২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল। রোদ ঝলমল আরেকটি দিন শুরু হলো পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত নগরী প্যারিসে। ক্রমশই ব্যস্ত হতে থাকলো শহরের অলি-গলি আর প্রধান সড়কগুলো। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে বিকেলে পথচারীরা সব চলেছেন নিজ গন্তব্যে। কেউ যাচ্ছেন অফিস শেষে বাড়ির পথে কেউবা ছোট্ট শিশুর হাত ধরে হাঁটছেন পার্কে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে অনেকেই ব্যস্ত শপিং নিয়ে। বিকেলের উজ্জ্বল আকাশ আর স্নিগ্ধ পরিবেশ আচমকাই গুমোট পরিবেশে রূপ নিল।
পরিষ্কার আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলে সবার দৃষ্টি চলে যায় ধোঁয়ার উৎসের কাছে। তখনই সবার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়। আগুন লেগেছে। দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রায় ৮০০ বছরের প্রাচীন আর ঐতিহ্যবাহী ক্যাথেড্রাল নটর ডেমে। মধ্যযুগের অনন্য নিদর্শন জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে চলেছে। ৮০০ বছরের ইতিহাস ধূলিস্মাৎ হতে চলেছে মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই। বিশ্ববাসী অবাক আর ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে দেখেছে সেই দৃশ্য। গথিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া এই ক্যাথেড্রাল প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের চাইতে বেশি জনপ্রিয়। আজকের আয়োজনটা সাজানো হয়েছে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের ইতিবৃত্ত দিয়ে।
ইতিহাসের পাতায় নটর ডেম ক্যাথেড্রাল
দশম শতকের দিকে প্যারিস ইউরোপের শক্তিশালী অঞ্চল বলে খ্যাত ছিল। শুধু তাই নয়। একাদশ আর দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল প্যারিস। ১১৬০ সালে প্যারিসের তৎকালীন বিশপ মরিস ডি সালি ধর্মের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে বিশাল এক ক্যাথেড্রাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। আর সিধান্ত নেন ক্যাথেড্রালটি উৎসর্গ করা হবে মাদার মেরিকে। আর তাই নাম ঠিক করা হয় নটর ডেম। কেননা, ফরাসি এই শব্দের ইংরেজি অর্থ আওয়ার লেডি। এখানে মাদার মেরিকে আওয়ার লেডি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১১৬৩ সালের দিকে প্যারিসের দ্বীপ ইল দ্যু লা সিতের পূর্ব প্রান্তে ক্যাথেড্রালটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। তখনকার সময়ের বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিরা ক্যাথেড্রালটির উদ্বোধনের দিনে উপস্থিত ছিলেন। যাদের মধ্যে স্বয়ং রাজা সপ্তম কিং লুইসো এবং পোপ তৃতীয় অ্যালেকজান্ডার ছিলেন। বিশপ মরিস তার পুরো জীবন ধর্মকর্মের প্রতি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। যার সুবাদে ক্যাথেড্রালটি একদম তার হাতেগড়া বলা যায়।
কিন্তু ক্যাথেড্রালটির নির্মাণ কাজ শেষ হবার পূর্বেই তাকে পৃথিবী ত্যাগ করতে হয়। ১১৯৬ সালে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুরও প্রায় ১৫০ বছর পর নটর ডেম ক্যাথেড্রালের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়। সবমিলিয়ে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০০ বছর।
৪ জন প্রকৌশলীর চৌকশ চিন্তাশক্তি আর পরিশ্রমের ফলাফল আজকের এই নটর ডেম ক্যাথেড্রাল। ফ্লাইং বাট্রেসেস (Flying Buttresses), গথিক স্থাপত্য, রোজ উইন্ডো, সুনিপুণ কারুকাজ সব মিলিয়ে এক অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী উপহার দিয়েছিলেন তারা বিশ্ববাসীকে। সময়ে সময়ে সংস্কার করে একদিকে যেমন ক্যাথেড্রাল রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে; তেমনি অন্যদিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আরো নান্দনিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে।
২০০ বছরের নির্মাণ ইতিহাস রয়েছে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের। এই সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। সেই সব ঘটনাকে সঙ্গে নিয়েই এই ক্যাথেড্রালের নির্মাণ যাত্রা চলেছে। একনজরে নটর ডেম ক্যাথেড্রাল নির্মাণ ইতিহাসের সময়কাল আলোকপাত করা হলো –
১১৬৩
রাজা সপ্তম কিং লুইসো এবং পোপ তৃতীয় অ্যালেকজান্ডার এর উপস্থিতিতে ক্যাথেড্রালের প্রথম পাথরফলক স্থাপন করা হয়।
১১৮২
মরিস ডি সুলি ক্যাথেড্রালের হাই অল্টারটি (যে বেদিতে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উৎসর্গের কাজ করা হয়ে থাকে এবং এটিই সবচাইতে উঁচু বেদী) নির্মাণ কাজ শেষ হলে মহা সমারোহে তা উদযাপন করেন। এই উৎসব উন্মুক্ত ছিল। তাই সবার যাওয়ার অনুমতি ছিল।
১২২০-১২৫০
১২২০ সালে প্রথম এর ছাদে গম্বুজ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। জিন ডি শেলাসের নেতৃত্বে ১২৪০ সালে ক্যাথেড্রালটির মূল অংশ নির্মাণ করা হয়। তারপর কাজের দায়িত্ব নেন পিয়ারে ডি মন্ট্রিল। সেই সময়ের মধ্যে অবশ্য পশ্চিম দিকের সম্মুখভাগের দুটি টাওয়ারের কাজও সম্পন্ন হয়ে গেছে। তিনি টাওয়ারের বড় জানালা আর রোজ উইন্ডো দিয়ে ভিন্ন মাত্রা আনেন এর কাঠামোতে। এছাড়া, ১২৫০ সালের মধ্যেই কয়্যের (প্রার্থণা করা হয় যেখানে দাঁড়িয়ে), পশ্চিম ফ্যাসাড এবং নেইভ্যের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়।
১৩৩৫
এরপর ক্যাথেড্রালের নির্মাণে কাজ করেন স্থপতি জিন রেভি। রেভি ক্যাথেড্রালের ভারী ছাদ, দেয়াল আর অবকাঠামো দৃঢ় আর মজবুত করার ব্যাপারে বেশী জোর দিয়েছিলেন। এভাবেই প্রায় ২০০ বছরের যত্ন আর পরিশ্রমে ১৩৩৫ সালে ক্যাথেড্রালের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। জানা যায়, রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এই তেরোশ শতকের সময়কালেই এই ক্যাথেড্রালকে দূর্গ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য করে গড়েছিলেন। বর্তমানে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে এর ভূগর্ভস্থ স্থানে।
১৪৩১
ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরিকে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের মধ্যে রাজা বলে ঘোষিত করা হয়।
১৫৪৬
ফ্রান্সের রাজা ফ্রঁসোয়া প্রথম নটর ডেম ক্যাথেড্রালকে রাজভবন হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। ক্যাথেড্রাল থেকে রাজাদের মূল বাসভবনে পরিণত হয় নটর ডেম।
১৬৯৯
রাজা চতুর্দশ লুইয়ের তত্ত্বাবধানে স্থপতি রবার্ট দ্য কত্তেকে এটি পুর্ননির্মান বা সংস্কারের কাজে হাত দেন।
১৭৮৯
ফরাসী বিপ্লব চলাকালীন সময়ে নটর ডেমের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে ক্যাথেড্রালের মূল ভবন আর এর ভিতরে থাকা প্রতিকৃতির মাথা ভেঙ্গে এর সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয় বিল্পবীরা। তারা তখন নটর ডেমকে খাবার আর মদের গুদাম হিসাবে ব্যবহার করতো।
১৮০১
নেপোলিয়ন সরকার কর্তৃক এক চুক্তির মাধ্যমে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের নিয়ণন্ত্রের দায়িত্ব ক্যাথলিক চার্চের কাছে ফেরত দেওয়া হয়।
১৮০৪
নটরডেম ক্যাথেড্রালের প্রতি আলাদা একটা দুর্বলতা কিংবা বলা যায় আবেগ ছিল নেপোলিয়ন বেনোপোর্টের। তাই ফরাসী বিপ্লব শেষ হওয়া মাত্রই তিনি এটি সংস্কারের দায়িত্ব নেন। আর সেজন্যেই, ১৮০৪ সালে নেপোলিয়নকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয় এই ক্যাথেড্রালেই।
১৮৩১
ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত উপন্যাস নটর ডেম দ্য পুরী ইংরেজি ভাষায় দ্য হ্যাঞ্চব্যাক অব নটরডেম শিরোনামে প্রকাশ পায়। হুগোর লেখনশৈলীতে মধ্যযুগের গথিক শৈলীর নান্দনিক সৌন্দর্যে গড়া নটর ডেমের রূপ নতুন করে নাড়া দেয় পাঠকের মনে।
১৮৪৪
ফ্রান্সের প্রখ্যাত স্থপতি ভিওলে-ল্যু-দুচকে নটরডেমের পুরনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে সংস্কারের জন্য নিযুক্ত করা হয়। প্রায় ২০ বছর সময় নিয়ে তিনি নটর ডেম ক্যাথেড্রালের মেরামতের কাজ করেন।
১৯০৫
এক আইনবলে নটর ডেম ক্যাথেড্রালকে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা হয়।
১৯০৯
নটর ডেম ক্যাথেড্রাল ফ্রান্সের আলোচিত নারী জোয়ান অব আর্ককে বিটিফাই ঘোষণা করে। বিটিফাই হচ্ছে ক্যাথেড্রাল কর্তৃক কারো স্বর্গবাসী হবার প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া; যা অত্যন্ত সম্মান আর মর্যাদার বিষয় ক্যাথলিক ধর্মমতে।
১৯৪৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনারা পরাজিত হয়ে প্যারিস থেকে বিদায় নিলে, স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনের জন্য প্যারিসবাসী বেছে নেয় নটর ডেম ক্যাথেড্রালকে।
১৯৬৫
নটর ডেমের নীচে এক খননকাজের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক সমাধিকক্ষ খুঁজে পাওয়া যায়। একইসঙ্গে পাওয়া যায় দূর্গের ধ্বংসাবশেষ।
১৯৮০
মধ্যযুগের এই গথিক স্থাপত্যশৈলীকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
নটর ডেম ক্যাথেড্রালের গঠনশৈলী
নটর ডেমকে গথিক স্থাপত্য ধারার অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। দ্বাদশ শতকের স্থাপত্য হলেও এই ক্যাথেড্রালের স্থাপত্যশৈলীতে আধুনিকতার কমতি নেই। এটি বিশ্বের প্রথম কাঠামো যেখানে বাইরের দেওয়ালকে আরো মজবুত আর দৃঢ় করতে ভেতর থেকে ফ্লাইং বাট্রেসেস (Flying Buttresses) ব্যবহার করা হয়। এটি হচ্ছে বিশেষ এক ধরণের বাঁকানো কাঠামো, যেগুলোর নীচে ভার বহনের জন্য মজবুত পিলার থাকে।
পুরো ভবন জুড়ে রয়েছে ছোট বড় আকৃতির বিভিন্ন মূর্তি। এমনকি মূল কাঠামোর বাইরেও আপনি বিভিন্ন মূর্তি দেখতে পাবেন। এগুলো যে কেবল সৌন্দর্য বর্ধনের নিমিত্তে বানানো তা কিন্তু নয়; বরং কিছু মূর্তি কলাম হিসাবে এবং কিছু বিখ্যাত গারগোইলসের জলের ফোটা পড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
পশ্চিমের ফটক
ক্যাথেড্রালটির দরজা বা মূল ফটক দেখলেই এর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়। যে কোনো দর্শকই প্রথম দর্শনে মুগ্ধ হতে বাধ্য। নটর ডেম ক্যাথেড্রালের পশ্চিম দিকে মোট তিনটি দরজা রয়েছে। দরজা তিনটির উচ্চতা ২৩৩ ফুট। ১২৫০ সালের দিকে এই দরজার কাজ শেষ হয়। তিনটি দরজায় বিভিন্ন ধরণের নকশা রয়েছে; যাদের প্রতিটি সারিতে ২৮টি মূর্তি আর ২৮ টি ওল্ড টেস্টামেন্টের রাজাদের তুলে ধরা হয়েছে। তিনটি দরজাই মূলত ক্যাথেড্রালের প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তিনটির মধ্যে মাঝের দরজাকে বলা হয় পোর্টাল অব জাজমেন্ট। ১২৩০ সালের দিকে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পোর্টাল অব জাজমেন্টে বাইবেলের কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ১২০০ সালে ডানদিকের দরজা পোর্টাল অব সেইন্ট অ্যানের কাজ শেষ হয়। এতে মাদার মেরি, যীশু, সেইন্ট পিটার এবং রাজা ডেভিডসহ আরো অনেকের প্রতিকৃতি রয়েছে। আর বাম দিকের দরজাকে বলা হয় পোর্টাল অব দ্য ভার্জিন । ১২২০ সালের দিকে এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। দরজাটিতে মাদার মেরির মারা যাওয়া এবং তার স্বর্গে যাওয়ার কাহিনীটির চিত্রিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে।
রোজ উইন্ডো
নটর ডেম ক্যাথেড্রালের আকর্ষণের অন্যতম বিষয়বস্তু হচ্ছে এই রোজ উইন্ডো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, শুরুতে যখন ক্যাথেড্রালের মূল অংশের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় তখন দেখা গেল এর ভিতরে পর্যাপ্ত পরিমাণ দিনের বা সূর্যের আলো আসতো না। আলোর স্বল্পতা সমাধানের জন্য জানালার সংখ্যা আর আয়তন বাড়ানো হয়েছিল। এর সাথে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের উত্তর, দক্ষিন আর পশ্চিম দিকে বিশাল আকৃতির তিনটি রোজ উইন্ডো দেওয়া হয়।
উত্তর দিকের রোজ উইন্ডোটি ১২৫০-১২৬০ এর মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। দক্ষিণ আর উত্তর দিকের দুটি রোজ উইন্ডোর ব্যাস ১২.৯ মিটার । রোজ উইন্ডোর একদম সেন্টারে অকুলাসে মাদার মেরি শিশু যীশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং তাদের চারপাশে ওল্ড টেস্টামেন্টের রাজা এবং ভাববাদীদের ছবি চিত্রিত হয়েছে।
১২৬০ সালে দক্ষিণ রোজ উইন্ডোটি উত্তর উইন্ডোটির ঠিক উল্টো দিকে নির্মাণ করা হয়। এটি ছিল রাজা সেইন্ট লুইসের তরফ থেকে উপহার। এর ৮৪টি প্যানেল চারটি বৃত্তে বিভক্ত যেটি নিউ টেস্টামেন্টের জন্য উৎসর্গ করা।
দ্য গ্রেট অর্গান
নটর ডেম ক্যাথেড্রালে সর্বমোট তিনটি অর্গান রয়েছে। যার মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় হচ্ছে দ্য গ্রেট অর্গান। ৮ হাজার পাইপ এবং ৫টি কীবোর্ড নিয়ে নির্মিত এই বাদ্যযন্ত্রটি ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় অর্গান।
স্পায়ার
নটর ডেমের স্পায়ার অবাক করে দেওয়ার মত সুন্দর। স্পায়ার হচ্ছে উপরের দিকে ত্রিভুজাকৃতিতে ক্রমশ সরু হয়ে আসা পিরামিড কাঠামো। ২৯৫ ফুটের নটর ডেমের স্পায়ারটি বহু দূর থেকে দেখা যেত। কিন্তু গত বছর আগুনে স্পায়ারটি পুড়ে যায়। ১২৫০ এর দিকে মূল স্পায়ারটি তৈরি করা হয়েছিল। তবে সেটি ১৮ শতকের দিকে ভেঙ্গে যায়। সেই সময়ে এর সাথে একটি বেল টাওয়ারও যুক্ত ছিল। কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে ১৭৮৬-১৭৯২ অবধি এটি নামানো হয়েছিল।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় স্পায়ার তৈরির সিদ্ধান্ত নেন ভায়োলেট-লে-ডুকের। তারপর ১৮৬০ সালে নতুন করে স্পায়ারটি তৈরি করা হয়। যার সাথে ১২টি তামার মূর্তি যুক্ত ছিল। এখানে ভায়োলেট-লে-ডুক আসলে নিজেকে সেইন্ট টমাস হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। অগ্নিকান্ডে স্পায়ারটি ধ্বংস হওয়ার পর নতুন করে তা তৈরির সিধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গারগোইলস
নটর ডেমের অন্যতম সেরা শৈলী হচ্ছে গারগোইলস। গারগোইলস হচ্ছে মধ্যযুগের একটি শৈলী। যেটি মূলত পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধনের নিমিত্তে বানানো হতো। তবে এই গারগোইলসগুলোর মুখটা গড়া হতো বিশেষ কোনো প্রাণীর মুখের আর শরীরের অবয়বে। নটর ডেম ক্যাথেড্রালের ২টি বেল টাওয়ারেই রয়েছে এগুলো। যার একটিতে দর্শনার্থীরা যেতে পারেন।
৩৮৭ ধাপের সিঁড়ি পার করার পরে বেল টাওয়ারে দেখা মিলবে বিখ্যাত গারগোইলসের। মূলত এটি রহস্য ঘেরা পৌরানিক এক প্রাণী। যেটি আদতে অনেক গুলো প্রাণীর বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি করা। আর এই টাওয়ারে আসলে গারগোইলসের সাথে পুরো শহরের এক মনোরম দৃশ্য দেখা যাবে।
বিশাল ঘণ্টা
ক্যাথেড্রালের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে বেল টাওয়ারের সুবিশাল ঘণ্টাগুলো। ঘণ্টাগুলো দেখতে চাইলে ১৪০ ধাপ সিঁড়ি পাড়ি দিতে হয় দর্শনার্থীদের। প্রত্যেকটি ঘণ্টারই স্বতন্ত্র নাম রয়েছে। দক্ষিণ দিকের টাওয়ারে অবস্থিত প্রধান বেল বা ঘণ্টাটির নাম এমানুয়েল বেল। এমানুয়েল বেলের ওজন ১৩টন। আর এর শুধু ক্লিপারের ওজনই ১ হাজার ১০০ পাউন্ড। এই ঐতিহাসিক ঘণ্টাগুলো ফ্রান্সের বিশেষ দিনগুলোতে বাজানো হয়।
নটর ডেম ক্যাথেড্রাল নিয়ে আরো কিছু তথ্য
- প্যারিস মানেই যেন আইফেল টাওয়ার। অথচ প্যারিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানের তালিকায় সর্বপ্রথমেই আসে এই নটর ডেম ক্যাথেড্রালের নাম।
- প্রতিবছর প্রায় ১৩মিলিয়ন দর্শনার্থী আসেন এই ক্যাথেড্রাল দেখতে।
- ফরাসী বিপ্লবের সময় নটর ডেম ক্যাথেড্রালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই সময়ে সবগুলো ঘণ্টা নষ্ট করে দেওয়া হলেও রক্ষা পায় ক্যাথেড্রালের প্রধান ও প্রাচীন ঘণ্টা এমানুয়েল বেল।
- ১৯৯৬ সালে ভিক্টর হুগোর উপন্যাস নিয়ে ডিজনি নির্মাণ করে দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম চলচ্চিত্রটি।
- হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষি নটর ডেম ক্যাথেড্রালকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে অন্তর্ভুক্ত।
Feature Image: whatsonparis.co.uk
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Notre-dame de Paris-History, Architecture, and Tips for Visiting.
02. West Facade of Notre-Dame Cathedral, Paris.
03. An 800-year history of Paris’s Notre Dame Cathedral.
04. Notre-Dame de Paris.
05. নটর ডেম ক্যাথেড্রাল: মধ্যযুগীয় এক অনন্য নিদর্শন।