম নয়। সোপানের পশ্চিম দিকে ল্যাটোনা ঝর্ণা। ঝর্ণাটিতে মুলত অভিডের দ্য মেটামরফোসিসের চিত্রিত রূপ ফুটিয়ে তুলা হয়েছে। দ্য রয়্যাল ওয়াক পশ্চিম দিকে অনেকদূর অবধি প্রসারিত। ঘাসের কার্পেট বিছানো লম্বা রাস্তায় দুই পাশে সারি সারি বড় গাছ এবং শেষপ্রান্তে ফাউন্টেন অব অ্যাপোলো নামক নান্দনিক সুন্দর এক ঝর্ণা। ঝর্ণার পরে হাঁটার রাস্তাটা খাল অবধি সম্প্রসারিত। রাজাদের আমলে গণ্ডোলা চলাচল করলেও বর্তমানে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে ছোট নৌকা বিশেষ।
সোপানের উত্তর দিকে শোভাময় এক বিস্তীর্ণ উদ্যান যা পানি পথের দিকে প্রসারিত। এবং তা গিয়ে শেষ হয়েছে ড্রাগন ফাউন্টেন ঝর্ণায়। পুরোটা পথই ব্রোঞ্জের মূর্তি এবং জ্যামিতিক আকারে ছাঁটা গাছে শোভিত। মজার বিষয় হচ্ছে, এই ঝর্ণায় যে পানির ফোয়ারা রয়েছে তা প্রায় ৯০ ফুট (২৭ মিটার) উঁচু অবধি উঠে যায়। পাশেই আবার রয়েছে নেপচুন ফাউন্টেন। পুরো পার্কের পায়ে হাঁটা পথ আর সড়কজুড়েই ভাষ্কর্য, ফুলদানি, সুন্দর করে ছাঁটা গাছ ইত্যাদি দিয়ে সজ্জিত। তাছাড়া, কৃত্রিম জলপ্রপাতও রয়েছে সৌন্দর্য বর্ধণের জন্য। রয়েছে একটি ছোটখাটো গোলকধাঁধাও।
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ এই রাজকীয় দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদটি। এত দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ, উপরন্তু এত বিশাল কর্মযজ্ঞের ইতিহাস, খুব কম রাজকীয় প্রাসাদেরই আছে। তাই, ভার্সাই প্রাসাদ নিজ সৌন্দর্যে অমলিন। ভার্সাইয়ের প্রতিটি ধূলিকণায় অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের খোঁজ মিলে। আর তাই তো, পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসে এই প্রাসাদ নান্দনিক স্থাপত্যিক সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে।
Feature Image: Shannon Shipman
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Palace of Versailles.
02. Palace of Versailles: Facts & History.