ইউরোপ – পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতির সবচাইতে বড় পাওয়ার হাউজ। বিভিন্ন ভাষা, বিচিত্র মানুষ এবং দীর্ঘ আর সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য একজন ভূ-পর্যটকের কাছে ইউরোপ যেন স্বপ্নের ভূমি। প্যারিস, রোম, প্রাগ এবং ভিয়েনার মতো শহরগুলো দীর্ঘকাল ধরে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, থিয়েটার এবং নৃত্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। তাই ইউরোপের যে কোনো উৎসবই যে পৃথিবী বিখ্যাত এবং বিশ্বের বৃহত্তম তা নিয়ে অবাক হবার কিছু নেই। ইউরোপে সব ধরণের উৎসবই হয়ে থাকে। হোক তা কার্নিভ্যাল বা মেলা; কিংবা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল; অথবা টমেটো ফেস্টিভ্যাল; আর নয়তো অক্টোবরফেস্ট – এমন অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী ফেস্টিভ্যাল মানে উৎসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইউরোপের সব দেশগুলোতে। ইউরোপের জনপ্রিয় ফেস্টিভ্যালগুলোর খোঁজ নিতে গেলে দেখা যাবে অনেকগুলোর নাম চলে এসেছে। তবে সেই অনেকগুলো থেকে বাছাই করা দশটি ফেস্টিভ্যাল নিয়েই আজকের আলোচনা।
১. কার্নিভ্যাল অফ ভেনিস, ভেনিস, ইতালি
ভেনিসের নাম শুনতেই সবার প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠে জলজ এক শহরের দৃশ্য। সেই শহরের অলি-গলিতে গন্ডোলাস (লম্বাটে তল বিশিষ্ট এক ধরণের নৌকা) চলাচল করে। আর ইউরোপের নতুন দম্পতি মানেই যেন ভেনিসে মধুচন্দ্রিমায় আসাটা বাধ্যতামূলক।
ভেনিস আরো বর্ণিল হয়ে উঠে কার্নিভ্যাল অফ ভেনিস উৎসব চলাকালীন। পুরো ইউরোপ জুড়ে বিখ্যাত এই উৎসবের মতো আরো অন্যান্য উৎসব এই মহাদেশে হয়ে থাকলেও কার্নিভ্যাল অফ ভেনিস সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয়। কার্নিভ্যাল অফ ভেনিসের নির্দিষ্ট কোনো দিন বা তারিখ নেই। তার কারণ এটি খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব ইস্টার (চলমান ছুটির দিন) এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই প্রতিবছর ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে মিল রেখে এই কার্নিভ্যালের তারিখও পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
ক্যার্নিভ্যাল এর ব্যাপক পরিচিতি কেবল এর বর্ণিল আর বৈচিত্র্যময় সব মুখোশগুলোর জন্য। তবে এই উৎসবের ধারণাটি বেনামী হিসেবেই গণ্য এখনো। তবে এর যে অতীত ইতিহাস আছে তা বেশ সুপ্রাচীন। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই সরকারি হিসেবমতে, এই উৎসব আয়োজনের কথা জানা গেলেও এর ইতিহাস আরো কমপক্ষে দুইশো বছরের প্রাচীন। ১০৯৪ খ্রিস্টাব্দের সময়কালের দলিল-দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, লেন্টের দিনের আগে কোনো এক সম্মিলিত উৎসবের কথা। সেই সময় থেকেই এই উৎসব এক ধরণের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে এবং মানুষজন সপ্তাহব্যাপী চলা এই উৎসব উদযাপন করে নেচে-গেয়ে-আনন্দ আর উল্লাস করে।
তবে এই কার্নিভ্যালের মূল উদ্দেশ্য বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এটাই যে – এই উৎসবে অংশগ্রহণের জন্যে মুখোশ আর কস্টিউমের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যাতে শ্রেণীবৈষম্য ভুলে মানুষ কেবল আনন্দ করতে পারে। উৎসব চলাকালীন গন্ডোলার প্যারেড দেখা যায়, কনসার্ট হয় এবং গালা নাইটসহ আরো দারুণ সব আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়। ভেনিসীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ওয়াটার প্যারেডের আয়োজনও করা হয়। মুখোশের মেলা বসে যেন। আর অদ্ভুত সব কস্টিউম পরে তাক লাগিয়ে দেয়া মানুষেরও অভাব হয় না এই কার্নিভ্যালে। ২০ দিন ব্যাপী চলা এই উৎসবে বর্তমান প্রায় ৩ মিলিয়ন মানে ৩০ লাখের মতো মানুষ জড়ো হয় গড়পড়তা। এবং বছরের পর বছর দর্শকদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি জনপ্রিয়তাও বাড়ছে এই উৎসবের।
২. সেইন্ট প্যাট্রিক ফেস্টিভ্যাল, ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড
সেইন্ট প্যাট্রিক ডে/দিবস আসলে একটি সার্বজনীন ধর্মীয় উৎসব যা আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়। এটি আয়ারল্যান্ডের ধর্মীয় গুরু সাধু প্যাট্রিকের স্মরণে আয়োজন করা হয়ে থাকে। জানা যায়, ১৭ শতকের দিকে একটা আনুষ্ঠানিক ভোজনৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। এবং তখন থেকেই এই উৎসব আয়ারল্যান্ডের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। ধারণা করা হয়, সেই উৎসব থেকেই আয়ারল্যান্ডে খ্রিস্টান ধর্মের সূত্রপাত হয়েছিল। বর্তমানে আয়ারল্যান্ডের এই উৎসব পুরো ইউরোপের অন্যতম সেরা একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে।
১৯৯৫ সালের দিকে আয়ারল্যান্ডের সরকার এই উৎসবকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিতে একদিনের জাতীয় ছুটির ব্যবস্থা করে। একইসাথে এই উৎসবকে সার্বজনীন আন্তর্জাতিক উৎসব বলে ঘোষণা করা হয়। উৎসবটি মূলত আইরিশদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করার বিশাল এক সুযোগ। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসের ১৭ তারিখ এটি সর্বপ্রথম উদযাপন করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে এটি ৩ দিনের উৎসবে সম্প্রসারিত হয় এবং ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। যার ফলে এটি এখন ৪ দিনব্যাপী একটি সার্বজনীন ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
সঙ্গীত, নৌকাবাইচ, গুপ্তধনের সন্ধান, নাচ-গান এবং অবশ্যই বর্নিল প্যারেডের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় এই উৎসব। আর বারগুলোতে শুরু হয়ে যায় আয়ারল্যান্ড বিয়ার উৎসব। পুরো উৎসবের একমাত্র আকর্ষণ ঐ বর্নিল প্যারেড। যেখানে সবাই সেইন্ট প্যাট্রিকের অনুকরণে শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়ায়। পুরো শহর সাজে সুবজের ছোঁয়ায়। এমনকি সকলের গাঁয়েও শোভা পায় সবুজ রঙের পোশাক। এবং এমনকি খাবার পরিবেশনসহ দোকান আর বাড়িঘরেও এই উৎসবের জন্যে শোভা পায় সবুজ রঙে। কেননা, সবুজ হচ্ছে সেইন্ট প্যাট্রিকের রঙ – তাই বিশ্বাস করে আইরিশরা।
৩. সান ফারমিন ফেস্টিভ্যাল, প্যাম্পলোনা, স্পেন
সান ফারমিন উৎসবে যোগ দিতে প্রতিবছর ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশ থেকেও প্রচুর অতিথি আসে প্যাম্পলোনাতে। কেননা, এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে রানিং অফ দ্য বুল; মানে একদল ক্ষুব্ধ ষাঁড়ের সামনে সরু রাস্তা ধরে দৌড়ে নিজেকে বাঁচানো। ২৬০০ ফুট বা ৮০০ মাইলের রাস্তা ধরে অংশগ্রহণকারীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আর ষাঁড়গুলো তেড়ে আসে তাদের দিকে। সপ্তাহব্যাপী চলা এই উৎসবে আহত আর নিহত হওয়াটা খুব বেশী অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। প্রতি বছর জুলাই মাসে শুরু থেকে মাঝমাঝি সময়ের মধ্যেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এই রানিং বুলের উৎপত্তিটাও বেশ আগেকার কথা। তখনকার দিনে শহরের অদূরে থাকা খোঁয়াড় থেকে এইসব ষাঁড়গুলোকে নিয়ে আসা হতো লড়াই করার জন্যে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই আয়োজন করা হতো সেই উৎসব। আর তখনকার সময়ে দারুণ জনপ্রিয় ছিল সেটা। তরুণরা নিজেদের সাহসের পরীক্ষা দিতে সেইসব ষাঁড়গুলোর মাঝে ঝাপিয়ে পড়তো আর নিজেদেরকে গুতো খাওয়ার থেকে রক্ষা করতো। আবার কেউ কেউ বলে ষাঁড়গুলোকে বাজারের হাটে নিয়ে যাবার সময় এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল। বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে ষাঁড়গুলোর হাঁটার বা দৌড়ানোর গতি সঞ্চার করতো রাখালরা। যুবকরা ষাঁড়গুলোর সামনে দৌড়াত যাতে করে সেগুলোর গতি বাড়ে। ধীরে ধীরে তাই পরিবর্তিত হয়ে আজকের উৎসবে এসে থেমেছে।
প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এই উৎসব বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে ছুটে আসে পৃথিবী বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কিন্তু তাই বলে যে সবাই অংশগ্রহণ করতেই আসে; এমনটা কিন্তু নয়। যারা উৎসবে অংশগ্রহণ করে অথচ প্রতিযোগিতায় যোগদানে ইচ্ছুক নয় তাদের জন্য আয়োজকরা প্লাজা কনসিস্টোরিয়াল এবং এস্টেফিটা স্ট্রীট থেকে এই প্রতিযোগিতা উপভোগ করার সুযোগ করে থাকে। সপ্তাহব্যাপী চলাকালীন এই উৎসবে প্রায় লাখখানেকেরও অধিক মানুষ জড়ো হয়ে থাকে স্পেনের এই ছোট্ট শহরটাতে। সান ফারমিন শোভাযাত্রা, স্ট্র্যেন্ডো (ড্রামসহ তৈজসপত্র বাজিয়ে সুর তোলা) এবং রানিং বুলসহ আরো বর্নিল সব আয়োজন করা হয়ে থাকে এই উৎসবে।
৪. অক্টোবরফেস্ট, মিউনিখ, জার্মানি
জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেগ পার্টি হচ্ছে অক্টোবরফেস্ট। এই উৎসবটি সাধারণত ১৬ দিনব্যাপী স্থায়ী হয়ে থাকে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে শুরু হয়ে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ অবধি স্থায়ী হয় এই উৎসব। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম একটি মেলা এবং জার্মানির সবচাইতে বড় উৎসব।
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ১৮১০ সালে প্রথমবারের মতো অক্টোবরফেস্টের কথা জানা যায়। মিউনিখ সেন্টারের কাছের থেরেসিয়েনউইসিস নামক এক জায়গায় এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। বিভিন্ন স্বাদের বিয়ার, উরসল (সসেজ), ব্রেজন (প্রেটজল – এক ধরণের বিস্কুট) এবং অন্যান্য আরো ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য সব বয়সী অতিথিরাই এই উৎসবে যোগদান করে থাকে। এছাড়াও, পুরো পরিবারের সবার জন্য একই রকমের কস্টিউম আর প্যারেড এবং রাইডের আয়োজনও থাকে এই উৎসবে।
অক্টোবরফেস্টের আরেকটা ঐতিহ্য হচ্ছে, এই উৎসবে পরিবেশন করা বিয়ার এই মিউনিখ শহরেই তৈরি করা হয়। প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন লিটার বিয়ার গলাধঃকরণ করা হয় এই উৎসবে। এবং প্রায় ৬.৫ মিলিয়ন দর্শনার্থী আসে এই উৎসবে যোগ দিতে। বর্তমানে স্থায়ীভাবে ১৪টি তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছে এই উৎসব উদযাপনের জন্য। সেগুলোর মধ্যে দ্য হিপ্পোড্রাম সবচেয়ে বড়; যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় অক্টোবরফেস্ট ব্যান্ড অক্টোবর ক্ল্যাসিক বাজিয়ে মাতিয়ে রাখেন উপস্থিত সবাইকে। আর তরুণদের জন্য শটেনহ্যামেল খুব বেশী জনপ্রিয় একটি তাঁবু।
৫. এডিনবার্গ আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যাল, এডিনবার্গ, স্কটল্যান্ড
এডিনবার্গে আগষ্টের মাঝামাঝি টানা তিন সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এই উৎসবটা মূলত পারফর্মিং আর্টকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা। তাই দুনিয়ার আনাচে-কানাচে থেকে শিল্পীরা ছুটে আসে সঙ্গীত, নৃত্য, মঞ্চ নাটক এবং অপেরা প্রদর্শনের জন্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালে এই উৎসব গোড়াপত্তন হয়েছিল এবং ১৯৯৯ সালে এটি স্থায়ী একটা ঠিকানা পায় – এডিনবার্গ প্রাসাদের একটি উইংয়ে।
এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যালের আরেকটা আকর্ষণ হচ্ছে মিলিটারি প্যারে। যদিও এটা এই উৎসবের অন্তর্ভূক্ত নয় তবুও এটা আগস্টেই করা হয় বলে মোটামুটি অন্তর্ভূক্তই বলা চলে। ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনী এবং আন্তর্জাতিক সামরিক ব্যান্ডের যৌথ উদ্যোগে রয়্যাল এডিনবার্গ সামরিক প্যারেড এবং নৈশ উৎসবের আয়োজন করা হয়। সামরিক এই নৈশ উৎসব বর্তমানে এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যালের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে বিধায় এডিনবার্গ প্রাসাদেই এর আয়োজন করা হয়।
এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যালের বিকল্প হিসেবে ১৯৪৭ সালে দ্য ফ্রিঞ্জও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটিও আগস্ট মাসেই হয়ে থাকে এবং কমেডি আর মঞ্চনাটকই বেশী প্রদর্শিত হয় এতে। যদিও নৃত্য আর সঙ্গীত পরিবেশনা হয়ে থাকে এই উৎসবে। ফ্রিঞ্জ চলাকালীন আরো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্ট ফেস্টিভ্যাল। এই উৎসবের নৃত্য, সঙ্গীত, মঞ্চনাটক, অপেরাসহ সব ধরণের পারফরম্যান্সই উন্মুক্ত থাকে। মানে হচ্ছে সেগুলো জাজ করার মতো কোনো জুড়ি থাকে না। সেজন্যে যে কেউ চাইলেই এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারে। আবার অনেক অনুষ্ঠানে অ্যাওয়ার্ডও দেয়া হয়ে থাকে; যেমন- কমেডি শো হচ্ছে এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যালের সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় আর জাঁকজমকপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান।
৬. কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কান, ফ্রান্স
ফ্রান্সের রিভেয়রা নদীর তীরের ছোট্ট এক সুন্দর শহরতলীর নাম কান। আর এখানেই বসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আসর। হ্যাঁ, বলছিলাম কান চলচ্চিত্র উৎসবের কথা যার খ্যাতি পুরো দুনিয়া জোড়া। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে অন্যতম প্রধান চলচ্চিত্র উৎসব যেখানে দর্শকদের নির্বাচনে বছরের সেরা চলচ্চিত্রগুলি প্রদর্শিত এবং সম্মানিত হয়ে থাকে। প্রতি বছর সেরা চলচ্চিত্রকে পাম ডি’অর পুরষ্কারে সম্মানিত করা হয়। যা প্রায়শই অস্কারের চাইতে বেশী সম্মানজনক কিংবা সমতুল্য বলেই বিবেচিত করা হয়। এই উৎসবের আড়ম্বরতার জন্য এটিকে ইউরোপের সেরা ফেস্টিভ্যালে বলে মানা হয়।
দ্য কান ফেস্টিভ্যাল বা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নামে পরিচিত এই উৎসবটি ২০০৩ সালের আগ অবধি আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নামেই ব্যাপক পরিচিত ছিল। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব কিংবা বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের মতোই এই ফেস্টিভ্যালকেও সম্মানিত আর প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব বলে ধরা হয়। সেই ১৯৪৬ সাল থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। প্যালেস ডেস ফেস্টিভ্যাল এট দেস কনগ্রেস নামক ভবনে আয়োজন করা হয় এই উৎসবের। ভবনটি নির্মানই করা হয়েছিল এই উৎসব আয়োজনের নিমিত্তে।
৭. লা টমাটিনো ফেস্টিভ্যাল, বুনোল, স্পেন
বুনোল শহরে অনুষ্ঠিত এই লা টমাটিনো ফেস্টিভ্যাল স্পেনের সর্ববৃহৎ খাদ্য উৎসব। এটি আসলে ফুড ফাইটের একটি উৎসব। মানে হচ্ছে খাবার একে অপরের দিকে ছুঁড়ে মেরে আনন্দ পাওয়া। তবে এই উৎসবের বিশেষত হচ্ছে টমেটো। শহরের রাস্তা জুড়ে স্তূপ করে কিংবা ট্রাকে করে টনকে টন পাকা টমেটো রাখা থাকে। অংশগ্রহণকারী সেখান থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো টমেটো নেয় এবং অন্যের দিকে ছুঁড়ে মারে।
একটু বেশীই পাকা আর টসটসে থাকায় অন্যের গায়ে মারা মাত্রই টমেটোগুলো ফেটে যায় এবং সবাই এমনকি পুরো শহর টমেটোর লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে যায়। এমন নয় যে, এটি শুধুমাত্র স্থানীয়দেরই উৎসব বরং এটা পুরো বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয় একটি উৎসব। আর তাই তো হাজার হাজার মানুষের মধ্য থেকে কেবলমাত্র ভাগ্যবান ২০ হাজার মানুষই এই উৎসবে যোগদানের টিকেট সংগ্রহ করতে পারে।
৮. ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, ফ্রাঙ্কফুর্ট, জার্মানি
৫০০ বছরের প্রাচীন এই বইমেলা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় বইমেলা বলে পরিচিত। ফ্রাঙ্কফুর্টে আয়োজিত এই বইমেলা জার্মান ভাষায় ফ্রাঙ্কফুর্টা বুকমেসা নামে পরিচিত। ফ্রাঙ্কফুর্টার মেস ভবনে এই বইমেলার আয়োজন করা হয়। যেটা ভেতরের দিকে প্রায় চার লাখ বর্গফুট জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে এই মেলার আয়োজন করা হয়। পাঁচ দিন ধরে চলে এই মেলা। প্রথম তিনদিন বরাদ্দ থাকে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বহুজাতিক ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্য। আর পরের দুইদিন সর্বস্তরের জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
বিশ্বের প্রাচীন বইমেলাগুলোর মধ্যে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা অন্যতম। সেই ১৪শ শতক থেকে এই বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানা যায়। তবে আধুনিক ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ১৯৪৯ সাল থেকে শুরু হয়ে এখন অবধি চলছে। প্রতিবছর এই মেলায় প্রায় তিন লাখ বইপ্রেমী আসে বিশ্বের নানান দেশ থেকে। তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা মূলত বাণিজ্যের স্বার্থে করা একটা মেলা। এখানে বই বেচাকিনি হয় না। তবে শিল্প-সাহিত্য আলোচনা, লেখকদের সাক্ষাত, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আইন, লাইসেন্স ফি, স্বত্ব নেয়া ইত্যাদি হয়ে থাকে।
৯. সিগেট ফেস্টিভ্যাল, বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরি
বুদাপেস্টের ওবুদাই দ্বীপে অনুষ্ঠিত সিগেট ফেস্টিভ্যালটা মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক আর সঙ্গীত উৎসব। ২০১১ সালে ইউরোপিয়ান ফেস্টিভ্যাল অ্যাওয়ার্ডে ইউরোপের সেরা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হিসেবে নির্বাচিত হয় এই সিগেট ফেস্টিভ্যাল। ১৯৯৩ সাল থেকে মিশ্র সংস্কৃতির এই উৎসব ক্রমশই জনপ্রিয় সঙ্গীত উৎসবে পরিণত হচ্ছে।
বিশ্বের ৭০টি দেশ হতে প্রায় ৪ লাখ দর্শনার্থী আসে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে আনন্দে মাতোয়ারা হতে। এক হাজারেরও বেশী পারফর্মার পারফর্ম করে থাকে এই উৎসবে। যার জন্য ছোট আর বড় মিলিয়ে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম বানানো হয়ে থাকে উৎসবে।
১০. ক্রিসমাস মার্কেট, সমগ্র ইউরোপ
ক্রিসমাস মার্কেটের এই ধারণাটার উদ্ভব হয়েছে জার্মানি, অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্সে। তবে এটা বর্তমানে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। আর এটা বর্তমানে পুরো ইউরোপের সর্বত্র একসাথে পালিত হওয়া একটি বৃহৎ উৎসব। খ্রিস্টের আবির্ভাবের দিন আসার চার সপ্তাহ আগে থেকেই ইউরোপের ছোট-বড় সব শহরের মার্কেটগুলো সেজে উঠে বর্ণিল সব রঙে আর ক্রিসমাসের আনন্দে। দুনিয়ার সব মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে আনন্দের সঙ্গে মার্কেট করার আনন্দই এই উৎসবকে দারুণভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এছাড়া, ক্রিসমাসের উৎসবের আমেজ তো আছেই, রঙীন সাজে সজ্জিত রাস্তাঘাট, মোড়ে মোড়ে আলো ঝলমলে ক্রিসমাস ট্রি, পদে পদে দারুণ আর লোভনীয় সব খাবারের সমারোহ সহ উৎসবের সব আয়োজন।
ড্রেসডেন ক্রিসমাস মার্কেট ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন এবং এটি ১৪৩৪ সালে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে এই মার্কেটে প্রায় ২৫০টি স্টল এবং প্রায় দুই লাখ মানুষের পদচারনায় মুখরিত হয় প্রতিবছর। আরেকটা ইউরোপীয় জনপ্রিয় মার্কেট ভিয়েনার টাউন হলে আয়োজন করা হয়। এছাড়া ইউরোপের প্রতিটা ছোট আর বড় শহরেই এই ক্রিসমাস মার্কেটের আয়োজন হয়ে থাকে।
Feature Image:iedm.com
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Top 31 Festivals In Europe.
02. Best Festivals and Events in Europe.
03. Europe’s Best Summer Music Festivals.