রোম: প্রাচীন এক শহরের ইতিকথা (শেষ পর্ব)

1891
0

গত পর্বের পর … 

সাম্রাজ্য

জুলিয়াস সিজার ক্ষমতায় বসেই প্রজাতন্ত্র ত্যাগ করে সিনেটদের দিয়ে নিজেকে স্বৈরশাসক বলে ঘোষণা দেন। জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। আর তাছাড়া, রোমের জন্য শক্তিশালী ও স্থিতিশীল একটা সরকার গঠনে তাঁর প্রচেষ্টা রোমের সমৃদ্ধি বিকাশের অন্যতম কার্যকরী একটা পন্থা ছিল। রোমের জন্য অনেককিছু করা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আদতে একজন স্বৈরশাসক। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে সিনেট কর্তৃক এক আততায়ীর হাতে খুন হন তিনি। সিজারকে হত্যার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল,  জুলিয়াস সিজার দিনকে দিন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। 

আর নগরে এমন একটা গুঞ্জন ছিল যে, তিনি হয়তো সিনেট বিলুপ্ত করে দিতে পারেন। এই ভয়েই সিনেটের ষড়যন্ত্রেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সিজারের মৃত্যুর পর তাঁর ডানহাত এবং চাচাত ভাই মার্কাস অ্যান্টোনিয়াস (মার্ক অ্যান্টনি) সিজারের উত্তরাধিকারী, ভাগ্নে গাইউস অক্টাভিয়াস থুরিনাস (অক্টাভিয়ান) এবং সিজারের বন্ধু মার্কাস অ্যামেলিয়াস লেপিডাস – সম্মিলিতভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৪২ সালে ফিলিপ্পির যুদ্ধে ব্রুটুস ও ক্যাসিয়াসকে পরাজিত করে। 

তিনজন মিলে দ্বিতীয় ট্রায়ামব্রাট গঠন করে এবং প্রথমটির মতোই তারা সবাইও উচ্চাভিলাষী ছিলেন। অ্যামেলিয়াসকে উত্তর আফ্রিকা এবং হিস্পানিয়ার শাসনকার্য দেয়ার কথা রোমের শাসক পদ থেকে সুকৌশলে সরিয়ে দেয় অ্যান্টনি এবং অক্টাভিয়ান। অক্টাভিয়ান পশ্চিমের রোমান ভূমি এবং অ্যান্টনি পূর্বের রোমান ভূমি শাসনের দায়িত্ব নেয়। অ্যান্টনি অষ্টম ক্লিওপেট্রার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে অক্টাভিয়ান বেশ রাগান্বিত হয়। ফলশ্রুতিতে দুজন যুদ্ধে নামে একে অপরের বিরুদ্ধে। 

দ্বিতীয় ট্রায়ামব্রাটের বাম থেকে অক্টাভিয়ান, অ্যান্থনি এবং লেপিডাস। Photos by brewminate.com

খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালে অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে অ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্রার সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। পরে তারা দুজনেই আত্মহত্যা করে। ফলশ্রুতিতে, রোমের একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী হয় অক্টাভিয়ান। খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে তিনি সিনেট কর্তৃক অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হন এবং রোমের প্রথম সম্রাট হিসেবে নিজেকে অগাস্টাস নাম দেন। ইতিহাসবিদদের ধারণা মতে, এটাই ছিল রোমের ইতিহাসের শেষ এবং রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের শুরু। 

রোমান সম্রাটদের ইতিবৃত্ত

অগাস্টাসের শাসনের মাধ্যমেই টানা এক শতাব্দী ধরে চলতে থাকা বিশৃঙ্খলা এবং দুর্নীতি কাটিয়ে উঠে, রোম নিজের পুরনো ঐতিহ্য আর মনোবল ফিরে পায়। বিখ্যাত প্যাক্স রোমানাও এই সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় – যা দুই শতাব্দী ধরে শান্তি আর সমৃদ্ধি বজায় রেখেছিল। সম্রাট অগাস্টাসের হাত ধরেই সামাজিক সংস্কার, অসংখ্য সামরিক বিজয় এবং রোমান সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি আর ধর্ম বিকাশ লাভ করেছিল। ৫৬ বছরের শাসনকালে অগাস্টাস একদল ভক্ত তৈরি করেছিল; যারা তার মৃত্যুতে তাকে ঈশ্বরের মর্যাদা দিয়েছিল। অগাস্টাসকে দেবত্বারোপ করার মাধ্যমেই সম্রাটকে ঈশ্বরের মর্যাদা দেয়ার ঐতিহ্যের প্রচলন হয়েছিল। 

অগাস্টাসের রাজবংশে আরো ছিলেন অ-জনপ্রিয় সম্রাট টাইবেরিয়াস (১৪-৩৭ খ্রিস্টাব্দ), অস্থির আর উন্মাদ সম্রাট ক্যালিগুলা (৩৭-৪১) এবং ক্লডিয়াস (৪১-৫৪) – যিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তার সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্রিটেন বিজয়ের জন্য। শেষ উত্তরাধিকারী ছিলেন সম্রাট নিরো (৫৪-৬৮), যার বাড়াবাড়িতে রোমের কোষাগার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তার পতন হয়েছিল এবং শেষমেশ তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। নিরোর মৃত্যুতে সাম্রাজ্য অস্থিরতায় পর্যবসিত হলে পরপর চারজন সম্রাট সিংহাসনে আরোহণ করেন।

চতুর্থ সম্রাট হিসাবে ছিলেন ভেস্পাসিয়ান (৬৯-৭৯) এবং তার উত্তরসূরি টাইটাস এবং ডোমিশিয়ান, ফ্ল্যাভিয়ান নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন তারা। রোমান কোর্টের আধিক্যতা কমাতে সিনেটের পুনরুদ্ধার এবং জনকল্যাণের প্রচার করেছিল তারা। এদের মধ্যে সবচাইতে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল টাইটাস (৭৯-৮১)। ভিসুভিয়াসের বিস্ফোরণ হলে তিনি প্রচুর জনকল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, এই বিস্ফোরণেই হারকিউলোনিয়াম এবং পম্পে শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। 

সম্রাট টাইটাসের প্রতিকৃতি। Photos by Ed Uthman/Flickr.

ডোমিশিয়ান উত্তরসূরি এবং সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত সম্রাট নার্ভা (৯৬-৯৮) এর রাজত্ব দিয়ে রোমান ইতিহাসে পুনরায় স্বর্নযুগের প্রচলন হয়েছিল। এই সময়ে চার সম্রাট – ট্রাজান, হ্যাড্রিয়ান, অ্যান্তোনায়াস পায়াস এবং মার্কেস অরেলিয়াস – সুষ্ঠু আর সুন্দরভাবে সিংহাসন গ্রহণ করেছিলেন। সম্রাট ট্রাজান (৯৮-১১৭) ডাচিয়া (বর্তমানে উত্তর-পশ্চিম রোমানিয়া) এবং পার্থিয়ার রাজ্যগুলো জয় করে ইতিহাসে সর্বাধিক পরিমাণ রোমের সীমানা বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরি হ্যাড্রিয়ান (১১৭-১৩৮) সাম্রাজ্যের সীমান্তকে শক্তিশালী করেছিলেন (বর্তমান ইংল্যান্ডের হ্যাড্রিয়ান ওয়াল তারই নির্মান)। এছাড়াও, আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং প্রশাসনিক সংস্কারে ব্যাপক কাজ করেছেন। 

অ্যান্তোনায়াস পায়াস (১৩৮-১৬১) এর অধীনে রোমে শান্তি আর সমৃদ্ধি অব্যাহতই ছিল। কিন্তু মার্কেস অরেলিয়াস (১৬১-১৮০) এর সময়কালে প্রচুর দ্বন্দ্ব আর বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে আর্মেনিয়া আর পার্থিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং উত্তর দিকের জার্মানিক উপজাতির উপর আক্রমণও অন্তর্ভুক্ত ছিল। মার্কাস অসুস্থ ছিলেন এবং ভিন্ডোবোনায় (ভিয়েনা) যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে মারা যান। অ-বংশগত উত্তরসূরির প্রথা ভেঙ্গে তিনি তাঁর ১৯ বছরের ছেলে কমোডাসকে তাঁর উত্তরসূরি বলে ঘোষণা করেন। কমোডাস (১৮০-১৯২) মসনদে বসে রোমের স্বর্নযুগের অবসান ঘটিয়েছিলেন। মন্ত্রীদের হাতে তিনি নিহত হলে, পুনরায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় রোমে। এই গৃহযুদ্ধ থেকে বিজয়ী বেশে সম্রাটের আসনে আরোহণ করেছিলেন লুসিয়াস সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস (১৯৩-২১১)। 

তৃতীয় শতাব্দীর পুরোটা জুড়েই রোম এক বিচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বের মধ্যে কাটিয়েছে। এই সময় সর্বমোট ২২ জন সম্রাট সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। তাদের প্রত্যেকেই সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছেন যারা তাদেরকে এই সিংহাসনে বসিয়েছিল। এদিকে এমন চরম পরিস্থিতিতে বাইরে থেকে আসা হুমকি, সাম্রাজ্যের লোকজনকে তখন আতঙ্কিত করে তুলেছিল। ক্রমশই তাদের ধন-সম্পদ ক্ষয়ে আসছিল। জার্মান এবং পার্থিয়ানদের ক্রমাগত আগ্রাসন এবং এজিয়ান সাগর দিয়ে গথদের আক্রমণ – সব মিলিয়ে রোম চরম বিপর্যস্ত ছিল এই সময়টাতে। 

শিল্পীর তুলিতে তৃতীয় শতাব্দীর সংকটে রোম। Photos by brewminate.com

ডায়োক্লিশিয়ানের (২৮৪-৩০৫) রাজত্বকালে রোমে সাময়িকভাবে শান্তি আর সমৃদ্ধি ফিরে এসেছিল। তবে সাম্রাজ্যের একতা বজায় রাখতে চরম মূল্য চুকাতে হয়েছিল। ডায়োক্লিশিয়ান তাঁর ক্ষমতা তথাকথিত টেট্রারার্কি নিয়মে বিভক্ত করেছিল। ফলে তাঁর উপাধি অগাস্টাস (সম্রাট) ম্যাক্সিমিয়ানের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল। ডায়োক্লিশিয়ান এবং ম্যাক্সিমিয়ানের সহকারী এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে দুইজন জেনারেলকে বাছাই করা হয়েছিল। গ্যালারিয়াস এবং কন্সট্যান্টিটিয়াস। ডায়োক্লিশিয়ান এবং গ্যালারিয়াস পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের শাসন কার্য সামলাতো। এবং পশ্চিম দিকের ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন ম্যাক্সিমিয়ান এবং কন্সট্যান্টিটিয়াস। 

এদের রাজত্বকালে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ডায়োক্লিশিয়ান এবং ম্যাক্সিমিয়ান অবসরে নিলে পুনরায় দ্বন্দ্ব আর বিবাদের সৃষ্টি হয়। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দ কন্সট্যান্টাইন (কন্সট্যান্টিটিয়াসের পুত্র) পুনর্মিলিত রোমের একমাত্র সম্রাটের অধিকারী হয়ে আবির্ভূত হন। ক্ষমতায় বসেই রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী বাইজেন্টিয়ামে স্থানান্তরিত করেন এবং প্রথমাবস্থায় নাম দেন নতুন রোম শিরোনামে। পববর্তীতে তাঁর নামানুসারে শহরের নাম হয় কন্সট্যান্টিনোপল। অতঃপর ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে নাউসিয়ার কাউন্সিলে তিনি খ্রিস্ট ধর্মকে রোমান সাম্রাজ্যের সরকারি ধর্ম বলে ঘোষণা করেন। 

রোমান সাম্রাজ্যের একতা কেবলই একটা মায়াজাল ছিল – কেননা কন্সট্যান্টাইনের মৃত্যুর ৩০ বছর পরেই রোমান সাম্রাজ্য পুনরায় পূর্ব আর পশ্চিমে ভাগ হয়ে যায়। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যই পরবর্তীকালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বলে অভিহিত হয়। আর কেবলমাত্র কন্সট্যান্টিনোপলের জন্যই এই সাম্রাজ্য আগত কয়েক শতাব্দী ধরে শক্তিশালী এক অবস্থানে ছিল। তবে পশ্চিমের রোমান সাম্রাজ্যের গল্পটা পুরোপুরি ভিন্ন। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বিদেশের হুমকিকে জর্জরিত হয়ে এই সাম্রাজ্য ক্রমশই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। 

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মানচিত্র। Photos by Antoine Helbert.

কন্সট্যান্টিনোপল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী হবার পর থেকেই মূলত রোমের শক্তি ধীরে ধীরে কমে আসে। প্রকৃতপক্ষে, এরপর থেকে আর কোনো সম্রাটই রোমকে স্থায়ী রাজধানী হিসেবে পরিণত করেননি। ধীরে ধীরে তাই রোমের শক্তিও কমে আসতে শুরু করে। নিজেদের গড়া এই সুবিশাল সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে হারাতে থাকে তারা। ৪১০ এ সমগ্র বৃটেন; ৪৩০ এ স্পেন আর আফ্রিকার প্রদেশের কর্তৃত্ব হারায় রোমানরা। ৪৫০ এর দিকে আটালিয়া দ্য হান নিজের বাহিনী নিয়ে গল আর ইতালি আক্রমণ করে যা রোম সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেয়। ৪৭৬ এ জার্মানির এক যুবরাজ রোমান সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। রোমান সাম্রাজ্যের পুরোপুরি পতন ঘটে। 

এরপর রোমের চারপাশ ঘিরে পাপাসি সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে এবং খ্রিস্টান ধর্মের পুনর্নির্মানের সূচনা হয়। ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রেগরি দ্য গ্রেট দ্বারা পাপাসির সূচনা হয়। নতুন করে খ্রিস্ট ধর্মের সূচনা হলে রোম আবারও পোপ এবং তীর্থযাত্রীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। পোপদের সম্পদ বাড়ামাত্রই রোমকে কেন্দ্র করে এর চারিপাশ জুড়ে পোপেরা প্রচুর স্থাবর সম্পত্তি গড়তে থাকে যা পরবর্তীতে পাপাল স্টেট বলে অভিহিত হয়েছে। 

১৩০০ শতকে রোম থেকে পাপাসি সরিয়ে নেয়া হয় ফ্রান্সের অ্যাভিননে। যদিও রোম আবারও পোপেদের কর্তৃত্বে চলে যায় দুই শতক পরেই। রোম তখন ইউরোপিয়ান রেনেসাঁর দ্বারপ্রান্তে। সতেরশো শতকের দিকে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির কেন্দ্র রোমের পরিবর্তে সরে যায় ফ্রান্সে। নেপোলিয়নের পর রোম আরো একবার ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর কাছ উদ্ধার করার পর ইতালিয়ান সরকার এই শহরকে দেশের রাজধানী ঘোষণা করে। 

পাপাসি স্টেটের একটি দৃশ্য। Photos by thoughtco.com

যুদ্ধবিগ্রহ

যদিও শুরুর দিকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্যই রোম শহরটার সমৃদ্ধি আর পরিচিতি হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে যুদ্ধবিগ্রহের জন্য প্রাচীন যুগের সেরা এক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল রোমানরা। উত্তর আফ্রিকার শহর কার্থেজের সঙ্গে যুদ্ধ (যা পিউনিক যুদ্ধ নামে পরিচিত, খ্রিস্টপূর্ব ২৬৪-১৬৪) রোমের শক্তিকে দারুণভাবে সুসংহত করেছিল এবং প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিকাশে সাহায্য করেছিল। পরে আরো দুটি পিউনিক যুদ্ধে রোম বিজয়ী হয়। সিসিলি, ভূমধ্যসাগর এবং স্পেনের বেশীরভাগ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে রোমের অধীনে। 

পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের বাণিজ্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রোম আর কার্থেজ শহর। কার্থেজ রোমের কাছে পরাজিত হলে সমগ্র এলাকার আধিপত্য এককভাবে পেয়ে যায় রোম শহর। তবে সমুদ্রে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি রোমানরা, একমাত্র জলদস্যুদের জন্যে। তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধে (খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯-১৪৬) রোম কার্থেজ শহরকে দখল করে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলে এবং বেঁচে থাকা বাসিন্দাদের দাসে পরিণত করে। আর উত্তর আফ্রিকার এই অংশটিকে নিজেদের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে রোম। একই সময়ে রোমের প্রভাব পূর্ব দিকেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ম্যাসোডেনিয়ার যুদ্ধে ম্যাসোডেনিয়ার রাজা পঞ্চম ফিলিপসকে পরাজিত করে রোম বাহিনী এবং ম্যাসোডেনিয়াকে আরেকটি প্রদেশ বানানো হয়। 

প্রজাতন্ত্রী রোম যখন প্রভাব আর প্রতিপত্তিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে তখনই শহরটা ভরে উঠে দুর্নীতি, লোভ এবং বিদেশী দাস শ্রমের উপর অত্যধিক নির্ভরতায়। বেশীরভাগ বেকার রোমানরাই ছন্নছাড়ার মতো ঘুরাঘুরি শুরু করে। আর একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সিনেটরদের ভাড়াটে গুণ্ডা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করে। কম মূল্য দিয়ে শ্রমিক রেখে অভিজাতরা দিনের পর দিনে সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রাচ্চি ভাইদ্বয়, টাইবেরিয়াস এবং গাইউস ভূমি ও রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। যদিও দুই ভাইই এই কারণে নিহত হয়েছিল। তবে তাদের আন্দোলনের কারণে আইনসুলভ সংস্কার এবং সিনেটের দুর্নীতি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। প্রথম ট্রায়ামব্রাটের সময়কালের মধ্যে রোম শহর এবং এর প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা দুইই বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিল। 

তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধের একটি কল্পিত চিত্র। Photos by thoughtco.com

রোমের সামরিক বিজয়গুলো এর সাংস্কৃতিক বিকাশে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাছাড়া গ্রীকদের উন্নত সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে রোমানরাও বেশ উপকৃত হয়েছিল। গ্রীক ক্ল্যাসিক লাতিন ভাষায় অনুবাদসহ রোমান সাহিত্যের প্রথম প্রমান পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৪০ এর দিকে। রোমানরা গ্রীকদের দর্শন, ধর্ম এবং শিল্প-সংস্কৃতিসহ অনেক কিছুই ধার করেছিল। 

রোমান স্থাপত্য

আধুনিক বিশ্বে রোমান স্থাপত্যবিদ্যা এবং প্রকৌশলবিদ্যা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ৩১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান জল-প্রণালী স্থাপন করা হয়। যা শহরে জল সরবরাহ পানির চাহিদা এবং স্বাস্থ্যবিধি উন্নত করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি কিছু জলপ্রণালী তো এর উৎস হতে ৬০ মাইল অবধি বিস্তৃত ছিল।  রোমান ট্রেভি ঝর্ণাটা এখনো আছে তবে সেটা আধুনিক সংস্করনে। 

কলোসিয়াম এবং রোমান ফোরামের মতো প্রাচীন ভবনগুলো এখনো টিকে আছে কেবল রোমানদের সিমেন্ট এবং কংক্রিটের কারণে। রোমানদের খিলান এবং বৃত্তাংশের আদলেই ইমারতের তোরণ এবং ব্রীজ নির্মাণের চল আগে থেকেই আছে। পুরো স্থাপত্য জুড়ে সমানভাবে ওজন বিতরণের পদ্ধতিটাও রোমানদের মাধ্যমেই এসেছে। প্রাচীন বিশ্বের সড়কগুলোর মধ্যে রোমানদের সড়কগুলো ছিল সবচাইতে বেশী দৃঢ়, মজবুত আর স্থায়ী। রোমানদের নির্মিত সেইসব সড়কের অনেকগুলোই এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

রোমান সাম্রাজ্যের কালজয়ী নিদর্শন কলোসিয়াম। Photos by medium.com

রোম। তিবের নদীর কোলঘেষা সেই ছোট্ট একটা গ্রাম। কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি এই ছোট্ট গ্রামটাই একদিন একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে। সেই সাম্রাজ্য যেটা বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক সাম্রাজ্য হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। এই সাম্রাজ্যই টানা চার শতাব্দী পৃথিবীর উপর রাজত্ব করেছে। একটা সময় পরে সেই সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে।

দিন, মাস, বছর, এমনকি শতাব্দী বদলে গেছে। বিশ্ব আরো আধুনিক হয়েছে। সেই ছোট্ট গ্রাম্য শহরটা এখন ইতালির রাজধানী হিসেবে খ্যাত। আধুনিক এক শহরের খেতাব নিয়ে চলছে রোম। কিন্তু রোম যেন ক্ষনে ক্ষনে মনে করিয়ে দেয় তার অতীত ইতিহাস। সেজন্যই বলা হয়, রোম একদিনে গড়ে উঠেনি।

 

Feature Image: brewminate.com
তথ্যসূত্রসমূহ:

01. A Brief History of Rome.
02. Ancient Rome.
03. History of Rome.
04. Ancient Rome.