পৃথিবীর প্রাচীন সমৃদ্ধশালী সভ্যতাগুলোর মধ্যে রোমান সাম্রাজ্য অন্যতম। প্রায় ১৪০০ বছর ধরে প্রচলিত ছিল এই রোমান প্রজাতন্ত্র। শুরুটা হয়েছিল যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও পাঁচ শতক আগে। কালের পরিত্রুমায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওফাতের পরও থামেনি এই সাম্রাজ্যের যাত্রা। আরো সুদীর্ঘ প্রায় আটশ বছর ধরে রোমান সাম্রাজ্য তার আধিপত্য নিয়ে টিকে ছিল। রোমান সাম্রাজ্য ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের অঞ্চলসহ ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া পর্যন্ত শাসন করেছে।
সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করার কারণে রোমানিয়াদের (রোমানিয়া দেশের নাগরিকদের রোমানিয়া বা রোমানিয়ান বলে) রোমানদের রয়েছে বিস্তর আর সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। এছাড়াও, শিল্প-স্থাপত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শাসনব্যবস্থা ও অর্থতন্ত্র এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে ছিল অসামান্য অবদান। রোমানদের তৈরি স্থাপত্য এই আধুনিক যুগে এসেও মুগ্ধতা ছড়ায়। তেমনি তাদের একটি স্থাপত্য হছে কলোসিয়াম। স্থাপত্যকলার ইতিহাসে এটি এখনো এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে।
কলোসিয়াম হচ্ছে রোমানদের তৈরি এক বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটার। ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, রোমান সাম্রাজ্যে প্রায় ২০০টিরও বেশী অ্যাম্ফিথিয়েটার ছিল। তখনকার সময়ের সবচেয়ে জটিল স্থাপনার একটি ছিল এই কলোসিয়াম। যদিও বর্তমানে কেবল এর দুই তৃতীয়াংশই টিকে আছে। তা সত্ত্বেও, এই মনোমুগ্ধকর স্থাপনা দেখতে প্রতিবছর লাখখানেক পর্যটকের ভিড় প্রত্যক্ষ হয়।
কলোসিয়াম প্রসঙ্গে কিছু লিখতে হলে অস্কারজয়ী সিনেমা দ্য গ্লাডিয়েটর এর কথা উল্লেখ করতেই হয়। কেননা, সিনেমার মূল আকর্ষণই ছিল এই অ্যাম্ফিথিয়েটার। সিনেমায় দেখানো হয়েছিল, বিশাল এক স্টেডিয়ামে দুই বা ততোধিক মল্লবীরদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী মল্লযুদ্ধ চলছে। প্রতিপক্ষের মৃত্যু না হওয়া অবধি এই লড়াই থামার কোনো নিয়ম নেই। আর প্রতিপক্ষের ভয়ঙ্কর আর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুই যেন ছিল দর্শকদের বিনোদনের খোরাক।
আদিম এক বন্যতায় দর্শকরা হৈ-হুল্লা করে লড়াকু সৈনিককে লেলিয়ে দিচ্ছে প্রতিপক্ষকে যন্ত্রণাদায়ক এক মৃত্যু দেয়ার জন্যে। এটা যে শুধু সিনেমার স্বার্থে দেখানো হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বরং প্রাচীন যুগের বলতে গেলে প্রায় সকল সাম্রাজ্যেই এই ধরণের বিনোদন বা ক্রীড়ার প্রচলন ছিল। কলোসিয়াম বা অ্যাম্ফিথিয়েটার সাধারণত এই ধরণের ক্রীড়া বা বিনোদনের নিমিত্তেই নির্মাণ করা হতো। তবে অনেক সময় বিনোদন বা ক্রীড়া ছাড়াও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সৈনিকদের অস্থায়ী ব্যারাক, দূর্যোগকালীন এবং তীর্থযাত্রীদের আবাসন এবং এমনকি দুর্গ হিসেবেও ব্যবহৃত করা হতো।
কলোসিয়াম কি
ইতালির রোম শহরকে বলা হয় চিরশান্তির নগরী। অথচ এই রোমেই দাঁড়িয়ে আছে রোমানদের নিদর্শন কলোসিয়াম, যেখানে লক্ষাধিক জীবন নাশ হয়েছে। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যতটা না রক্তপাত হয়েছে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হত্যা ও রক্তপাতের ইতিহাস বহন করছে কলোসিয়ামের সামান্য এই ভূ-খন্ডটি।
কলোসিয়ামের আভিধানিক অর্থ ক্রীড়াঙ্গণ, প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ। রোমান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই কলোসিয়ামটি চারতলা বিশিষ্ট ছাদহীন বৃত্তাকার এক স্থাপত্য কাঠামো। এতে মোট ৮০টি দরজার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল; যার মধ্যে ৭৬টি জনসাধারণের প্রবেশ ও বাহিরের জন্য ব্যবহার করা হতো। গোলাকার এই কলোসিয়ামের চারপাশ ঘিরে মোট সাতাশি হাজার আসন স্থাপন করা হয়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, এই আসনগুলো পূর্ণ হতে সময় লাগতো মাত্র আধা ঘন্টা। প্রবেশপথে দর্শকদের মাটির তৈরি এক ধরনের টিকেট দেয়ারও নিয়ম ছিল; যাকে স্থানীয় ভাষায় ঠিকরা বলা হতো। এই ঠিকরার গায়ে আসন নাম্বার খোঁদাই করে লেখা থাকতো; যা ব্যবহার করে দর্শকরা নির্ধারিত আসনে বসতে পারতো।
দর্শকরা যেন খুব সহজেই আসন খুঁজে পায় এবং চলাফেরা করতে পারে, এই বিষয়টি মাথায় রেখে কলোসিয়ামে ভোমিটোরিয়ামের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভোমিটোরিয়াম মূলত দর্শকদের চলাচলের সুবিধার জন্য একটি পথ বা প্যাসেজ স্বরূপ ছিল। প্রচন্ড রোদে বা বৃষ্টিতে দর্শকদের যেন কোন সমস্যা না হয়, সেজন্য মঞ্চটিকে শক্ত মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়ার জন্যে দড়ি দিয়ে এক প্রকারের টানা দেয়া পর্দার ব্যবস্থা ছিল। যখন প্রচন্ড রোদ বা বৃষ্টি শুরু হতো তখনই শুধু এটিকে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া মঞ্চের উপরের অংশ বেশীরভাগ সময় খোলাই রাখা হতো।
পরবর্তীতে সম্রাট টাইটাস এই কলোসিয়ামের কাঠামোতে খানিকটা পরিবর্তন আনেন। তিনি পশু এবং বন্দীদের রাখার জন্য মাটির নিচে সুড়ঙ্গ নির্মাণ করেন। এছাড়াও, আরো ৩৬টি গোপন সুড়ঙ্গ করা হয় হিংস্র পশু রাখার জন্য। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পশুগুলোকে রাখা হতো মল্লবীরদের উপর অতর্কিত হামলা চালানোর জন্যে। এতে খেলায় আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতো। কলোসিয়ামের নীচের অংশ বা গ্রাউন্ড ছিল কাঠের তৈরি। গ্রাউন্ড অংশটি টানা পোলের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা যেত। নীচের এই অংশটি ছিল পানিতে পূর্ন। যার গভীরতা ছিল প্রায় ১০ মিটারের মতো। এখানে মূলত নৌযুদ্ধের আয়োজন করা হতো। এই রণাঙ্গনের চারপাশ শক্ত প্রাচীরে ঘেরা ছিল। যার উচ্চতা ছিল প্রায় ৫০ মিটারেরও বেশী।
কলোসিয়াম এর নির্মান ইতিহাস
সত্তর থেকে বাহাত্তর খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়। তখন রোমানদের শাসন করতেন সম্রাট ভেসপাসিয়ান। তার সাম্রাজ্যই ইতিহাসে ফ্লেবিয়ান সাম্রাজ্য নামে সুপরিচিত। সম্রাট ভেসপাসিয়ান তার সাম্রাজ্যের জনপ্রিয়তা বাড়াতে, বিভিন্ন সভা ও উৎসব আয়োজন করতে মূলত কলোসিয়াম এর নির্মান কাজ শুরু করেন। সম্রাট ভেসপাসিয়ানের মৃত্যুর পর মঞ্চটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন তার পুত্র টাইটাস।
তিনি প্রায় ৬০ হাজার ইহুদী দাসকে দিয়ে টানা ১০ বছর ধরে নির্মাণ কাজ করান। অবশেষে ৮০ খ্রিস্টাব্দে কলোসিয়ামের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তখন এটিকে ফ্লেবিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার (গ্যালারি) নামকরণ করেন টাইটাস। পরে জনসাধারণের জন্য এই কলোসিয়াম উন্মুক্ত করে দেন তিনি।
কলোসিয়ামের মরণপণ খেলা
ফ্লেবিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার উন্মুক্ত করে সম্রাট টাইটাস তিনমাস ব্যপী এক বিশাল মেলা আয়োজনের ঘোষণা দেন। জানা যায়, এই মেলা প্রায় ১০০ দিনের মতো চলমান ছিল। দর্শকদের বিনোদনের জন্য মেলায় আয়োজন করা হয়েছিল পশুতে-পশুতে লড়াই। লড়াইয়ের জন্য উত্তর আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার-হাজার হাতি, গন্ডার, বুনো মহিষ, বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ ইত্যাদি ধরে আনা হয়েছিল। ভাল্লুকের সঙ্গে হাতি, হাতির সঙ্গে বুনো মহিষ বা গন্ডারের সঙ্গে হাতির লড়াই আয়োজন করা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, এই উদ্বোধনী খেলায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৯ হাজারেরও অধিক প্রাণী।
টানা কয়েকবার একই ধারার আয়োজনে সম্রাট টাইটাস বিরক্ত হয়ে পড়েন। নিজের বিনোদনের খোরাক এবং দর্শকদের কথা চিন্তা করে নতুন এক ক্রীড়ার আয়োজন করেন তিনি। আগের চাইতে আরো বেশী হিংস্র আর পাশবিক খেলার চল শুরু করেন তিনি। পশুর বদলে মানুষে-মানুষে লড়াই করার আয়োজন করেন তিনি। যা পরবর্তীতে বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
শুরুতে এই লড়াই কেবল যুদ্ধ বন্দীদের দিয়েই করানো হতো। সময় গড়ালে প্রচলন হয় গ্ল্যাডিয়েটরদের। গ্ল্যাডিয়েট হচ্ছে এক ধরনের ছোট তরবারি আর যারা এই ধরনের তরবারি দিয়ে এই খেলায় অংশ নিতেন তাদের বলা হতো গ্ল্যাডিয়েটর। এই গ্ল্যাডিয়েটররা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠী। তাদেরকে এই খেলার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণও দেয়া হতো।
এক কঠোর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো যে, প্রশিক্ষণ নেয়াকালীন সময়েই প্রতি ১৫ জনের মধ্যে ৩ জন মারা যেত। প্রশিক্ষণ শেষে ক্রীড়ার আয়োজন করা হলে তাদের নামিয়ে দেয়া হতো কলোসিয়ামে। খেলা চলতো মৃত্যু না হওয়া অবধি। তবে হেরে যাওয়া গ্ল্যাডিয়েটরের প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ ছিল। প্রাণ ভিক্ষা দেয়া না দেয়ার ব্যাপারটি একান্তই সম্রাটের মর্জির উপর নির্ভর করতো।
সম্রাটের ইচ্ছে করলে কাউকে প্রাণ ভিক্ষা দিতেন আর ইচ্ছে না করলে দিতেন না। সম্রাট থ্যাম্বস-আপ করলে ছেড়ে দেয়া হতো আর থ্যাম্বস-ডাউন করলে পরাজিতের জীবন নিয়ে নিতেন বীজিতা। এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যেত নিরীহ একটি প্রাণ আর চারপাশে মানুষজন আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়তো।
বিধ্বংসী ভূমিকম্প
৪৪৩ ও ১৩৪৯ সালের দুটি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ভূমিকম্পে কলোসিয়ামের প্রায় অর্ধেকেরও বেশী অংশ ভেঙে যায়। তারপর এটি একবার সংস্কার করা হয়েছিল। বর্তমানে ইতালিয়ান সরকার এর রক্ষণাবেক্ষণে তদারকি করে।
আন্তজার্তিক স্বীকৃতি
ইউনেস্কো ১৯৯০ সালে কলোসিয়ামকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে নির্বাচিত হয় ২০০৭ সালে।
পর্যটন কেন্দ্র
প্রতিবছর প্রায় ৫ মিলিয়ন পর্যটক ভিড় জমান এই কলোসিয়ামকে এক নজর দেখার জন্য। তাদের মধ্যে কেউ কি জানে এই কলোসিয়ামের মাটিতে মিশে আছে কত লক্ষ লক্ষ নিরীহের অশ্রু, কতো রক্ত আর অতলে হারিয়েছে কতো লক্ষ লক্ষ প্রাণ? কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজানা কতশত ইতিহাস নিয়ে এই কলোসিয়াম।
Feature Image: Elia Locardi
তথ্যসূত্রসমূহ: